রাওয়ালপিন্ডির আদিয়ালা কারাগারে আটক পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) প্রতিষ্ঠাতা ইমরান খান এক নতুন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে যাচ্ছেন। তবে এই নির্বাচন কোনো রাজনৈতিক পদের জন্য নয়, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর বা আচার্য পদের জন্য।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য (চ্যান্সেলর) পদের নির্বাচনের জন্য প্রার্থী হিসেবে আবেদন করেছেন তিনি। ইমরান যে এই পদের নির্বাচনে অংশ নিতে চলেছেন, সে নিয়ে গুঞ্জন অনেক আগে থেকেই শোনা গিয়েছিল। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে ওই পদের জন্য আবেদনের নির্ধারিত সময়সীমার শেষ দিন (১৮ আগস্ট) প্রার্থী হিসেবে ইমরান খানের আবেদন জমা দেওয়া হয়।
ইমরান খানের উপদেষ্টা জুলফি বুখারি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম 'এক্সে' বিষয়টি সম্পর্কে ঘোষণা দিয়েছেন। জুলফি বুখারি লিখেছিলেন, 'ইমরান খানের নির্দেশনা অনুযায়ী অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য পদে নির্বাচনের জন্য তার (ইমরান খানের) আবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। এই ঐতিহাসিক অভিযানে আপনাদের সমর্থন চাই।' জুলফি বুখারি বলেন, 'ইমরান খান কেন ওই নির্বাচনে অংশ নেবেন না? এটি অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ একটি পদ। ??তিনি অতীতে ব্র্যাডফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ছিলেন এবং তিনি অত্যন্ত সততার সঙ্গে সেই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। তাই তিনিই এই পদের (অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য) জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি।'
প্রসঙ্গত, অনাস্থা ভোটে ক্ষমতাচু্যত হওয়ার পর গত বছর গ্রেপ্তার হন সাবেক ক্রিকেট তারকা ইমরান খান। তারপর থেকে কারাগারে রয়েছেন তিনি ও তার স্ত্রী বুশরা বিবি। আচার্য পদের জন্য নির্বাচিত হলে বর্তমান পরিস্থিতিতে কীভাবে তিনি এই দায়িত্ব পালন করবেন, সে বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে জুলফি বুখারি বলেন, 'তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা শেষ হয়ে আসছে। আচার্য পদের নির্বাচনে জয়ী হলে ডিসেম্বরের মধ্যে তিনি সশরীরে দায়িত্ব পালন করবেন ইনশালস্নাহ।'
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য পদে আবেদন করার এই সিদ্ধান্তের পেছনে ইমরান খানের কী উদ্দেশ্য রয়েছে, সে সম্পর্কে তার দল পিটিআইর পক্ষ থেকে কিছু জানানো হয়নি। তবে বিশ্লেষকদের মতে, এই পদে ইমরান খান নির্বাচিত হলে তা বেশ উলেস্নখযোগ্য বিষয় হবে। একই সঙ্গে এর প্রভাব পড়বে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক স্তরেও।
এখন এই সিদ্ধান্তের পেছনে ইমরান খানের ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য কী থাকতে পারে এবং তিনি নির্বাচিত হলে তার রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রভাব কী হবে, এগুলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কিন্তু তার আগে জেনে নেওয়া যাক অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য পদে কীভাবে নিয়োগ করা হয়।
অক্সফোর্ডের চ্যান্সেলর নির্বাচিত হন কীভাবে?
আচার্য পদের জন্য নির্বাচিত প্রার্থীদের ১০ বছরের জন্য নিয়োগ করা হয়। প্রসঙ্গত, এটি একটি 'সেরেমনিয়াল' বা আনুষ্ঠানিক পদ। আচার্যদের ভাতা বা বেতন দেওয়া হয় না। কোনো রকম প্রশাসনিক দায়িত্ব না থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর বা উপাচার্য পদে নিযুক্তি, গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করা, তহবিল সংগ্রহ এবং স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিত্ব করার ক্ষেত্রে চ্যান্সেলরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এক অর্থে আচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রদূত। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, অক্সফোর্ড চ্যান্সেলরের জন্য যুক্তরাজ্যে বসবাস করা জরুরি নয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে ভ্রমণ ভাতা দেওয়া হয়, এমন সব গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে আচার্যকে উপস্থিত থাকতে হবে।
ওই পদে নির্বাচনের জন্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাউন্সিল একটি 'চ্যান্সেলর নির্বাচন কমিটি' তৈরি করে। নিয়ম অনুযায়ী যার কাজ নির্বাচনি প্রক্রিয়া পরিচালনা ও তদারকি করা। কিন্তু এই কমিটি কোনোভাবেই নির্বাচনের প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে না।
নির্বাচনের ভোটিং পদ্ধতিতে সাম্প্রতিক সংশোধনীর পরই এই প্রক্রিয়ায় ইমরান খানের পক্ষে অংশগ্রহণ করা সম্ভব হয়েছে। সংশোধনী অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী এবং বর্তমান ও সাবেক কর্মী সদস্যরা এখন থেকে অনলাইনে ভোট দিতে পারবেন।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী সারা বিশ্বে আড়াই লাখের বেশি যোগ্য ভোটার এখন চ্যান্সেলর নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। আগামী অক্টোবর মাসে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করা হবে এবং ২৮ অক্টোবর থেকে ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু হবে। কিন্তু আচার্য পদের জন্য আবেদনকারী প্রার্থীর সংখ্যা যদি ১০ জনের কম হয়, তাহলে শুধু এক দফায় নির্বাচন হবে। অন্যদিকে, নির্বাচনে প্রার্থীদের সংখ্যা বেশি হলে ১৮ নভেম্বর থেকে দ্বিতীয় দফার নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হবে। এক্ষেত্রে আরও একটি উলেস্নখযোগ্য বিষয় হলো, ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী, সেখানে কর্মরত ব্যক্তি বা কোনো রাজনৈতিক পদের প্রার্থীরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না।
আচার্য ক্রিস্টোফার ফ্রান্সিস প্যাটেন, যিনি ২০০৩ সাল থেকে এই পদে ছিলেন। গত ৩১ জুলাই পদত্যাগ করেছেন। ৮০ বছর বয়সি ক্রিস্টোফার ফ্রান্সিস প্যাটেন হংকংয়ের শেষ গভর্নর ছিলেন এবং এর আগে যুক্তরাজ্যের কনজারভেটিভ পার্টির চেয়ারম্যানও ছিলেন।
ইমরান খানের জন্য এই নির্বাচন কেন গুরুত্বপূর্ণ?
