তারবিহীন যোগাযোগের যন্ত্র পেজার, ওয়াকিটকি বিস্ফোরণে লেবাননে মৃতু্যর মিছিলের মধ্যেই সে দেশে বড়সড় হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। সর্বশেষ এই হামলাকে গত প্রায় এক বছরের মধ্যে লেবাননে চালানো ইসরাইলের সবচেয়ে ভয়াবহ বলে মনে করা হচ্ছে। এই ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে হতাহতের খবর সামনে আসেনি। পেজার-কান্ডে তেল আবিবের তীব্র সমালোচনা করে বৃহস্পতিবার কড়া বার্তা দিয়েছিলেন হিজবুলস্নাহ নেতা হাসান নাসরালস্নাহ। তার ভাষণের পরই লেবাননে হামলা চালায় ইসরাইলি বিমান বাহিনী। ইসরাইলের দাবি, তাদের হামলায় ধ্বংস হয়েছে হিজবুলস্নাহর ১০০টি রকেট লঞ্চার। ধ্বংস হয়েছে এক হাজার ক্ষেপণাস্ত্র। তথ্যসূত্র : বিবিসি, রয়টার্স, আল-জাজিরা, এএফপি
গত মঙ্গলবার পেজার বিস্ফোরণে রক্তাক্ত হয়েছে লেবানন। প্রাণ গেছে ১২ জনের। আহত চার হাজারের কাছাকাছি। হাসপাতালগুলো উপচে পড়ছে আহতদের ভিড়ে। সেই ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার আগেই নতুন করে বিস্ফোরণ হয় লেবাননে। দুমদাম ওয়াকিটকি ফেটে মৃতু্য হয় অন্তত ২০ জনের। আহত হন ৪৫০ জন। মূলত যোগাযোগের যন্ত্রে ইসরাইলের হামলার পর লেবাননজুড়ে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। দেশটির অনেক নাগরিক এখন বিস্ফোরণের আশঙ্কায় তাদের মোবাইল ফোন থেকেও দূরে থাকছেন। এই পরিস্থিতিতে হিজবুলস্নাহর ওপর সরাসরি হামলা চালাল ইসরাইল।
এদিকে, পেজার ও ওয়াকিটকি বিস্ফোরণের বিষয়ে ইসরাইল সরাসরি মন্তব্য করেনি। যদিও নিরাপত্তা সূত্রগুলো বলছে, হামলাটি সম্ভবত ইসরাইলের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছে। এছাড়া জাতিসংঘে লেবাননের মিশন বৃহস্পতিবার নিরাপত্তা পরিষদে দেওয়া এক চিঠিতে বলেছে, ইসরাইল ইলেকট্রনিক বার্তা ব্যবহার করে এবং লেবাননে পৌঁছানোর আগে এগুলোতে বিস্ফোরক রাখার মাধ্যমে ডিভাইসগুলোর বিস্ফোরণের জন্য দায়ী।
গত প্রায় এক বছরের যুদ্ধের মধ্যে ইসরাইলি যুদ্ধবিমানগুলো বৃহস্পতিবার গভীর রাতে দক্ষিণ লেবাননে সবচেয়ে তীব্র হামলা চালায়। পশ্চিমাদের পক্ষ থেকে সংযমের আহ্বানের মধ্যে হওয়া এই হামলা ইসরাইল ও লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুলস্নাহর মধ্যে সংঘর্ষকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
হোয়াইট হাউস বলেছে, সংকটের কূটনৈতিক সমাধান অর্জন সম্ভব এবং সেটিই জরুরি। এছাড়া ইসরাইল ও হিজবুলস্নাহর মধ্যে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাজ্যও। হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র কারিন জঁ্য-পিয়ের এক ব্রিফিংয়ে বলেছেন, সংঘাত ও উত্তেজনার 'সম্ভাব্য বৃদ্ধির বিষয়ে ভীত এবং উদ্বিগ্ন' আমেরিকা।
ইসরাইলের সামরিক বাহিনী বলেছে, বৃহস্পতিবার গভীর রাতে চালানো এই অভিযানে তাদের যুদ্ধবিমানগুলো দুই ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে দক্ষিণ লেবাননে শত শত 'মাল্টিপল রকেট-লঞ্চার ব্যারেলে' আঘাত করেছে, যেগুলো কিছুক্ষণের মধ্যেই ইসরাইলের দিকে নিক্ষেপ করা হতো।
