ফিলিস্তিন সংকট

দখল হয়ে যাচ্ছে পশ্চিম তীর

গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই কিন্তু অধিকৃত পশ্চিম তীরে দ্রম্নত বসতি স্থাপন হচ্ছে। ইসরাইল সরকারে থাকা চরমপন্থিরা অবশ্য 'গর্ব' করে বলে, এই পরিবর্তন স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনে বাধা দেবে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, নিজেদের 'লক্ষ্য' পূরণের জন্য গাজায় যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করতে চাইছে এই চরমপন্থিরা...

প্রকাশ | ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
পশ্চিম তীরে ভূমি দখলের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে
ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলোর মধ্যে একটা হলো ফিলিস্তিনের বাত্তির। সেখানকার জলপাই বাগান এবং আঙুর ক্ষেতের জন্য পরিচিত এই গ্রাম। সেখানে প্রাকৃতিক ঝর্ণার পানি ব্যবহার করা হয় সেচের কাজে। কয়েক শতাব্দী ধরে এভাবেই জীবন বয়ে চলেছে সেখানে। প্রকৃতির কোলঘেঁষা এই গ্রামই অধিকৃত 'ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক' বা পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি স্থাপনের সর্বশেষ 'ফ্ল্যাশপয়েন্টে' পরিণত হয়েছে। ইসরাইল সেখানে একটা নতুন ইহুদি বসতি স্থাপন বা 'সেটেলমেন্ট'-এর অনুমোদন দিয়েছে। এই নতুন বসতির জন্য কেড়ে নেওয়া হয়েছে বহু মানুষের ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জমি। শুধু তাই নয়, অনুমোদন ছাড়াই নতুন ইসরাইলি ফাঁড়িও স্থাপন করা হয়েছে। যাদের ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জমি এই নতুন বসতি স্থাপনের জন্য কেড়ে নেওয়া হয়েছে, তাদের তালিকায় রয়েছে ঘাসান ওলিয়ান। তিনি বলেন, 'নিজেদের স্বপ্ন গড়তে আমাদের জমি চুরি করছে ওরা।' ইউনেস্কো জানিয়েছে, বাত্তিরকে ঘিরে বসতি স্থাপনকারীদের পরিকল্পনা নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন। তবে এই গ্রাম কিন্তু একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী এ জাতীয় 'সেটেলমেন্ট'কে অবৈধ হিসেবে দেখা হয়। যদিও এই বিষয়ে ইসরাইল সহমত পোষণ করে না। আক্ষেপের সুরে ওলিয়েন বলেন, 'ওরা আন্তর্জাতিক আইন, স্থানীয় আইন, এমন কি ঈশ্বরের আইনকেও তোয়াক্কা করে না। গত সপ্তাহে ইসরাইলের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা প্রধান রোনেন বার মন্ত্রীদের উদ্দেশে একটা চিঠি লিখে তাদের সতর্ক করেছিলেন। সেই চিঠিতে বার উলেস্নখ করেছিলেন, পশ্চিম তীরের ইহুদি চরমপন্থিরা ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে 'সন্ত্রাসী' কাজ চালাচ্ছে এবং দেশের 'অবর্ণনীয় ক্ষতি' করছে। গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই কিন্তু অধিকৃত পশ্চিম তীরে দ্রম্নত বসতি স্থাপন হচ্ছে। ইসরাইল সরকারে থাকা চরমপন্থিরা অবশ্য 'গর্ব' করে বলে, এই পরিবর্তন স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনে বাধা দেবে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, নিজেদের 'লক্ষ্য' পূরণের জন্য গাজায় যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করতে চাইছে এই চরমপন্থিরা। বসতি স্থাপনের বিষয়ে পর্যবেক্ষণকারী ইসরাইলি সংস্থা 'পিস নাও'-এর ইয়োনাতান মিজরাহি বলেন, 'ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের চরমপন্থি ইহুদিরা এরই মধ্যে উত্তেজনাপূর্ণ ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতিকে আরও বাড়িয়ে তুলছে এবং ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতের অবসান ঘটানোর বিষয়টাকেও কঠিন করেছে।' তার মতে, ৭ অক্টোবরের হামলার পর ইসরাইলি সমাজে 'ক্রোধ ও ভয়ের মিশ্রণ' রয়েছে। ওই হামলার পর থেকে জমি দখল করে বসতি স্থাপনের ক্ষেত্রে 'গতি এসেছে' বলেও জানিয়েছেন তিনি। তার কারণ, যারা জমি দখল করছেন, তাদের প্রশ্ন করার কেউ নেই। 'পিউ রিসার্চ সেন্টার'র জুন মাসের একটা সমীক্ষা বলছে, ইসরাইলের ৪০ শতাংশ মানুষ বিশ্বাস করেন, এই বসতি স্থাপন তাদের দেশকে নিরাপদ করেছে। ২০১৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ২৭ শতাংশ। অন্যদিকে, জুন মাসের ওই জরিপে অংশ নেওয়া ৩৫ শতাংশ মানুষ আবার মনে করেন, বসতি স্থাপনের কারণে ইসরাইলের নিরাপত্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আগের জরিপে ওই পরিসংখ্যান ছিল ৪২ শতাংশ। মিজরাহি উদ্বেগ প্রকাশ করে জানিয়েছেন, 'পশ্চিম তীরের ইহুদি চরমপন্থিরা পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে। একই সঙ্গে ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতের অবসান ঘটানোর বিষয়টাকেও আগের চেয়ে কঠিন করে তুলছে। আমি মনে করি এটা অত্যন্ত বিপজ্জনক। এতে উভয় পক্ষের মধ্যে ঘৃণা বাড়ছে।' এই জাতীয় ঘটনার বৃদ্ধি আগেই দেখা গিয়েছিল। কিন্তু গত ১০ মাসে এমন এক হাজার ২৭০টি হামলার ঘটনা নথিভুক্ত করেছে জাতিসংঘ। ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল ৮৫৬। ইসরাইলি মানবাধিকার সংস্থা বেটসেলেমের তথ্য অনুযায়ী, একই সময়ে ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারীদের কারণে অন্তত পশ্চিম তীরের ১৮টা গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন ফিলিস্তিনিরা। ইসরাইল ও জর্ডনের মধ্যবর্তী এই ফিলিস্তিনি অঞ্চল ১৯৬৭ সালের মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের সময় দখল করেছিল ইসরাইল। তখন থেকে এই অংশ তাদের দখলেই রয়েছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে চলতি বছরের আগস্ট মাসের মধ্যে ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে ৫৮৯ জন ফিলিস্তিনির মৃতু্য হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ৫৭০ জনের মৃতু্য হয়েছে ইসরাইলির বাহিনীর হাতে এবং অন্তত ১১ জনের মৃতু্য হয়েছে বসতি স্থাপনকারীদের হাতে। জাতিসংঘের মতে, এদের মধ্যে অনেকে হামলার পরিকল্পনা করছিল বলে জানা গেছে, আবার এই তালিকায় নিরস্ত্র বেসামরিক লোকজনও রয়েছেন। আবার অন্যদিকে, ওই একই সময়ে ফিলিস্তিনিরা পাঁচজন 'সেটলার' বা বসতি স্থাপনকারী ও ইসরাইলি নিরাপত্তা বাহিনীর ৯ সদস্যকে হত্যা করেছে। চলতি সপ্তাহে বেথেলহেমের কাছে ওয়াদি আল-রাহেলে বসতি স্থাপনকারী ও ইসরাইলি সেনারা প্রবেশ করে। সেখানে ৪০ বছরের এক ফিলিস্তিনিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ইসরাইলি সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, এর আগেও কাছাকাছি থাকা একটা ইসরাইলি গাড়ি লক্ষ্য করে পাথর ছোড়া হয়েছিল। গত মাসে জিত গ্রামে জায়গা দখলের উদ্দেশে ঢুকে পড়া কয়েক ডজন লোক তান্ডব চালালে ২২ বছরের এক ফিলিস্তিনির মৃতু্য হয়। এই ঘটনায় আন্তর্জাতিক স্তরে নিন্দা করা হয়। ইসরাইলি নিরাপত্তা বাহিনী এই ঘটনায় চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের পক্ষ থেকে একে 'মারাত্মক সন্ত্রাসী ঘটনা' হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু এই পদক্ষেপ 'দায়মুক্ত' করার জন্য বলেই মনে করে মানবাধিকার সংগঠনগুলো। ইসরাইলি নাগরিক অধিকার গোষ্ঠী 'ইয়েশ দিন'-এর তথ্য বলছে ২০০৫ থেকে ২০২৩ সালে বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতার ঘটনার আনুষ্ঠানিক তদন্তের পর মাত্র তিন শতাংশ দোষী সাব্যস্ত হয়েছে। ইসরাইলি গণমাধ্যমে ফাঁস হওয়া রোনেন বারের চিঠিতে উলেস্নখ করা হয়েছিল 'লঘু আইনি পদক্ষেপই' চরমপন্থি দখলদারদের 'উৎসাহ' দিয়েছিল। 