ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারবার বলেন, তার জন্ম আন্দোলনের গর্ভে। আন্দোলনের ভাষা তিনি বোঝেন। কিন্তু যেটা বলেন না, সেটা হলো- আন্দোলনের ঝাঁজ কখন কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, সেটাও তার নখদর্পণে। আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি এবং অভিমুখ কীভাবে ঘুরিয়ে দিতে হয়, প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কীভাবে 'কামব্যাক' করতে হয়, দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা সেটা খুব ভালোমতো শিখিয়ে দিয়েছে তাকে। সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে অতীতে বহুবার বহু কামব্যাক করেছেন মমতা। যখন বিরোধী নেত্রী ছিলেন তখন তো বটেই, মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসার পরও বহুবার চাপ এসেছে, সেসব চাপ সামলে স্বমহিমায় প্রত্যাবর্তন করেছেন। ঠিক যেমনটা করলেন শনিবার জুনিয়র চিকিৎসকদের ধরনা মঞ্চে যোগ দিয়ে।
কলকাতার আরজি কর হাসপাতালে একজন শিক্ষানবীশ নারী চিকিৎসককে ধর্ষন ও হত্যার বিচারসহ পাঁচ দফা দাবি নিয়ে কলকাতার স্বাস্থ্য ভবনের সামনে ধরনা কর্মসূচি চালাচ্ছেন জুনিয়র চিকিৎসকদের একাংশ। সিনিয়র চিকিৎসকদের একটা বড় অংশ তাদের দাবির পক্ষে। শুরুর দিকে বিপুল জনসমর্থনও ছিল আন্দোলনকারীদের পক্ষে। নিন্দুকরা বলেন, এসবের পাশাপাশি ছিল রাজনৈতিক ইন্ধনও। সব মিলিয়ে সরকারের বিরুদ্ধ স্বর হিসেবে উঠে আসছিল চিকিৎসকদের ধরনা মঞ্চ। পশ্চিমবঙ্গের 'নিষ্ক্রিয়' বিরোধী শিবির যা করতে ব্যর্থ, সেটাই খানিক করে দেখিয়েছেন কয়েক হাজার চিকিৎসক শিক্ষার্থী। সরকারকে ব্যতিব্যস্ত করা, আমজনতার সহানুভূতি কুড়ানো। বলতে আপত্তি নেই, এতে খানিক 'ব্যাকফুটে' চলে গিয়েছিল তৃণমূল সরকার। ব্যাকফুটে পড়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা নিজেও।
রাজ্য সরকারের প্রতি আস্থা কমছে মানুষের, বুঝতে দেরি করেননি মমতা। দফায় দফায় আলোচনার টেবিলে ডেকেছেন আন্দোলনকারীদের। এতে সাড়া মেলেনি। নিজে নবান্নে (পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য সচিবালয়) অপেক্ষা করেছেন। আন্দোলনকারীরা বারবার শর্ত চাপিয়েছেন, জটিলতা তৈরি করেছেন, সুপ্রিম কোর্টের 'পরামর্শ' অমান্য করেছেন। কিন্তু এসবের পর শাস্তির বিধান দেওয়ার পথ খোলা থাকলেও সে পথ মাড়ালেন না মমতা, বরং ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করলেন আন্দোলনকারীদের জন্য। নবান্নের সভাকক্ষে একা জুনিয়র ডাক্তারদের জন্য অপেক্ষায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা, সেই ছবি আমজনতার মননে কী প্রভাব ফেলতে পারে, সেটা শহুরে মধ্যবিত্তর পক্ষে বোঝা বড় কঠিন। এরপর মমতা যেটা করলেন, সেটা আক্ষরিক অর্থেই 'মাস্টারস্ট্রোক'। ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে সটান চলে গেলেন ধরনা মঞ্চে। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে একাত্মতার বার্তা দিয়ে বলে গেলেন, 'মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নয়, দিদি হিসেবে তোমাদের কাছে এসেছি। তোমাদের আন্দোলনকে কুর্নিশ। আমি সমব্যাথী।' বড় দিদির মতোই বললেন, তিনি বলেন, 'শুক্রবার সারা রাত ঝড়জল হয়েছে। তোমরা যে ভাবে বসে আছো, আমার কষ্ট হচ্ছে। গত ৩৪ দিন ধরে আমিও রাতের পর রাত ঘুমাইনি। কারণ, তোমরা রাস্তায় থাকলে আমাকেও পাহারাদার হিসেবে জেগে থাকতে হয়।' আন্দোলনকারীদের আশ্বস্ত করে বলে দিলেন, 'আমার ওপর ভরসা রাখো। কারও প্রতি অন্যায় হতে দেব না। কোনো দোষী আমার বন্ধু নয়। একটু সময় দিতে হবে। একদিনে হবে না।'
তার প্রতিটি কথায়, আস্থা ফিরে পাওয়ার চেষ্টা, প্রতিটা কথায় মমত্ব আর একাত্মতার বার্তা। যা প্রত্যাখ্যান করা আমজনতার পক্ষে কঠিন। ঝড়বৃষ্টির দিনে আন্দোলনকারীদের পাশে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বসে পড়ার যে চিত্র, সেই চিত্র মিইয়ে পড়া তৃণমূল সমর্থকদের মধ্যে তার প্রতি আস্থা ফেরাবে শুধু নয়, একই সঙ্গে জনমানসেও বার্তাও দেবে, দরকার পড়লে মমতার সরকার নমনীয় হতে রাজি। কোথাও ভুল হয়ে থাকলে, সেই ভুল শুধরে নিতে রাজি।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আরও একবার রাস্তায় নেমে বোঝালেন, 'আমি তোমাদেরই লোক। বিপদের দিনে তোমাদের পাশে আছি।' বলা বাহুল্য, এদিন মুখ্যমন্ত্রীর পদক্ষেপের পর চিকিৎসকদের আন্দোলনের ঝাঁজ কমবে। ঠিক যে সময় চিকিৎসকদের প্রতি মানুষের সমর্থনে ভাটা পড়া শুরু হলো, তখনই মমতার ধরনা মঞ্চে যাওয়া, চিকিৎসকদের সিদ্ধান্তহীনতায় ফেলবে, এতে কোনো সংশয় নেই। তথ্যসূত্র : ইনডিয়ান এক্সপ্রেস