'আমাদের বাড়িটা এলাকার সব থেকে উঁচু জায়গায়। তাই পড়শিরা সবাই আমাদের বাড়িতেই আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু আমাদের বাড়িতেও যে পানি ঢুকে যাবে, এটা কেউ ভাবতেও পারিনি।' ভারতের ত্রিপুরার বন্যা পরিস্থিতি এভাবে বর্ণনা করেন ত্রিপুরার উদয়পুর শহরের সাংবাদিক আয়ুব সরকার। আয়ুব জানান, গত তিনদিন ধরে পুরোপুরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছিলেন তিনি। শুক্রবার সকালে ব্যাটারি দিয়ে চার্জ করে মোবাইল ফোন চালু করার পর কথাগুলো বলছিলেন।
সাম্প্রতিক বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যেসব এলাকা, তার মধ্যে অন্যতম গোমতী জেলা। তারই জেলা সদর শহর উদয়পুর। সরকারি তথ্য অনুযায়ী গত কয়েকদিনের বন্যায় পুরো রাজ্যে শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত সরকারিভাবে ২৪ জনের মৃতু্য হয়েছে, নিখোঁজ রয়েছেন দুইজন।
আয়ুব সরকার বলেন, 'বৃহস্পতিবার বিকাল ৩টা পর্যন্ত লাগাতার ৩৮ ঘণ্টা বৃষ্টি হয়েছে এখানে। সেই পানি তো ছিলই। তারপরে ডম্বুর ড্যামের পানি ঢুকতে শুরু করে। আবার জেলার কিছু অংশে মিজোরামের দিক থেকেও পনি চলে এসেছিল। সব মিলিয়ে যে অবস্থা, তা ভয়াবহ। মাত্র দুই ঘণ্টার মধ্যে আমাদের ঘরে চার ফুট পানি জমে গিয়েছিল। রাতে বাধ্য হয়েই সবাইকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে হয়। নানা সময়ে আমিই এগিয়ে যেতাম মানুষজনকে রেসকিউ করতে, এবার আমি নিজেই ভিক্টিম।'
ত্রিপুরায় সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা তারা দেখেছেন ১৯৮৩ সালে। তবে চলতি বছরের বন্যা তাকেও ছাড়িয়ে গেছে। ১০ বছর পরে ১৯৯৩ সালেও বন্যা হয়েছিল। তিনি বলেন, 'কোথাও শুধু বাড়ির টিনের ছাদ দেখা যাচ্ছে, কারও বাড়ির শুধু দোতলাটা দেখা যাচ্ছে- মানে একতলা পুরো ডুবে গেছে।'
চারদিকে শুধুই পানি
গোমতী জেলারই আরেকটি এলাকা মহারাণী। সেখানকার স্থানীয় সাংবাদিক মোছলেম মিঞা শুক্রবার দুপুরে যা দেখতে পাচ্ছেন, তারই বর্ণনা দিচ্ছিলেন। তিনি বলেন, 'চারদিকে শুধুই পানি, মাঝেমধ্যে কিছু মানুষের ঘরবাড়ি আর গাছপালা দেখা যায়। আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না। মহারাণী এলাকার প্রায় ৯০ ভাগ বাড়িতেই এখন বুকসমান পানি, কারও বাড়িতে ১০ হাত পর্যন্ত পানি। গত তিন দিন ধরে বিদু্যৎ নেই, পানীয় জল নেই। কোথাও কোনো গাড়ি চলার উপায় নেই।'
তার কথায়, 'আমাদের এ অঞ্চলে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের বসবাস, তার ৯৫ শতাংশ মানুষই এখন হয় আশ্রয় শিবিরে রয়েছেন। অনেকে আবার টিলা এলাকার বাড়ি বা অফিস-কাচারিগুলোয় আশ্রয় নিয়েছেন। তারা কবে বাড়ি ফিরতে পারবেন, কেউ জানেন না। অনেকে চেষ্টা করছেন, নৌকা বা ভেলায় চেপে নিজের বাড়ির দিকে যাওয়ার, যাতে একবার চোখের দেখা দেখে আসতে পারেন।'
তিনি বলেন, ওই এলাকা একে তো গোমতী নদীর তীরে, লাগাতার বৃষ্টির কারণে সেই পানি নদীর পাড় উপচে এলাকা ভাসিয়ে দিয়েছে। এর সঙ্গে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরের ডম্বুর বাঁধের পানি ঢুকে এলাকা আরও ডুবিয়েছে। নিজে সাংবাদিক হওয়া সত্ত্বেও প্রথম দুদিনের পর তার পক্ষে পেশাগত কাজ করা আর সম্ভব হয়নি।
মোছলেম মিঞা বলেন, 'কোনোমতে নিজের প্রাণ রক্ষা করতে পেরেছি। তারপর নৌকায় করে বহু মানুষকে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছি। এর মধ্যে আর পেশার দিকে নজর দিতে পারিনি।'
নামতে শুরু করেছে পানি
শুক্রবার সকাল থেকে নতুন করে বৃষ্টি না হওয়ায় ত্রিপুরার অনেক এলাকা থেকেই পানি নেমে যেতে শুরু করেছে বলে জানা যাচ্ছে। তবে গোমতী আর খোয়াই নদী দুটির জলস্তর এখনো বিপৎসীমার ওপর দিয়েই বইছে।
আয়ুব সরকার বলেন, 'এখানে সকাল থেকে পানি নেমে যাচ্ছে। কিন্তু গোমতী নদীর ধারে সোনামুড়া শহরের দিকে রাত থেকে পানি বাড়ছে বলে খবর পেয়েছি। সেখানে বৃহস্পতিবার রাতেও কথা বলতে পেরেছিলাম, কিন্তু শুক্রবার সকাল থেকে আর কোনো যোগাযোগ করতে পারছি না।'
আবহাওয়া দপ্তরের পূর্বাভাস
রাজ্যের অনেক এলাকা থেকে পানি নামতে শুরু করলেও ভারতের আবহাওয়া দপ্তর (আইএমডি) ত্রিপুরার চারটি জেলায় আগামী তিনদিন অতিভারী বৃষ্টিপাত হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছিল সকালবেলা থেকে। তবে দুপুরে নতুন উপগ্রহ চিত্র বিশ্লেষণ করে সতর্কতার মাত্রা কমিয়ে দিয়েছে তারা। এখন বলা হচ্ছে দক্ষিণ ত্রিপুরা জেলার দুটি এলাকায় আগামী দুদিন ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা থাকলেও রাজ্যের অন্যকিছু এলাকায় শুধুই বজ্র-বিদু্যৎসহ বৃষ্টির সম্ভাবনা দেখছে তারা।
পুরো রাজ্যে আগামী দুদিনের জন্য হলুদ সতর্কবার্তা রয়েছে শুক্রবার দুপুর থেকে। তবে রোববার দক্ষিণ জেলার কিছু এলাকায় ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় সেদিন ওই অঞ্চলে লাল সতর্কতা জারি করা হয়েছে। তথ্যসূত্র : বিবিসি নিউজ