বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
সৌদি আরব

এমবিএসের উত্থান যেভাবে

তার একটি নির্দিষ্ট নির্মমতা ছিল। কেউ তাকে অবমূল্যায়ন করেছে, এটি তিনি পছন্দ করেন না। কিন্তু এর মানে এটাও যে, তিনি এমন পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছেন, যা অন্য কোনো সৌদি নেতা করতে পারেননি...
যাযাদি ডেস্ক
  ২৩ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান

সৌদি আরবের ৯০ বছর বয়সি বাদশাহ আবদুলস্নাহ ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে হাসপাতালে মারা যান। তার সৎ ভাই সালমান বাদশাহ হতে চলেছেন এবং সালমানের প্রিয় পুত্র মোহাম্মদ বিন সালমান ক্ষমতার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান কেবল তার আদ্যক্ষর এমবিএস দিয়ে অনেক বেশি পরিচিত। ২৯ বছর বয়সি এই যুবরাজের বড় পরিকল্পনা ছিল, তার রাজ্যের জন্য, যা দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় পরিকল্পনা। কিন্তু তিনি আশঙ্কা করেছিলেন, সৌদি রাজপরিবারের মধ্যকার চক্রান্তকারীরা শেষ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে পারে। তাই ওই মাসের এক মধ্যরাতে, তিনি তার আনুগত্য জয়ের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এক ঊর্ধ্বতন নিরাপত্তা কর্মকর্তাকে প্রাসাদে ডেকে পাঠান।

সাদ আল-জাবরি নামের ওই কর্মকর্তাকে তার মোবাইল ফোন বাইরের টেবিলে রেখে যেতে বলা হয়েছিল। এমবিএসও তাই করেছিলেন। দুজন লোক এখন একা। যুবরাজ প্রাসাদের গুপ্তচরদের এতটাই ভয় পেয়েছিলেন যে, তিনি কক্ষে থাকা একমাত্র ল্যান্ডলাইন টেলিফোনের সংযোগও বিচ্ছিন্ন করেছিলেন।

জাবরির মতে, এমবিএস তখন তাকে বলেছিলেন, কীভাবে তিনি তার রাজ্যকে গভীর ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলবেন, যাতে এটি বিশ্বমঞ্চে তার সঠিক স্থান নিতে পারে। বিশ্বের সবচেয়ে লাভজনক কোম্পানি রাষ্ট্রীয় তেল উৎপাদক 'আরামকো'র একটি অংশ বিক্রি করে তিনি তার অর্থনীতিকে তেলের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে মুক্ত করবেন। তিনি ট্যাক্সি ফার্ম, উবারসহ সিলিকন ভ্যালি টেক স্টার্টআপগুলোতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবেন। এরপর সৌদি নারীদের কর্মশক্তিতে যোগদানের স্বাধীনতা দিয়ে তিনি ছয় লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবেন।

বিস্মিত হয়ে জাবরি তখন যুবরাজকে তার উচ্চাকাঙ্ক্ষার পরিধি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। এমবিএসের সহজ উত্তর ছিল, 'আপনি কি আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের কথা শুনেছেন?' সেখানেই কথোপকথন শেষ করেন এমবিএস। আধাঘণ্টার জন্য নির্ধারিত মধ্যরাতের সেই বৈঠক শেষ হয়েছিল তিন ঘণ্টা পর। দীর্ঘসময় ধরে খোঁজ না পাওয়ায় জাবরির সরকারি সহকর্মীরা চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। মোবাইল ফোনে বেশ কয়েকটি মিস্‌ড কল দেখতে দেখতে জাবরি রুম থেকে বের হয়ে যান।

যার তেলের নিয়ন্ত্রণ প্রত্যেককে প্রভাবিত করে, কীভাবে তিনি যুবরাজ হওয়ার জন্য শত শত প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাজিত করেছিলেন সেই এমবিএসের অসামান্য উত্থানের গল্প নিয়ে একটি বিশেষ প্রতিবেদন করেছে 'বিবিসি'। এক বছর ধরে বিবিসির ডকুমেন্টারি দল সৌদি বন্ধু এবং এমবিএস'র বিরোধীদের পাশাপাশি সিনিয়র পশ্চিমা গুপ্তচর ও কূটনীতিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। সৌদি সরকারকে বিবিসির চলচ্চিত্র এবং এই নিবন্ধে করা দাবির জবাব দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। তারা জবাব না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

সাদ আল-জাবরি সৌদি নিরাপত্তা ব্যবস্থায় এতটাই উচ্চপদস্থ ছিলেন যে, সিআইএ এবং এমআই-সিক্স'র প্রধানদের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব ছিল। অবশ্য সৌদি সরকার জাবরিকে একজন তুচ্ছ সাবেক সরকারি কর্মকর্তা বলে অভিহিত করেছে। তবে তিনি হলেন সবচেয়ে সুপরিচিত সৌদি ভিন্নমতাবলম্বী, যিনি দেশটির যুবরাজ কীভাবে শাসন করেন, সে সম্পর্কে কথা বলার সাহস করেছেন। তিনি বিবিসিকে যে বিরল সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তার বিশদ বিবরণ আশ্চর্যজনক।

যুবরাজকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন, এমন অনেকের কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার মাধ্যমে বিবিসি সেই ঘটনাগুলোর ওপর নতুন করে আলোকপাত করেছে, যা এমবিএসকে কুখ্যাত করে তুলেছে। এসব ঘটনার মধ্যে ২০১৮ সালে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে হত্যা এবং ইয়েমেনে একটি বিধ্বংসী যুদ্ধ শুরু করার মতো বিষয়গুলো রয়েছে।

তার বাবা ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ায় ৩৮ বছর বয়সি এমবিএস এখন বিশ্বের বৃহত্তম তেল রপ্তানিকারক দেশটির দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি সাদ আল-জাবরির কাছে বর্ণনা করা অনেক যুগান্তকারী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে শুরু করেছেন। পাশাপাশি বাকস্বাধীনতা দমন, মৃতু্যদন্ডের ব্যাপক ব্যবহার এবং নারী অধিকার কর্মীদের জেলে পাঠানোসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন।

একটি অশুভ যাত্রা

সৌদি আরবের প্রথম বাদশাহ এমবিএসের পিতা সালমানসহ কমপক্ষে ৪২ পুত্রের জন্ম দিয়েছিলেন। ঐতিহ্যগতভাবে এই ছেলেদের মধ্যে একজনকে মুকুট দেওয়া হয়েছে। ২০১১ ও ২০১২ সালে তাদের দুজন হঠাৎ মারা গেলে সালমানকে উত্তরাধিকারের সারিতে উন্নীত করা হয়েছিল। সৌদি আরবের পরবর্তী বাদশাহ কে হবেন, তা পশ্চিমা গুপ্তচর সংস্থাগুলো খোঁজখবর রাখত এবং গবেষণা করত। এই পর্যায়ে, এমবিএস এত তরুণ এবং অজানা ছিলেন যে, গোয়েন্দাদের নজরেই পড়েননি তিনি।

২০১৪ সাল পর্যন্ত এমআই-সিক্স'র প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা স্যার জন সাওয়ারস বলেছেন, 'তিনি আপেক্ষিক অস্পষ্টতার মধ্যে বড় হয়েছেন। তাকে ক্ষমতায় ওঠার জন্য নির্দিষ্ট করা হয়নি।'

এমবিএস তার কিশোর বয়সে রিয়াদে সর্বপ্রথম কুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ওই সময় তাকে 'আবু রাসাসা' বা 'বুলেটের পিতা' ডাকনাম দেওয়া হয়েছিল। অভিযোগ রয়েছে, সম্পত্তি নিয়ে এমবিএসের একটি মামলা বাতিল করার পর একজন বিচারকের কাছে বুলেট পাঠিয়েছিলেন এমবিএস।

স্যার জন সাওয়ারস বলেন, 'তার একটি নির্দিষ্ট নির্মমতা ছিল। কেউ তাকে অবমূল্যায়ন করেছে, এটি তিনি পছন্দ করেন না। কিন্তু এর মানে এটাও যে, তিনি এমন পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছেন, যা অন্য কোনো সৌদি নেতা করতে পারেননি।'

স্যার জন সাওয়ারস জানান, বিদেশি মসজিদ এবং ধর্মীয় বিদ্যালয়গুলোতে সৌদি অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছেন এমবিএস। যা ইসলামি জিহাদিবাদের প্রজনন ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে- পশ্চিমের নিরাপত্তার জন্য এটি বিশাল সুবিধা।

সাদ আল-জাবরি জানান, এমবিএস দৃশ্যত তার বাবার বাদশাহ হওয়ার জন্য এতটাই অধৈর্য ছিলেন যে, ২০১৪ সালে তিনি রাশিয়া থেকে পাওয়া একটি বিষযুক্ত আংটি দিয়ে তৎকালীন বাদশাহ আবদুলস্নাহকে হত্যা করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে কিছুটা ইঙ্গিত পেয়ে বাদশাহ আব্দুলস্নাহর সঙ্গে করমর্দন না করার জন্য আদালত থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল এমবিএসকে। শেষ পর্যন্ত ২০১৫ সালে প্রাকৃতিক কারণেই মারা যান বাদশাহ আবদুলস্নাহ। ২০১৫ সালে বাদশাহ হন সালমান এবং তার প্রতিরক্ষামন্ত্রী হন এমবিএস।

