ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইসরাইলের সেনাবাহিনীকে 'পূর্ণ শক্তি' নিয়ে লেবাননের হিজবুলস্নাহর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। বৃহস্পতিবার নেতানিয়াহুর দপ্তর এ তথ্য জানিয়েছে। নেতানিয়াহুর দপ্তর আরও জানিয়েছে, বুধবার রাতের যুদ্ধবিরতি যে আহ্বান পশ্চিমা মিত্ররা জানিয়েছিল, এতে সাড়া দেননি নেতানিয়াহু। তথ্যসূত্র : বিবিসি, রয়টার্স, আল-জাজিরা, এএফপি
আন্তর্জাতিক ১২ মিত্রের দেওয়া যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়ায় নেতানিয়াহুর কার্যালয় বলেছে, যুদ্ধবিরতির খবর সত্যি নয়। এটি একটি আমেরিকান-ফরাসি প্রস্তাব, যার প্রতি প্রধানমন্ত্রীও সাড়া দেননি। উত্তরে লড়াইকে মধ্যম পর্যায়ের করার অনুমিত নির্দেশনার খবরটিও সত্যের বিপরীত। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় আরও বলেছে, 'তার কাছে উপস্থাপিত পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী আইডিএফকে (ইসরাইলি বাহিনী) পূর্ণ শক্তির সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এ ছাড়াও যুদ্ধের সব লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত গাজায় যুদ্ধ চলবে।'
এর আগে আমেরিকা ও ফ্রান্সসহ ১২টি দেশ ২১ দিনের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেয়। কিন্তু তা প্রত্যাখ্যান করেন ইসরাইলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরাইল কার্ৎজ। বৃহস্পতিবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম 'এক্সে' দেওয়া এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, 'উত্তরে কোনো যুদ্ধবিরতি হবে না। আমরা সন্ত্রাসী সংগঠন হিজবুলস্নাহর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাব। উত্তরাঞ্চলের বাসিন্দাদের নিরাপদে ঘরে ফিরিয়ে আনার জন্য সম্পূর্ণ শক্তি দিয়ে লড়াই করব।'
বুধবার জাতিসংঘে সাধারণ পরিষদের সমাবেশ শেষে আমেরিকা, ফ্রান্স এবং কয়েকটি মিত্র দেশ ইসরাইল-লেবানন সীমান্তজুড়ে ২১ দিনের যুদ্ধবিরতি কার্যকরের আহ্বান জানায়। একই সঙ্গে গাজায় যুদ্ধবিরতির কার্যকরেরও প্রস্তাব দেয় দেশগুলো। লেবাননের প্রধানমন্ত্রী নাজিব মিকাতিও আশা করেছিলেন, শিগগিরই একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি সম্ভব হবে। কিন্তু এখন ইসরাইলি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে লেবাননে উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলেছে এবং স্থল আক্রমণের আশঙ্কা সৃষ্টি করছে।
জাতিসংঘে ভাষণ দিতে নিউইয়র্কে যাওয়ার সময় ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, তিনি এখনো যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের বিষয়ে নিজের প্রতিক্রিয়া জানাননি। বরং সেনাবাহিনীকে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তার সরকারের কট্টরপন্থিরা বলেছেন, ইসরাইলের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা উচিত এবং হিজবুলস্নাহর বিরুদ্ধে আক্রমণ চালিয়ে যাওয়া উচিত।
লেবাননের রাজধানী বৈরুতে হামলা
চালাচ্ছে ইসরাইল
