শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন অনুরা কুমার দিশানায়েক। স্থানীয় সময় সোমবার রাজধানী কলম্বোতে প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন তিনি। অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে শ্রীলংকার ইতিহাস 'নতুন করে রচনার' প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছেন অনুরা। রাজাপাকসে ক্ষমতাচু্যত হওয়ার পর সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পান রণিল বিক্রমাসিংহে। এরপর প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় দেশটিতে। রোববার অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে তার ভোটপ্রাপ্তি ৪২ শতাংশের বেশি। অন্যদিকে, নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সাজিথ প্রেমদাসা পেয়েছেন ৩২.৭৬ শতাংশ ভোট। আর নির্বাচনে দিশানায়েকের এই জয়কে দুর্নীতি ও স্বজনতোষণের সংস্কৃতির প্রত্যাখ্যান হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। তথ্যসূত্র : বিবিসি
প্রথম বামপন্থি প্রেসিডেন্ট হিসেবে অনুরা দিশানায়েক শপথ নেওয়ার পরপরই বলেন, 'রাজনীতিবিদদের প্রতি জনগণের আস্থা পুনরায় ফিরিয়ে আনার জন্য আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব।' তিনি আরও বলেন, 'আমি জাদু দেখাই না, আমি জাদুকর নই। এমন কিছু আছে, যা আমি জানি এবং এমন কিছু থাকতে পারে, যা আমি জানি না। তবে আমি সেরা পরামর্শ চাইব এবং আমার সেরাটাই করব। এজন্য সবার সহযোগিতা চাই।'
আত্মস্বীকৃত মার্কসবাদী অনুরা কুমারা দিশানায়েক পিপলস লিবারেশন ফ্রন্ট বা জনতা বিমুক্তি পেরামুনার (জেভিপি) পার্টির নেতা। রোববার (২২ সেপ্টেম্বর) শ্রীলংকার নাগরিকদের আস্থা অর্জন করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হন তিনি। মূল প্রতিদ্বন্দ্বী সাজিথ প্রেমাদাসা এবং ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট রণিল বিক্রমাসিংহেকে ধরাশায়ী করে জয়ী হন তিনি।
জেভিপি প্রধান অনুরা কুমারা দিশানায়েক এবারের নির্বাচনে এনপিপি জোটের প্রার্থী ছিলেন। জোটটি এর আগে কখনো শ্রীলংকার বিরোধীদলও ছিল না। দেশটির ২২৫ সদস্যের পার্লামেন্টে এই জোটের আসন ছিল মাত্র তিনটি। কিন্তু ২০২২ সালে গণবিক্ষোভের মুখে গোতাবায়া রাজাপাকসে দেশ ছেড়ে পালানোর পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জেভিপির জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। ওই বিক্ষোভে সক্রিয় ভূমিকা ছিল দলটির। আন্দোলনের পর জেভিপি বৃহত্তর পরিবর্তনের ডাক দেয়। সামাজিক ন্যায়বিচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে দলটির অনড় অবস্থান নাগরিকদের আকৃষ্ট করেছে।
এবার ভারতের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলতে যাচ্ছে শ্রীলংকা!
অনুরা কুমারা দিশানায়েক বামপন্থি। মার্কসবাদী এই নেতার দল জনতা বিমুক্তি পেরেমুনা (জেভিপি) বরাবরই ভারতকে 'আগ্রাসী' হিসেবে দাবি করে এসেছে। এছাড়া শ্রীলংকায় ভারত সরকারের বিভিন্ন নীতির কট্টর সমালোচক ছিলেন অনুরা দিশানায়েক। সেই হিসেবে অনুরার বিজয় ভারতের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলতে যাচ্ছে বলে ধারণা করা যায়।
ভারত-শ্রীলংকার কূটনৈতিক সম্পর্কে বিগত কয়েক দশকে কিছুটা উত্থান-পতন ঘটেছে। আশির দশকের শুরুতে শ্রীলংকার তামিল বিদ্রোহীদের গোপনে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করেছিল ভারত। বিষয়টি বুঝতে পেরে একরকম বাধ্য হয়েই ১৯৮৭ সালে শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট জুলিয়াস রিচার্ড জয়াবর্ধনে ভারতের সঙ্গে শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তির আলোকে তামিল টাইগারদের দমনে সহায়তার হাত বাড়ায় ভারত। এ সময় ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে নির্যাতন, ধর্ষণসহ বিভিন্ন অভিযোগ ওঠে। পরে ভারতীয় বাহিনীকে শ্রীলংকার মাটি থেকে উৎখাতের জন্য দেশটির সরকার তামিল টাইগারদের সঙ্গে গোপনে আঁতাত করতে বাধ্য হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৯০ সালে শ্রীলংকার মাটি ছাড়ে ভারত।
২০২২ সালে শ্রীলংকা থেকে পালিয়ে যান দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে। রাজপাকসে পরিবার ছিল চীন ঘেঁষা। দেশটির বড় বড় অর্থনৈতিক প্রকল্পে চীনের বড় অংকের বিনিয়োগ ছিল। রাজাপাকসে পরিবারের বিদায়ের পর ক্ষমতায় আসেন রনিল বিক্রমাসিংহে। নতুন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্ক তৈরি হয়। অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের জন্য শ্রীলংকাকে বড় অংকের সহায়তাও দিয়েছিল ভারত।
কিন্তু রোববার শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার (এনপিপি) জোটের নেতা অনুরা কুমার দিশানায়েক। ২০২২ সালে রাজাপাকসে পরিবারকে উৎখাতে গণ-অভু্যত্থান গড়ে তুলতে সক্রিয় ছিল দিশানায়েকের দল জেভিপি। রাজাপাকসে পরিবারের পালানোর পর রাজনীতিতে যে শূন্যতা তৈরি হয়, সেখানে বড় পরিবর্তনের ডাক দিয়েছিলেন অনুরা। তার জেভিপি ঐতিহ্যগতভাবেই চীন ঘেঁষা। অতীতে জেভিপি শ্রীলংকার প্রতি ভারতের নীতির সমালোচনা করেছিল এবং এটাকে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ বলে আখ্যা দিয়েছিল। অনুরা দিশানায়েক তার নির্বাচনী প্রচারাভিযানের বক্তৃতার সময় ভারতীয় ব্যবসায়ী গৌতম আদানির অর্থায়নে শ্রীলংকায় চলমান একটি বায়ু বিদু্যৎ প্রকল্প বাতিল করার প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছিলেন। গত সপ্তাহে তিনি বলেছিলেন, 'বৃহৎ পরিসরের পরিপ্রেক্ষিতে আদানি প্রকল্পের ব্যয় হ্রাস করা উচিত। কিন্তু এর বাস্তব চিত্র বিপরীত। এটি স্পষ্টতই একটি দুর্নীতিগ্রস্ত চুক্তি এবং আমরা অবশ্যই এটি বাতিল করব।'
প্রসঙ্গত, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরকারের ঘনিষ্ঠজন বলে ব্যাপকভাবে পরিচিত গৌতম আদানি। স্বাভাবিকভাবেই আদানির সঙ্গে চুক্তি বাতিল করলে তার কিছুটা উত্তাপ মোদি সরকারের গায়েও লাগবে।
এছাড়া চীন ঘেঁষা হওয়ার কারণে দিশানায়েক স্বাভাবিকভাবেই শ্রীলংকায় বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বেইজিংকেই অগ্রাধিকার দেবে। সব মিলিয়ে বলতে গেলে, শ্রীলংকায় ভারতের স্বার্থ হয়তো ক্ষুণ্ন হতে যাচ্ছে নতুন প্রেসিডেন্ট অনুরা দিশানায়েকের আমলে।