বহু শত বছরের সমস্যা
দক্ষিণ চীন সাগরে সীমানা বিরোধ
প্যারাসেল ও স্প্র্যাটলি দ্বীপপুঞ্জ প্রায় মানব বসতিহীন। তবে এই দুটি জায়গার আশপাশেই হয়তো প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ আছে। এসব এলাকায় কোনো বিস্তারিত অনুসন্ধান বা জরিপ এখনো হয়নি। কাজেই নিকটবর্তী অন্য অঞ্চলে পাওয়া খনিজ সম্পদের ভিত্তিতেই এ এলাকার সম্পদের অনুমান করা হচ্ছে... চীন ১৯৪৭ সালে একটি মানচিত্র প্রকাশ করে এতে তাদের দাবির বিস্তারিত তুলে ধরেছিল। তারা বলেছিল, তাদের এই দাবির সমর্থন মিলবে ইতিহাসে। বেইজিং বলছে, তাদের এই দাবি বহু শত বছরের পুরনো, যখন প্যারাসেল এবং স্প্র্যাটলি দ্বীপপুঞ্জ চীনা জাতির অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে গণ্য হতো...
প্রকাশ | ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি ডেস্ক
দক্ষিণ চীন সাগরে সীমানা নিয়ে বিভিন্ন দেশ বিরোধে লিপ্ত ছিল বহু শত বছর ধরে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই সীমানা বিরোধ নিয়ে উত্তেজনা অনেক বেড়েছে। বিশেষ করে সম্প্রতি চীন যে ধরনের ব্যাপক দাবি শুরু করেছে, যার মধ্যে বিভিন্ন দ্বীপপুঞ্জ এবং সংলগ্ন জলসীমাও রয়েছে, তা ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, তাইওয়ান, মালয়েশিয়া এবং ব্রম্ননেইকে ক্ষুব্ধ করেছে। এসব দেশও এখন দক্ষিণ চীন সাগরে সীমানা নিয়ে পাল্টা দাবি করছে। অন্য দেশও সাগরের মাঝখানে প্যারাসেল এবং স্প্র্যাটলি দ্বীপপুঞ্জ এবং সাগরের বিভিন্ন অঞ্চলের ওপর তাদের অধিকার দাবি করছে।
চীন তাদের দাবির সমর্থনে সাগরের মাঝখানে অনেক কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করছে এবং নৌবাহিনী পাঠিয়ে টহল দিচ্ছে। আমেরিকা বলছে, তারা সীমানা বিরোধে কোনো পক্ষ নেয় না, কিন্তু সেখানে যুদ্ধজাহাজ এবং যুদ্ধবিমান পাঠিয়েছে, যেটিকে তারা 'নৌপথে চলাচলের স্বাধীনতা' রক্ষার অভিযান বলে বর্ণনা করে থাকে।
দক্ষিণ চীন সাগরে জাপানের কোনো সরাসরি দাবি নেই। তবে তারা সেখানে ভিয়েতনাম এবং ফিলিপাইনের দাবির সমর্থনে নিজেদের জাহাজ এবং সামরিক সরঞ্জাম পাঠায়। এ অঞ্চলে একটা সংঘাত বেধে যেতে পারে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। যদি এ রকম সংঘাত শুরু হয়, তার প্রভাব পড়বে পুরো বিশ্বে।
এই সমুদ্রসীমা নিয়ে বিভিন্ন দেশের
কেন এত আগ্রহ?