এদিকে, লেবাননের রাজধানী বৈরুতে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল। বৃহস্পতিবার বৈরুতে বিস্ফোরণের শব্দ শোনার কিছুক্ষণ পরই ইসরাইলি বাহিনী এই ঘোষণা দিয়েছে। ইসরাইলের 'আর্মি রেডিও' এক্স-এ দুটি ছবি পোস্ট করেছে। এতে বলা হয়েছে, দুই স্থানে ইসরাইলি ক্ষেপণাস্ত্র বিস্ফোরিত হয়েছে। ইসরাইলি বিমান বাহিনী জানিয়েছে, তারা হিজবুলস্নাহর অবকাঠামো ধ্বংস করার জন্য সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাচ্ছে। আর্মি রেডিও আরও জানিয়েছে, বৈরুতে বিমান হামলায় হিজবুলস্নাহর বিমান ইউনিটের প্রধানকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে। একটি নিরাপত্তা সূত্র জানিয়েছেন, হিজবুলস্নাহর একজন সিনিয়র নেতা সর্বশেষ বিমান হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিলেন। বৈরুতের দক্ষিণ উপশহর দাহিয়েহ-তে এই হামলা চালানো হয়েছে।
এ ছাড়াও রাতভর বেকা উপত্যকা এবং দক্ষিণ লেবাননের প্রায় ৭৫টি হিজবুলস্নাহ লক্ষ্যবস্তুতে, বিশেষ করে অস্ত্রের গুদাম এবং লঞ্চারে বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। লেবাননের ইউনিনে শহরে তিন তলা একটি ভবনে ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে। হামলায় ২৩ সিরিয়ান নাগরিক নিহত হন, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু ছিলেন বলে জানিয়েছেন শহরের মেয়র আলি কুসাস। লেবানন প্রায় ১.৫ মিলিয়ন সিরিয়ান শরণার্থীর আশ্রয়স্থল, যারা সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ থেকে পালিয়ে লেবাননে আশ্রয় নিয়েছে। এদের সংখ্যা অন্তত ১৫ লাখ।
ইসরাইলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার সকালেও হিজবুলস্নাহর বহু লক্ষ্যবস্তুতে আক্রমণ চালিয়েছে তারা, যার মধ্যে সন্ত্রাসী, সামরিক ভবন এবং অস্ত্রাগার রয়েছে। লেবানন থেকেও প্রায় ৪৫টি ক্ষেপণাস্ত্র পশ্চিম গ্যালিলি অঞ্চলে নিক্ষেপ করা হয়। এর মধ্যে কিছু ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করেছে ইসরাইলি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। বাকিগুলো খোলা মাঠে আঘাত হেনেছে বলে দাবি করেছে তারা।
আরেকটি গাজা হতে পারে না লেবানন
হত্যা-ধ্বংস বন্ধ করুন : গুতেরেস
লেবাননের হিজবুলস্নাহকে লক্ষ্য করে ইসরাইলের ব্যাপক বিমান হামলায় শত শত মানুষের প্রাণহানির ঘটনায় কঠোর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। তিনি বলেছেন, লেবানন আরেকটি গাজা হতে পারে না। একই সঙ্গে লেবাননে হত্যা ও ধ্বংস বন্ধ করতেও আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
ইসরাইল-লেবানন ক্রমবর্ধমান সংঘাতের বিষয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠকে ভাষণ দিয়েছেন সংস্থাটির মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। সেখানে তিনি বলেছেন, লেবানন আরেকটি গাজা হতে পারে না। গুতেরেস বলেন, 'আমি এই আগুন নেভাতে সাহায্য করার জন্য নিরাপত্তা পরিষদকে জোর দিয়ে কাজ করার জন্য অনুরোধ করছি। সংঘাতরত পক্ষগুলোকে অবিলম্বে শত্রম্নতা বন্ধে ফিরে আসতে হবে... বেসামরিকদের রক্ষা করতে হবে। বেসামরিক অবকাঠামোকে হামলার লক্ষ্যবস্তু করা উচিত নয়। জাতিসংঘের সব সম্পদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আন্তর্জাতিক আইনকে অবশ্যই সম্মান করতে হবে।' তিনি আরও বলেন, 'সব পক্ষের কাছে আমার অনুরোধ, আসুন স্পষ্ট একটি কণ্ঠে বলি- হত্যা ও ধ্বংস বন্ধ করুন, বাগাড়ম্বরপূর্ণ উক্তি এবং হুমকির সুরে কথা বলা কমিয়ে দিন এবং সংঘাতের কিনারা থেকে সরে আসুন।' গুতেরেস বলেন, 'আমাদের যে কোনো মূল্যে' সর্বাত্মক যুদ্ধ এড়ানো উচিত।