লেবাননের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা 'এনএনএ' জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার রাত ৯টার পর দক্ষিণ লেবাননে ৫২টির বেশি হামলা চালানো হয়েছে। লেবাননের তিনটি নিরাপত্তা সূত্র জানিয়েছে, গত বছরের অক্টোবরে সংঘাত শুরু হওয়ার পর এটিই সবচেয়ে তীব্র বিমান হামলা।
হিজবুলস্নাহর ওপর আক্রমণ চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করে ইসরাইলের সামরিক বাহিনী বলেছে, বৃহস্পতিবার সারাদিনে তাদের চালানো হামলায় প্রায় ১০০টি রকেট লঞ্চার এবং দক্ষিণ লেবাননে অন্যান্য লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করা হয়েছে।
এদিকে, বৃহস্পতিবার এক টিভি ভাষণে হিজবুলস্নাহ নেতা হাসান নাসরালস্নাহ বলেছেন, গত মঙ্গল ও বুধবার ডিভাইস বিস্ফোরণের ঘটনা 'সব রেড লাইন অতিক্রম করেছে'। তিনি বলেছেন, 'সব নিয়ন্ত্রণ, আইন এবং নৈতিকতার বাইরে চলে গেছে শত্রম্ন। এই আক্রমণগুলোকে যুদ্ধাপরাধ বা যুদ্ধ ঘোষণা হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।'
নাসরুলস্নাহ বলেন, 'গত মঙ্গলবার ইসরাইল পেজারে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এক মিনিটে চার হাজার মানুষকে হত্যা করতে চেয়েছিল। যার মধ্যে অনেক বেসামরিক মানুষ ছিলেন। এর পরের দিন বুধবার দুই মিনিটে আরও এক হাজার। ইসরাইল পাঁচ হাজার মানুষকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল।' তিনি আরও বলেছেন, 'আমরা বড় ধাক্কা খেয়েছি। কিন্তু এটি হলো যুদ্ধ, এটি দ্বন্দ্ব। আমরা শুধুমাত্র ইসরাইলি শত্রম্নদের নয়, আমেরিকা এবং ন্যাটোকেও জানি। তারা প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে আমাদের চেয়ে এগিয়ে।'
হিজবুলস্নাহ প্রধান দাবি করেছেন, এই হামলার মাধ্যমে তাদের দুর্বল করে দিতে চেয়েছিল ইসরাইল। তারা চেয়েছিল নেতৃত্বে ধস ঘটাতে। কিন্তু এতে তারা সফল হয়নি। কারণ যেসব পেজারে বিস্ফোরণ ঘটেছে, সেগুলো হিজবুলস্নাহর কমান্ডাররা ব্যবহার করেন না। নাসরালস্নাহ আরও বলেছেন, যতদিন পর্যন্ত গাজায় ইসরাইলিরা বর্বরতা বন্ধ না করবে, ততদিন তারা তাদের হামলা অব্যাহত রাখবেন।
শক্তিশালী এ সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রধান জানিয়েছেন, ইসরাইল অধিকৃত ফিলিস্তিনের উত্তরাঞ্চলে (উত্তর ইসরাইল) তাদের নাগরিকদের ফেরানোর লক্ষ্য ঠিক করেছে। কিন্তু হিজবুলস্নাহ এটি হতে দেবে না।
পাল্টা আঘাত হিজবুলস্নাহর
এদিকে, পাল্টা আঘাত হিসেবে ইসরাইলকে লক্ষ্য করে অন্তত ১৪০টি রকেট নিক্ষেপ করেছে হিজবুলস্নাহ। তারা জানিয়েছে, দক্ষিণ লেবাননে ইসরাইলি হামলার প্রতিশোধ ও ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি সমর্থন জানিয়ে এই রকেট হামলা চালানো হয়েছে।
ইসরাইলের গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, রকেট হামলার পর বেশ কিছু স্থানে আগুন ধরে যায়, যা নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করা হয় এয়ারক্রাফট। ইসরাইলের সেনাবাহিনী জানিয়েছে, উত্তর ইসরাইলকে লক্ষ্য করে লেবানন থেকে ছোড়া ১৪০টি রকেট চিহ্নিত করা হয়েছে।