দক্ষিণ চীন সাগর একটি প্রধান সমুদ্রপথ। জাতিসংঘের বাণিজ্য এবং উন্নয়ন বিষয়ক সংস্থা 'আংকটাডের' অনুমান, বিশ্বের মোট বাণিজ্যের প্রায় ২১ শতাংশ ২০১৬ সালে এই সমুদ্রপথে পরিবহণ করা হয়েছে, যার পরিমাণ প্রায় ৩.৩৭ ট্রিলিয়ন ডলার।
এ ছাড়া এখানে মৎস্য সম্পদও আছে প্রচুর। পুরো অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ এই সাগরে মাছ ধরে জীবন চালায়। বিশ্বের প্রায় অর্ধেক মাছ ধরা জাহাজ ও নৌকা চলে এখানে।
প্যারাসেল ও স্প্র্যাটলি দ্বীপপুঞ্জ প্রায় মানব বসতিহীন। তবে এ দুটি জায়গার আশপাশেই হয়তো প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ আছে। এসব এলাকায় কোনো বিস্তারিত অনুসন্ধান বা জরিপ এখনো হয়নি। কাজেই নিকটবর্তী অন্য অঞ্চলে পাওয়া খনিজ সম্পদের ভিত্তিতেই এ এলাকার সম্পদের অনুমান করা হচ্ছে।
নাইন-ড্যাশ লাইন এবং অন্য দাবি
দক্ষিণ চীন সাগরের সবচেয়ে বড় অংশটি দাবি করে চীন। তথাকথিত নাইন-ড্যাশ লাইনের মাধ্যমে চীন তাদের এই সীমানা চিহ্নিত করে রেখেছে। মোট ৯টি ড্যাশ চিহ্ন দিয়ে এই নাইন-ড্যাশ লাইনটি তৈরি। এটি চীনের সবচেয়ে দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ হাইনান থেকে শত শত মাইল দক্ষিণ এবং পূর্বদিক পর্যন্ত বিস্তৃত।
চীন ১৯৪৭ সালে একটি মানচিত্র প্রকাশ করে এতে তাদের দাবির বিস্তারিত তুলে ধরেছিল। তারা বলেছিল, তাদের এই দাবির সমর্থন মিলবে ইতিহাসে। বেইজিং বলছে, তাদের এই দাবি বহু শত বছরের পুরনো, যখন প্যারাসেল এবং স্প্র্যাটলি দ্বীপপুঞ্জ চীনা জাতির অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে গণ্য হতো।
তবে ঠিক এই একই দাবি করে তাইওয়ান। কিন্তু সমালোচকরা বলেন, চীন আসলে সুনির্দিষ্টভাবে বলে না, তাদের দাবিতে কী কী বিষয় অন্তর্ভুক্ত। আর চীনের আঁকা মানচিত্রে যে নাইন-ড্যাশ লাইন দেখা যায়, সেটি প্রায় পুরো দক্ষিণ চীন সাগরজুড়ে বিস্তৃত, এর কোন বিন্দু থেকে কতটুকু পর্যন্ত তাদের সীমানা, সেটির উলেস্নখ নেই। আর চীন এই নাইন-ড্যাশ লাইনের মধ্যে যেসব স্থলভূমি, কেবল সেগুলোই দাবি করছে, নাকি এর সঙ্গে পুরো সমুদ্রসীমার ওপরও দাবি জানাচ্ছে, তা পরিষ্কার নয়।
ভিয়েতনাম চীনের এসব দাবির সঙ্গে তীব্র দ্বিমত পোষণ করে। তারা বলে, ১৯৪০-এর দশকের আগে চীন কখনোই এসব দ্বীপের ওপর সার্বভৌমত্বের দাবি জানায়নি। ভিয়েতনাম দাবি করে, প্যারাসেল ও স্প্র্যাটলি দ্বীপপুঞ্জ তারাই শাসন করেছে ১৭শ শতক থেকে এবং তাদের কাছে এর দালিলিক প্রমাণ আছে।
ফিলিপাইনও এ অঞ্চলের ওপর দাবি জানায়। এক্ষেত্রে স্প্র্যাটলি দ্বীপপুঞ্জ ভৌগোলিকভাবে তাদের দেশের কতটা কাছাকাছি সেটি তারা উলেস্নখ করে।
অন্যদিকে স্কারবারা দ্বীপের ওপর দাবি জানায় চীন এবং ফিলিপাইন উভয় দেশই (চীনে স্কারবারা দ্বীপ হুয়াংগিয়ান নামে পরিচিত)। এই দ্বীপের অবস্থান ফিলিপাইন থেকে ১০০ মাইল, অন্যদিকে চীন থেকে ৫০০ মাইল দূরে।
মালয়েশিয়া ও ব্রম্ননেইও দক্ষিণ চীন সাগরের কিছু অংশের ওপর দাবি জানায়। তারা বলে, জাতিসংঘের সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত সনদে (ইউনাইটেড নেশন্স কনভেনশন অন দ্য ল অব দ্য সি বা আনক্লস) ইকোনমিক এক্সক্লুশন জোনের যে সংজ্ঞা দেওয়া আছে, সেই অনুযায়ী এগুলো তাদের সীমানা। তবে বিতর্কিত দ্বীপগুলোর ওপর ব্রম্ননেই কোনো দাবি জানায় না, তবে মালয়েশিয়া স্প্র্যাটলি দ্বীপপুঞ্জের কিছু কিছু দ্বীপ নিজেদের বলে দাবি করে।
মারাত্মক সংঘাত
দক্ষিণ চীন সাগরে সীমানা বিরোধ নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে গুরুতর গোলযোগ হয়েছে ভিয়েতনাম ও চীনের মধ্যে। ফিলিপাইন এবং চীনও কয়েকবার মুখোমুখি সংঘাতে জড়ানোর উপক্রম হয়েছে। এ রকম কিছু ঘটনাবলি-
এক. ১৯৭৪ সালে চীনারা ভিয়েতনামের কাছ থেকে প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জ দখল করে নেয়। এ সময় ৭০ জন ভিয়েতনামি সেনা নিহত হয়।
দুই. ১৯৮৮ সালে স্প্র্যাটলি দ্বীপপুঞ্জে আবারও দুই পক্ষ মুখোমুখি হয়। সেবারও ভিয়েতনাম বেশি ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়, তাদের ৬০ জন নাবিক মারা যান।
তিন. ২০১২ সালের শুরুর দিকে চীন এবং ফিলিপাইন সাগরে দীর্ঘসময় ধরে মুখোমুখি অবস্থানে ছিল, তারা পরস্পরের বিরুদ্ধে স্কারবারা দ্বীপপুঞ্জে অনুপ্রবেশের অভিযোগ করছিল।
চার. ২০১২ সালে এ রকম একটি খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, চীনা নৌবাহিনী ভিয়েতনামের একটি অনুসন্ধানী অভিযানে নাশকতা চালিয়েছে। এই খবর যাচাই করা যায়নি, তবে এ সময় ভিয়েতনামের রাস্তায় অনেক বড় বড় চীন-বিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে।
পাঁচ. ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে ফিলিপাইন জানায়, তারা দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের দাবিকে চ্যালেঞ্জ করতে জাতিসংঘের সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত ট্রাইবু্যনালে যাচ্ছে।
ছয়. ২০১৪ সালের মে মাসে প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জের কাছে চীন একটি ড্রিলিং রিগ বসায়। একে কেন্দ্র করে ভিয়েতনামি এবং চীনা জাহাজগুলোর মধ্যে কয়েক দফা সংঘাত হয়।
সাত. ২০১৯ সালের জুন মাসে ফিলিপাইন অভিযোগ করে, একটি চীনা ট্রলার একটি ফিলিপিনো মাছ ধরা নৌকাকে ধাক্কা দিয়েছে, ওই নৌকায় ২২ জন আরোহী ছিলেন। ভিয়েতনামিরা এসে এই ফিলিপিনোদের উদ্ধার করে।
আট. ২০২৩ সালের শুরুতে ফিলিপাইন অভিযোগ করে, চীনা জাহাজগুলো ফিলিপিনো নৌকাগুলোর দিকে লেজার রশ্মি তাক করছে, যাতে নাবিকদের সাময়িকভাবে অন্ধ করে দেওয়া যায়। ফিলিপাইন আরও অভিযোগ করে, চীনারা তাদের জাহাজগুলো ফিলিপিনোদের জাহাজ বা নৌকার খুব বেশি কাছ দিয়ে বিপদজনকভাবে চালাচ্ছে এবং ফিলিপিনোদের চলার পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে।
বিতর্কে জড়িয়েছে হলিউডও
সমুদ্রসীমা নিয়ে এই বিরোধে হলিউডের অনেক ছবিও জড়িয়ে পড়েছিল। দক্ষিণ চীন সাগরের বিতর্কিত সীমানার দাবিকে ছবিতে দেখানোর কারণে হলিউডের কয়েকটি ছবি এসব দেশে নিষিদ্ধ করা হয়। কিছুদিন আগে ভিয়েতনাম একটি বার্বি চলচ্চিত্র নিষিদ্ধ করেছে। এই চলচ্চিত্রে নাইন-ড্যাশ লাইন দেখানো হয়েছিল।
ফিলিপাইনের সিনেটররাও এই চলচ্চিত্রে মানচিত্রটি দেখানোর সমালোচনা করেছেন। একজন আইনপ্রণেতা বলেন, মানচিত্রটি দেখানোর সময় সেখানে বলা উচিত ছিল যে, 'নাইন ড্যাশ লাইনটি চীনের কল্পিত উদ্ভাবন।'
একইভাবে বিতর্কে জড়িয়েছিল কোরিয়ার পপ সুপার গ্রম্নপ 'বস্ন্যাকপিংক'। গত বছর ভিয়েতনামে তাদের একটি কনসার্টের প্রোমটারের ওয়েবসাইটে এমন একটি মানচিত্র ছিল, যাতে বেইজিংয়ের দাবি করা নাইন ড্যাশ লাইন ছিল। এ ঘটনায় কোরিয়ান পপ গ্রম্নপটি সমালোচনার মুখে পড়ে। তথ্যসূত্র : বিবিসি নিউজ