লেবানন-ইসরাইল উত্তেজনা
পেজার বিস্ফোরণ নিয়ে অনেক প্রশ্ন
হিজবুলস্নাহকে একটি ধ্বংসাত্মক বার্তা পাঠানোর জন্য ইসরাইল এই মুহূর্তটিকে বেছে নিয়েছে। কেননা প্রায় এক বছর আগে ৭ অক্টোবর হামাস ইসরাইলে হামলা চালায়। এর একদিন পর হিজবুলস্নাহ উত্তর ইসরাইলে এবং তার আশপাশে রকেট নিক্ষেপ করে। এতে প্রায় এক বছর ধরে ইসরাইল-লেবানন আন্তঃসীমান্ত শত্রম্নতা কেবল বেড়েছে...
প্রকাশ | ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি ডেস্ক
লেবাননে দুটি আলাদা ঘটনায় হাজার হাজার পেজার এবং রেডিও ডিভাইস বিস্ফোরিত হওয়ায় কমপক্ষে ৩৭ জন নিহত এবং কয়েক হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। কীভাবে এই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে, তার নানা ব্যাখ্যা এখন একত্রিত করা হচ্ছে। লেবাননের হিজবুলস্নাহ, যাদের সদস্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর এই হামলা চালানো হয়েছে, তারা এর পেছনে ইসরাইলকে দোষারোপ করেছে। যদিও ইসরাইল এখনো কোনো মন্তব্য করেনি।
'বিবিসি' এই তথ্য অনুসন্ধানে তাইওয়ান থেকে জাপান, হাঙ্গেরি, ইসরাইল এবং পুনরায় লেবাননে গেছে। লেবাননের সমাজকে নাড়া দেওয়া এমন নজিরবিহীন হামলার ঘটনায় বেশ কয়েকটি প্রশ্ন সামনে এসেছে।
তারা কীভাবে পেজারে প্রবেশ করে?
প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, পেজারগুলো এক জটিল সাইবার হামলা বা হ্যাকিংয়ের শিকার হয়েছিল, যার কারণে সেগুলো বিস্ফোরিত হয়। তবে এই তত্ত্বটি উড়িয়ে দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি করার জন্য, সম্ভবত হিজবুলস্নাহর কাছে যাওয়ার আগেই তারা ওইসব যন্ত্রে বিস্ফোরক পেতে রেখেছিল।
পেজারগুলোর ভাঙা অংশ বিশেষের ছবিগুলোয় 'গোল্ড অ্যাপোলো' নামে তাইওয়ানের একটি ছোট ইলেকট্রনিক্স প্রস্তুতকারকের লোগো দেখা যায়। বিবিসি কোম্পানিটির অফিস পরিদর্শন করেছে। অফিসটি তাইপেই শহরতলির একটি বড় শিল্পাঞ্চলে অবস্থিত। কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা হু চিং-কুয়াং এসব শুনে হতবাক হয়ে পড়েন। তিনি জানান, ওই বিস্ফোরণের সঙ্গে তার ব্যবসার কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি তার কারখানার অফিসের বাইরে সাংবাদিকদের বলেন, 'আপনি লেবানন থেকে পাঠানো ছবিগুলো দেখুন। যন্ত্রগুলোর গায়ে কোথাও মেড ইন তাইওয়ান লেখা নেই, আমরা সেই পেজারগুলো তৈরি করিনি!' এর পরিবর্তে তিনি একটি হাঙ্গেরিয়ান কোম্পানির দিকে ইঙ্গিত করেন, যার নাম 'বিএসি কনসাল্টিং'। হু বলেন, তিন বছর আগে তিনি বিএসি-তে গোল্ড অ্যাপোলোর ট্রেডমার্ক লাইসেন্স করেছিলেন, যেন তারা তাদের নিজস্ব পেজারে গোল্ড অ্যাপোলোর নাম ব্যবহার করতে পারে। তিনি বলেন, বিএসি থেকে অর্থ পাঠানোর প্রক্রিয়া 'খুবই অদ্ভুত' ছিল এবং অর্থ দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের সমস্যা ছিল, টাকাগুলো মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসত।
হাঙ্গেরিয়ান কোম্পানির সঙ্গে এর কী সম্পর্ক?
বিবিসি বিএসি কনসাল্টিংয়ের নিবন্ধিত অফিসেও যায়। অফিসটি হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টের একটি আবাসিক এলাকায় অবস্থিত। এই একই ঠিকানা আরও ১২টি কোম্পানি ব্যবহার করে বলে মনে হচ্ছে এবং ওই ভবনের কেউই বিবিসির সংবাদদাতাকে বিএসি কনসাল্টিং সম্পর্কে কিছু বলতে পারেনি।
হাঙ্গেরির কর্মকর্তারা বলছেন, এই প্রতিষ্ঠানটি ২০২২ সালে প্রথমবারের মতো অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। তারা শুধুমাত্র দেশটিতে একটি 'ব্যবসায়িক মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করত। যাদের নিজস্ব কোনো উৎপাদন বা অভিযানের সাইট ছিল না'।
লিঙ্কডইন-এ প্রকাশিত বিএসি'র একটি ব্রোশিওরে দেখা যায়, যুক্তরাজ্যের ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ডিপার্টমেন্টসহ (ডিএফআইডি)- এমন আটটি সংস্থার সঙ্গে কাজ করেছে বলে দাবি করে। ডিএফআইডির দায়িত্বভার যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দপ্তরের ওপর বর্তায়। এ বিষয়ে পররাষ্ট্র দপ্তর বিবিসিকে জানায়, এ ব্যাপারে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। কিন্তু প্রাথমিক কথাবার্তায় তারা জানিয়েছিল, বিএসি'র সঙ্গে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। বিএসি'র ওয়েবসাইটে এক ব্যক্তিকে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী এবং প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। যার নাম ক্রিস্টিয়ানা বারসোনি-আর্সিডিয়াকোনো।
বিবিসি বারসনি-আর্সিডিয়াকোনোর সঙ্গে যোগাযোগ করার অনেক চেষ্টা করলেও তার থেকে কোনো সাড়া পায়নি। তবে তিনি 'এনবিসি নিউজ'র সঙ্গে কথা বলেছেন- 'আমরা কোনো পেজার তৈরি করি না। আমরা কেবল মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করি।'
বিএসি কনসাল্টিংয়ের পেছনে কারা আছে?
'নিউ ইয়র্ক টাইমস' জানিয়েছে, এই প্রতিষ্ঠানটি মূলত ইসরাইলি গোয়েন্দাদের সাহায্যকারী একটি প্রতিষ্ঠান। তিনজন ইসরাইলি কর্মকর্তার বরাত দিয়ে সংবাদপত্রটি জানায়, ইসরাইলি গোয়েন্দা কর্মকর্তা, যারা আসলেই পেজারগুলো তৈরি করছিল, তারা নিজেদের পরিচয় গোপন করতে আরও দুটি শেল কোম্পানি তৈরি করে। বিবিসি নিউ ইয়র্ক টাইমসের এই তথ্যগুলো স্বাধীনভাবে যাচাই করতে পারেনি- তবে জানা গেছে, বুলগেরিয়ান কর্তৃপক্ষ এখন বিএসি'র সঙ্গে যুক্ত আরেকটি কোম্পানির বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে।
বুলগেরিয়ান সম্প্রচারকারী 'বিটিভি' গত বৃহস্পতিবার জানিয়েছে, লেবাননে ডিভাইস হামলার সঙ্গে সম্পর্কিত ১৬ লাখ ইউরো (১৮ লাখ মার্কিন ডলার) বুলগেরিয়ার মধ্য দিয়ে হাঙ্গেরিতে পাঠানো হয়েছে।
কীভাবে রেডিও ডিভাইসের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া হয়?
হামলার দ্বিতীয় দফায় রেডিও ডিভাইস বা ওয়াকিটকিগুলো বিস্ফোরিত হওয়ার কারণ এখনো অস্পষ্ট। বিস্ফোরিত হওয়া ডিভাইসগুলোর মধ্যে অন্তত কিছু ছিল 'আইকম' নামে একটি জাপানি কোম্পানির প্রস্তুত করা। যার মডেল নম্বর আইসি-ভি৮২। 'রয়টার্স' নিউজ এজেন্সি এক নিরাপত্তা সূত্রের বরাতে জানিয়েছে, এই ডিভাইসগুলো পাঁচ মাস আগে হিজবুলস্নাহ কিনেছিল।
এর আগে, আইকমের মার্কিন সহযোগী সংস্থার একজন সেলস এক্সিকিউটিভ বা বিক্রয় নির্বাহী অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস নিউজ এজেন্সিকে বলেছিলেন, লেবাননে যে রেডিওগুলো বিস্ফোরিত হয়েছে, তা কোনো কোম্পানির তৈরি নয়, এমন নকঅফ পণ্য বলে মনে হচ্ছে। ওই কর্মী আরও বলেন, অনলাইনে বিভিন্ন কোম্পানির এমন পণ্যগুলোর জাল সংস্করণ চাইলে খুব সহজেই ইন্টারনেটে খুঁজে পাওয়া যায়। অনলাইন মার্কেটপেস্নসে বিক্রির জন্য তালিকাভুক্ত আইকম আইসি-ভি৮২ খুঁজে পেতে বিবিসির মাত্র কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে।
আইকম এক বিবৃতিতে বলেছে, এই মডেলটি প্রায় এক দশক আগের পুরনো। তারা ২০১৪ সালের অক্টোবরেই এই মডেলটির উৎপাদন এবং বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছিল। এমনকি ডিভাইসটি চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যাটারির উৎপাদনও বন্ধ করে দিয়েছে। সংস্থাটি বলেছে, তারা বিদেশ থেকে কোনো পণ্য তৈরি করে আনে না, তাদের সব রেডিও পশ্চিম জাপানের একটি কারখানায় উৎপাদিত হয়।
বার্তা সংস্থা 'কিয়োডো'র মতে, আইকমের পরিচালক ইয়োশিকি এনোমোয়ো জানিয়েছেন, বিস্ফোরিত রেডিও ডিভাইস বা ওয়াকি-টকিগুলোর ব্যাটারি কম্পার্টমেন্টের আশপাশে ক্ষয়ক্ষতির ছবি থেকে বোঝা যায়, সেগুলো বিস্ফোরক দিয়ে বসানো হতে পারে।
কীভাবে ডিভাইস বিস্ফোরিত হয়েছে?
ভিডিওগুলোয় দেখা যায়, ডিভাইসগুলো বিস্ফোরিত হওয়ার কয়েক সেকেন্ড আগে ভিকটিমরা তাদের পকেটে হাত দেন। ওই বিস্ফোরণের কারণে দেশটির রাস্তাঘাট, দোকানপাট এবং ঘরবাড়িতে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে।
জাতিসংঘে লেবাননের মিশনের একটি চিঠি অনুসারে, লেবানন কর্তৃপক্ষ এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, ডিভাইসগুলোয় একটি 'ইলেক্ট্রনিক বার্তা' পাঠানোর কারণে সেগুলো বিস্ফোরিত হয়। রয়টার্স নিউজ এজেন্সি চিঠিটি হাতে পেয়েছে।
মার্কিন কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমস বলেছে, পেজারগুলো বিস্ফোরণের আগে সেখানে হিজবুলস্নাহ নেতাদের কাছ থেকে বার্তা এসেছিল বলে মনে হচ্ছে। ওই বার্তা ডিভাইসগুলোকে ট্রিগার করতে পারে বলে মনে হচ্ছে, নিউ ইয়র্ক টাইমসকে এমনটাই জানিয়েছেন ওই মার্কিন কর্মকর্তা। রেডিও ডিভাইসগুলোতে কী ধরনের বার্তা পাঠানো হয়েছিল, তা এখনো জানা যায়নি।
অন্যান্য ডিভাইসের মাধ্যমেও কি নাশকতা হতে পারে?
লেবাননের অনেকের মনেই এখন প্রশ্ন, অন্যান্য ডিভাইসের মাধ্যমেও কি নাশকতা হতে পারে? অন্যান্য ডিভাইস যেমন- ক্যামেরা, ফোন বা ল্যাপটপগুলোয় কি পেতে রাখা হতে পারে- মানুষের মধ্যে এমন উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
লেবাননের সেনাবাহিনী বিস্ফোরণ নিয়ন্ত্রণে বৈরুতের রাস্তায় রিমোট কন্ট্রোলড বোমা নিষ্ক্রিয়করণ রোবট নিয়ে অবস্থান নিয়েছে। লেবাননে বিবিসি ক্রুদের থামিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং তাদের ফোন বা ক্যামেরা ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়েছে। ঘিদা নামে এক নারী বিবিসি সংবাদদাতাকে জানান, 'সবাই আতঙ্কিত... আমরা জানি না আমরা আমাদের ল্যাপটপ, আমাদের ফোনের পাশে থাকতে পারব কিনা। এই মুহূর্তে সবকিছুই বিপদের মতো মনে হচ্ছে এবং কেউ জানে না কি করা উচিত।'
এখন হামলা কেন হলো?
ওই নির্দিষ্ট সময়ে কেন ডিভাইসগুলোর বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে, তা নিয়ে বেশ কয়েকটি তত্ত্ব রয়েছে। একটি হলো- হিজবুলস্নাহকে একটি ধ্বংসাত্মক বার্তা পাঠানোর জন্য ইসরাইল এই মুহূর্তটিকে বেছে নিয়েছে। কেননা প্রায় এক বছর আগে ৭ অক্টোবর হামাস ইসরাইলে হামলা চালায়। এর একদিন পর হিজবুলস্নাহ উত্তর ইসরাইলে এবং তার আশপাশে রকেট নিক্ষেপ করে। এতে প্রায় এক বছর ধরে ইসরাইল-লেবানন আন্তঃসীমান্ত শত্রম্নতা কেবল বেড়েছে।
আরেকটি কারণ হতে পারে, ইসরাইলের এই সময়ে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কোনো ইচ্ছা ছিল না, তবে তাদের এই চক্রান্ত ফাঁস হতে চলেছে এই ভয়ে তারা তা করতে বাধ্য হয়।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম 'অ্যাক্সিওস'র মতে, এই পেজার হামলার পেছনে আসল পরিকল্পনা হলো- হিজবুলস্নাহর সঙ্গে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরুর আগে তাদের যোদ্ধাদের পঙ্গু করে দেওয়া। কিন্তু ইসরাইল যখন বুঝতে পারে, হিজবুলস্নাহ সন্দেহজনক হয়ে উঠেছে, তখন তারা হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। তথ্যসূত্র : বিবিসি নিউজ