'অত্যন্ত বিপজ্জনক' পশ্চিম তীরের কিছু অংশে একচেটিয়াভাবে প্রতিষ্ঠিত ইহুদি সম্প্রদায়ের মাঝেই বাস করছে এই নতুন বসতি স্থাপনকারীরা। এর মধ্যে অনেক বসতিতেই ইসরাইলি সরকারের আইনি সমর্থন রয়েছে। অন্য বসতি যা 'আউট পোস্ট' বা ফাঁড়ি হিসেবে পরিচিত সেগুলো বেশিরভাগই কাফেলা এবং লোহার তৈরি ছাউনির মতো সাধারণ। এগুলো কিন্তু ইসরাইলের আইনের চোখেও অবৈধ। কিন্তু চরমপন্থিরা আরও বেশি জমি দখল করার উদ্দেশ্য নিয়ে এগুলো তৈরি করে। গত জুলাই মাসে, যখন জাতিসংঘের শীর্ষ আদালত প্রথমবার জানতে পারে পূর্ব জেরুজালেমসহ পশ্চিম তীরে ইসরাইলের দখল অবৈধ, তখন ওই দেশকে বসতি স্থাপন সংক্রান্ত সব কার্যকলাপ বন্ধ এবং যত দ্রম্নত সম্ভব সেনা প্রত্যাহার করতে কথা বলা হয়। ইসরাইলের পশ্চিমা মিত্ররা কিন্তু বারবার এই বসতি স্থাপনকে শান্তি আনার পথে অন্তরায় বলে আখ্যা দিয়ে এসেছে। ইসরাইল অবশ্য এই নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করে জানিয়ে দেয়, 'ইহুদিরা তাদের নিজেদের জমিতে কোনোভাবেই দখলদার নয়।' এখন আশঙ্কা করা হচ্ছে, পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপনের এই পদক্ষেপকে যাতে কোনোভাবেই বন্ধ না করা যায়, তা নিশ্চিত করতে কাজ করছে চরমপন্থিরা। ইসরাইলের ইতিহাসে সবচেয়ে উগ্র ডানপন্থি সরকারের সমর্থন পেয়ে ওই অঞ্চলে দ্রম্নত তাদের নিয়ন্ত্রণ বিস্তার করেছে। পশ্চিম তীরে সংযুক্তির পরিকল্পনাকে আরও মজবুত করছে এই চরমপন্থিরা। শুধু তাই নয়, যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে গাজায় বসতি স্থাপনের জন্য প্রকাশ্যে আহ্বানও জানাচ্ছে। নতুন বসতি স্থাপনকারীদের অনেকেই এখন ইসরাইল সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে কর্মরত। একদিকে পশ্চিম তীরে এই বসতি স্থাপনের বিরোধিতাকারী বিশ্বনেতারা দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের জন্য নতুন করে উৎসাহ দিচ্ছেন, শান্তি আনার ক্ষেত্রে ইতিবাচক পদক্ষেপের কথা বলছেন। আর অন্যদিকে, ইসরাইলের জাতীয়তাবাদীরা যারা বিশ্বাস করে, এই পুরো জমি তাদের (ইসরাইলের) মালিকানাধীন, তারা স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বপ্নকে 'অসম্ভব' করে তুলতে সচেষ্ট। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এ কারণেই কিছু রাজনীতিবিদ যুদ্ধবিরতি চুক্তি মানতে নারাজ। 'টাইমস অফ ইসরাইল'-এর রাজনৈতিক সংবাদদাতা টাল স্নাইডার বলেন, 'তারা সংঘাতের অবসান ঘটাতে চায় না বা জিম্মি চুক্তিতে যেতে চায় না, কারণ তারা বিশ্বাস করে- ইসরাইলের লড়াই চালিয়ে যাওয়া উচিত যতক্ষণ না তারা গাজার ভেতরে থাকতে পারে। তারা দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা পোষণ করেন এবং মনে করে তাদের মতাদর্শ বেশি ন্যায়সঙ্গত। এটা অবশ্য তাদের নিজস্ব যুক্তি।' এরই মধ্যে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ পাঁচটা নতুন বসতির পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে। এই তালিকায় রয়েছে বাত্তিরের বসতি এবং রাষ্ট্রের জন্য কমপক্ষে ২৩ বর্গকিলোমিটার ক্ষেত্র। এর অর্থ হলো- ইসরাইল এই জমিকে তাদের নিজেদের বলে মনে করে, তা সে অধিকৃত ফিলিস্তিনি অঞ্চলেই হোক বা ফিলিস্তিনিদের ব্যক্তিগত মালিকানাধীন হোক কিংবা দুটোই। স্থলভাগে তথ্য পরিবর্তন করে এই দখলদাররা বিপুলসংখ্যক ইসরাইলিকে ওই জমিতে স্থানান্তর করতে চায় যাতে তাদের উপস্থিতির জানান দেওয়া যেতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদে এই ভূখন্ডকে আনুষ্ঠানিকভাবে তারা দখল করবে। তথ্যসূত্র : বিবিসি নিউজ