ইমরান খানের সমর্থকরা মনে করেন, তার অভিজ্ঞতা, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে দীর্ঘ সম্পর্ক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জনকল্যাণমূলক কাজ এবং ক্রিকেটবিশ্বে খ্যাতি পাকিস্তানের এই সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে আচার্য পদের জন্য শক্তিশালী প্রার্থী করে তুলেছে।
এর আগেও একটি ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ছিলেন ইমরান খান। পাকিস্তানের রাজনৈতিক বিরোধ নিয়ে লেখা 'পলিটিক্যাল কনফ্লিক্ট ইন পাকিস্তান' বইয়ের লেখক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ওয়াসিম জানিয়েছেন, অক্সফোর্ডের আচার্য পদের জন্য মূলত এমন ব্যক্তিদের বিবেচনা করা হয়, যাদের বিপুল খ্যাতি রয়েছে। ড. ওয়াসিমের মতে, এর আগেও এই পদে তার নিযুক্তির জন্য দুই থেকে তিনবার চেষ্টা করা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে যদি ইমরান খান অক্সফোর্ডের মতো একটি নামি বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হন, তাহলে তার প্রতি অনেক সহানুভূতি তৈরি হবে।
তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, ইমরান খান যদি আচার্য পদে নির্বাচিত হন, তাহলে যে কোনো সরকারের পক্ষ থেকে তাকে কোনোভাবে বাধা দেওয়া 'ব্রিটিশবিরোধী পদক্ষেপ' হিসেবে বিবেচিত হবে। এর পাশাপাশি অন্য একটি বিষয়ও উলেস্নখ করেছেন ড. ওয়াসিম। তার মতে, সম্মানজনকভাবে দেশ ছাড়ার জন্যও এটি ইমরান খানের কাছে একটি ভালো সুযোগ।
কূটনৈতিক দিক
পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শামশাদ আহমেদ খান বলেন, পাকিস্তান সরকার যদি নির্বাচনের পরও ইমরান খানের পথ আটকানোর চেষ্টা করে এবং তাকে বাইরে যেতে না দেয়, তাহলে তা কূটনৈতিক জটিলতা তৈরি করতে পারে। তবে এ বিষয়ে তার সঙ্গে সহমত পোষণ করেন না ড. ওয়াসিম। তার মতে, পাকিস্তান ও যুক্তরাজ্য কখনোই একে-অপরের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে তাদের কূটনৈতিক সম্পর্ককে প্রভাবিত হতে দেবে না। তার মতে, এর আগেও ইমরান খানের মুক্তির বিষয়ে আমেরিকা ও যুক্তরাজ্যে প্রস্তাব পাস হয়েছে। কিন্তু তাতে কূটনৈতিক সম্পর্কে কোনো প্রভাব পড়েনি।
ড. ওয়াসিম এ বিষয়ে একমত, যুক্তরাজ্যে ইমরান খানের বেশ খ্যাতি রয়েছে এবং তিনি আচার্য পদের নির্বাচনে একজন গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থী হিসেবে বিবেচিত। পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত আবদুল বাসিত বলেন, ইমরান খান যদি অক্সফোর্ডের আচার্য হন, তাহলে তার পক্ষে এই ভূমিকায় কাজ চালিয়ে যাওয়া সহজ হবে না। এর কারণ তিনি বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন এবং তাকে একাধিক মামলার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। তিনি বলেন, যুক্তরাজ্য কোনো রাজনৈতিক নেতার কারণে কূটনৈতিক সম্পর্ককে প্রভাবিত হতে দেয় না। তার মতে, সুশীল সমাজ বা জনসাধারণের স্তরে ইমরান খানের পক্ষে দাঁড়ানো একেবারে ভিন্ন বিষয়।
আবদুল বাসিতের মতে, আমেরিকা ও যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সরকার ইমরান খানের গ্রেপ্তার ও তার বিচারের দিকে তেমন নজর দেয়নি। তিনি বলেছেন, ইমরান খানের মূল উদ্দেশ্যও মনে হয় তিনি এভাবে রাজনৈতিক স্কোরিং করতে চান। সবাইকে বলতে চান, কারাগারে থাকার পরও তিনি এত জনপ্রিয় যে, বিশ্বের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে আচার্য হিসেবে বেছে নিয়েছে। অন্য একটি দিকও উলেস্নখ করেছেন তিনি। বাসিত বলেন, এ বিষয়টিও দেখতে হবে, অক্সফোর্ডের নিয়ম অনুযায়ী একজন সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি সেখানকার আচার্য হতে পারেন কি-না, সে বিষয়ে ওই বিশ্ববিদ্যালয় কী বলছে? তবে এই সাজা ঠিক না ভুল সেটা একেবারে ভিন্ন তর্ক। তথ্যসূত্র : বিবিসি নিউজ