ইয়েমেনে যুদ্ধ

দুই মাস পর যুবরাজ হুতি আন্দোলনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে একটি উপসাগরীয় জোটের নেতৃত্ব দেন। যুবরাজ হুতিদের সৌদি আরবের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ইরানের 'প্রক্সি' হিসেবে দেখেছিলেন। এই যুদ্ধে দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে থাকা লাখ লাখ ইয়েমেনিকে একটি মানবিক বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যায়। আমেরিকানদের সঙ্গে যুদ্ধের বিষয়ে আলাপ করলে তারা এর বিপক্ষে মত দিয়েছিলেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন যুবরাজ। জাবরি দাবি করেন, ইয়েমেনে স্থল অভিযান চালাতে জারি করা রাজকীয় ডিক্রিতে তার পিতার স্বাক্ষর জাল করেছিলেন। তিনি বলেন, 'আমরা অবাক হয়েছিলাম যে, স্থলযুদ্ধের অনুমতি দেওয়ার জন্য একটি রাজকীয় ডিক্রি ছিল। তিনি রাজকীয় ডিক্রির জন্য তার বাবার স্বাক্ষর জাল করেছিলেন। ওই সময়টাতে রাজার মানসিক ক্ষমতার অবনতি হচ্ছিল।'

নিজেই নিয়ম তৈরি করেন

২০১৭ সালে এমবিএস একটি বিখ্যাত পেইন্টিং কিনেছিলেন, যা আমাদের অনেক কিছু বলে- তিনি কীভাবে চিন্তা করেন এবং তিনি যে ধর্মীয়ভাবে রক্ষণশীল সমাজ পরিচালনা করেন, তার বাইরে থাকতে ভয় পান না। সর্বোপরি, ক্ষমতার সুস্পষ্ট প্রদর্শনে পশ্চিমকে ছাড়িয়ে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তিনি।

২০১৭ সালে সালভেটর মুন্ডিতে ৪৫ কোটি ডলারে চিত্রকর্মটি কেনা হয়েছিল, যা এখন পর্যন্ত বিক্রি হওয়া বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল শিল্পকর্ম। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির আঁকা এই প্রতিকৃতিতে যিশু খ্রিস্টকে স্বর্গ ও পৃথিবীর কর্তা, বিশ্বের ত্রাণকর্তা হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। নিলামের পর থেকে, এই চিত্রকর্মটি সম্পূর্ণরূপে অদৃশ্য হয়ে গেছে।

যুবরাজের বন্ধু এবং প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির নিয়ার ইস্টার্ন স্টাডিজের অধ্যাপক বার্নার্ড হেইকেল জানান, গুজব রয়েছে পেইন্টিংটি যুবরাজের প্রমোদতরী বা প্রাসাদে ঝুলানো আছে। এটি আসলে জেনেভায় রাখা আছে এবং এমবিএস এটিকে সৌদি আরবের একটি জাদুঘরে রাখতে চান। অথচ এটি এখনো নির্মিত হয়নি।

হেইকেল জানান, 'বিশ্বমানের খেলাধুলায় সৌদি আরব অবিশ্বাস্যভাবে ব্যয় করছে। দেশটি ২০৩৪ সালে ফিফা বিশ্বকাপ আয়োজনের একমাত্র দরদাতা এবং টেনিস ও গল্ফের জন্য টুর্নামেন্টের মঞ্চায়নে বহু মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে- যাকে 'স্পোর্টসওয়াশিং' বলা হয়েছে। কিন্তু আমরা যা পেয়েছি, তা হলো এমন একজন নেতা, যিনি পশ্চিমারা তাকে কী ভাবে, তার চেয়ে তার বিপরীত প্রদর্শনের বিষয়ে কম চিন্তা করেন। নিজেকে এবং সৌদি আরবকে মহান করার নামে তিনি যা খুশি তাই করবেন।'

স্যার জন সাওয়ারস বলেন, 'এমবিএস একজন নেতা হিসেবে তার নিজস্ব ক্ষমতা তৈরি করতে আগ্রহী। তিনি এটি করতে পারেন একমাত্র উপায়ে- তার দেশের ক্ষমতা তৈরি করা। এটাই তাকে চালিত করছে।'

খাশোগি হত্যা

২০১৮ সালে তুরস্কের ইস্তাম্বুলের সৌদি কনসু্যলেটে জামাল খাশোগির হত্যাকান্ড এমবিএসকে এমনভাবে জড়িত করে, যা খন্ডন করা খুব কঠিন। ওই বছর একটি শক্তিশালী 'হিট স্কোয়াড' (খুনির দল) কূটনৈতিক পাসপোর্টে তুরস্কে ভ্রমণ করছিল এবং এতে এমবিএস'র নিজস্ব দেহরক্ষীদের কয়েকজন অন্তর্ভুক্ত ছিল। খাশোগির মৃতদেহ কখনোই পাওয়া যায়নি।

অধ্যাপক হেইকেল হত্যাকান্ডের কিছুদিন পর এমবিএসের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা বিনিময় করেন। তিনি বলেন, 'আমি জিজ্ঞাসা করছিলাম, কীভাবে এটি ঘটতে পারে? আমি মনে করি তিনি বড় ধাক্কা খেয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পারেননি যে, এর প্রতিক্রিয়া এতটা তীব্র হবে।' তথ্যসূত্র : বিবিসি নিউজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে