দলে আস্থা

হামাসের নতুন নেতৃত্ব বাছাইয়ের নেপথ্যে

হামাস শক্তিশালী চরিত্র আবু ওমর হাসানকে তারা বেছে নিতে পারেনি, কারণ তাকে লোকে খুব একটা চেনে না এবং আন্দোলনের বাইরে তার পরিচিতি অজানাই বলা যায়। অন্যদিকে ৭ অক্টোবরের আক্রমণের পর ইয়াহিয়া সিনওয়ার বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পেয়েছেন। সেই কর্মকর্তা বলেন, সিনওয়ার ৭ অক্টোবরের পর থেকে একটি 'ব্র্যান্ড' হয়ে উঠেছেন এবং আরব ও ইসলামী বিশ্বে তার বিপুল জনপ্রিয়তা রয়েছে। ইরানের সমর্থিত 'অ্যাক্সিস অব রেজিস্ট্যান্স'র সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে এবং যুদ্ধের মাঝখানে তার নিয়োগ ইসরাইলের প্রতি একটি প্রতিরোধের বার্তা পাঠায়...

প্রকাশ | ১১ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
হামাসের নতুন নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার
গত সপ্তাহজুড়ে হামাসের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা নতুন নেতৃত্ব বাছাই করতে কাতারে জড়ো হয়েছিলেন। সেদিকেই নজর ছিল বিশ্বের গণমাধ্যমগুলোর। প্রায় এক বছর ধরে গাজায় হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে চলা সংঘর্ষের মাঝেই মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিনিধিরা সেখানে যান। দলের পূর্ববর্তী রাজনৈতিক নেতা ইসমাইল হানিয়া তেহরানে একটি বিস্ফোরণে নিহত হওয়ার খবর তাদের অনেককেই বেশ নাড়া দিয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, ইসরাইল এই হামলা করেছিল। হামাসে ইসমাইল হানিয়ার ভূমিকা ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ইসরাইলের সঙ্গে আলোচনার তত্ত্বাবধানে ছিলেন। নিজ দলের সামরিক শাখার এক অংশের ইসরাইলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আগ্রহ, অন্য অংশের সংঘর্ষের অবসান ঘটানোর দাবির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে চলছিলেন। এটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল যে, তার শূন্যস্থানটি দ্রম্নত পূরণ করতে হবে। দোহার শোক পালনের অনুষ্ঠানে হামাসের নেতারা একটি বড় সাদা তাঁবুর ভেতর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কার্পেটে ঢাকা সেই তাঁবুর ভেতরে ছিল সুন্দর চেয়ার, ভেতরটা সাজানো ছিল ইসমাইল হানিয়ার ছবি দিয়ে। নেতা প্রয়াতের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে শত শত মানুষ সেখানে এসে সমবেত হন। এই দৃশ্যটি শুধু একটি স্মরণসভা ছিল না- এটি ছিল একটি যুগের সমাপ্তি এবং আরও চরমপন্থার দিকে এক নতুন যুগের সূচনা। হামাসের শীর্ষ নেতাদের একটি অপ্রত্যাশিত প্রয়াণের এবং জানাজা-দাফনের পর নতুন নেতা নির্বাচনের জন্য জড়ো হওয়ার দৃশ্য প্রথমবার দেখা গেছে, এমনটা নয়। ২০০৪ সালে, গাজায় তাদের প্রতিষ্ঠাতা শেখ আহমেদ ইয়াসিনকে ইসরাইল হত্যার পর তার বাড়িতে তাদের জড়ো হতে দেখা গিয়েছিল। এর এক মাসের কম সময়ের মধ্যে ইসরাইল তার উত্তরসূরি আবদেল আজিজ আল-রান্তিসিকে হত্যা করে। কিন্তু এবারের পর্দার পেছনের আলোচনায় ছিল সংকটের মাত্রা এবং যে চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে তারা যাচ্ছে। গত বছরের ৭ অক্টোবর হামাস দক্ষিণ ইসরাইলে হামলা চালালে প্রায় এক হাজার ২০০ জন নিহত হয় এবং ২৫১ জনকে গাজায় বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর থেকে হামাস-নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী ইসরাইলের প্রতিশোধে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ নিহত এবং আরও হাজার হাজার আহত হয়েছেন। গাজার অর্ধেকের বেশি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা ধ্বংস হয়ে গেছে এবং প্রায় পুরো জনগোষ্ঠী বাস্তুচু্যত হয়েছে। ২০০৭ সাল থেকে গাজায় হামাসের শাসন চলছে। একদিকে তাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বাড়ছে, অন্যদিকে এই সংঘর্ষে দলটিরও বড় ক্ষতি হয়েছে। এর পাশাপাশি ৩১ জুলাই তেহরানে ইসমাইল হানিয়াকে হত্যা হামাসের জন্য একটি বড় ধাক্কা ছিল। বিশেষ করে তা ইরানে হওয়ায়, যা তাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। হামাসের বিশ্বাস হানিয়াকে একটি 'অ্যান্টি-পার্সোনেল' ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে হত্যা করা হয়েছে, যখন তিনি তার ফোনে ব্রাউজিং করছিলেন। ইরানের বিপস্নবী গার্ড বলেছে, সাত কেজি ওয়ারহেডযুক্ত একটি 'প্রজেক্টাইল' ব্যবহার করা হয়েছিল। কিছু পশ্চিমা মিডিয়ার রিপোর্টে বলা হয়েছে, আগেই ঘরে রাখা একটি বোমা দিয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছিল। দোহায় হানিয়ার শোক অনুষ্ঠানে, ৬০-এর কোঠার একজন সাদা চুল এবং ছোট দাড়িওয়ালা ব্যক্তি সম্মুখভাগ থেকে দূরে একটি কোণায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। এক মিডিয়া কর্মকর্তা বলেন, তাকে ভালোভাবে লক্ষ্য করুন, তিনি কে? তিনি হলেন ছায়ামানব, আবু ওমর হাসান। আবু ওমর হাসান বা মোহাম্মদ হাসান দারউইশ, সুপ্রিম শুরা কাউন্সিলের প্রধান। এই কাউন্সিল হামাসের শীর্ষ পরামর্শক সংস্থা। হামাসের সংবিধান অনুযায়ী, তিনি সংগঠনের অন্তর্র্বর্তীকালীন প্রধান হওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে ছিলেন, যতক্ষণ না পর্যন্ত পরবর্তী মার্চে নির্বাচন হওয়ার কথা। তিনি বড় বড় মিশনের মানুষ। শোক অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই নেতাদের আসল কাজ শুরু হলো। দুই দিন ধরে, হামাসের অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা এবং ছায়ামানবরা দোহায় একজন নতুন নেতা নির্বাচনের জন্য বৈঠক করলেন, যেখানে ২০১২ সাল থেকে হামাসের রাজনৈতিক বু্যরো ছিল। তারা ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে বেছে নিলেন, যিনি ২০১৭ সাল থেকে গাজার ভেতরে দলের নেতা ছিলেন। এই সিদ্ধান্তটি অনেকের কাছে অপ্রত্যাশিত হতে পারে, কিন্তু যারা ২০১১ সাল থেকে তার ক্যারিয়ারের দিকে লক্ষ্য রেখেছেন তারা জানতেন, তিনি একদিন হামাসের নেতা হবেন। তিনি ইসরাইলে বন্দি ছিলেন এবং ২০১১ সালে ইসরাইলি সেনা গিলাত শালিতের বিনিময়ে তাকে মুক্ত করা হয়। হামাসের কোনো রাজনৈতিক নেতা কখনো দলের সামরিক শাখার এত কাছাকাছি ছিলেন না। হামাসের বৃহত্তম সামরিক ব্যাটালিয়নের নেতৃত্ব দেন তার ভাই মোহাম্মদ। আর দুই দশক ধরে হামাসের সামরিক শাখার নেতৃত্ব দেওয়া মোহাম্মদ দেইফ ছিলেন তার প্রতিবেশী, বন্ধু, এবং সহপাঠী। তারা দুজনেই গাজার খানের ইউনিস শরণার্থী শিবিরে বড় হয়েছেন। গত মাসে ইসরাইল মোহাম্মদ দেইফকে ইসরাইল হত্যা করেছে বলে ঘোষণা করে। এরপরও অনেকের কাছে তাকে হামাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে নিয়োগ দেওয়া পাগলামি মনে হতে পারে। ইসরাইলের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো বিশ্বাস করে যে, তিনি দক্ষিণ ইসরাইলে হামলার পরিকল্পনা করেছিলেন এবং তা কার্যকর করেছিলেন। একইসঙ্গে তিনি ইসরাইলের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় আছেন। হামাসের এক জ্যেষ্ঠ দায়িত্বশীল নেতা জানান, হামাস নেতৃত্বের সবাই এই সিদ্ধান্তের পক্ষে ছিলেন না। কিছু নেতা তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, অন্যরা আরও মধ্যপন্থি ব্যক্তির পক্ষে চাপ দিয়েছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি বেশিরভাগ ভোট পেয়েছেন। আরেকজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি, যিনি বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি বলেন, হামাস শক্তিশালী চরিত্র আবু ওমর হাসানকে তারা বেছে নিতে পারেনি, কারণ তাকে লোকে খুব একটা চেনে না এবং আন্দোলনের বাইরে তার পরিচিতি অজানাই বলা যায়। অন্যদিকে ৭ অক্টোবরের আক্রমণের পর ইয়াহিয়া সিনওয়ার বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পেয়েছেন। সেই কর্মকর্তা বলেন, সিনওয়ার ৭ অক্টোবরের পর থেকে একটি 'ব্র্যান্ড' হয়ে উঠেছেন এবং আরব ও ইসলামী বিশ্বে তার বিপুল জনপ্রিয়তা রয়েছে। ইরানের সমর্থিত 'অ্যাক্সিস অব রেজিস্ট্যান্স'র সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে এবং যুদ্ধের মাঝখানে তার নিয়োগ ইসরাইলের প্রতি একটি প্রতিরোধের বার্তা পাঠায়। 'অ্যাক্সিস অব রেজিস্ট্যান্স' হলো ইরান সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর একটি নেটওয়ার্ক। লেবানন-ভিত্তিক হিজবুলস্নাহর মতো অন্য সদস্যদেরও এর অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যারা ইসরাইলের জন্য হুমকি সৃষ্টি করে। গত ৭ অক্টোবরের আক্রমণের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণে সিনওয়ারকে নেতা হিসেবে নিয়োগ না করার জন্য অনেক আরব এবং কিছু পশ্চিমা কর্মকর্তা হামাসকে অনুরোধ করেছিল। তিনি এবং এখন তার নেতৃত্বাধীন সংস্থাকে অনেক পশ্চিমা সরকার 'সন্ত্রাসী' হিসেবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। ওই কর্মকর্তা বলেন, 'আমাদের ভোট দেওয়ার একটি কারণ হলো, আমরা তাকে আক্রমণের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে সম্মান জানাতে চাই। ৭ অক্টোবর তার অবদান, তাই তিনি আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্য।' সেই হামলার ১০ মাস পরও কোনো যুদ্ধবিরতির প্রচেষ্টা এখন পর্যন্ত সফল হয়নি। মধ্যস্থতাকারী দেশ কাতার ও মিসর নতুন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের ওপর কাজ করছেন। যেটুকু তথ্য ফাঁস হয়েছে, তা থেকে বোঝা যায়, পরিকল্পনা হচ্ছে যে- ইরান যেন নিজ ভূখন্ডে হানিয়াকে হত্যার জবাব সামরিকভাবে না দেয়, বিনিময়ে যেন ইসরাইল গাজায় যুদ্ধ বন্ধ করে, ফিলাডেলফি করিডোর থেকে সেনা প্রত্যাহার করতে তাদের রাজি করানো যায়। ফিলাডেলফি করিডর হলো- গাজার মিসর সংলগ্ন একটি বাফার জোন বা মধ্যবর্তী অংশ। মিসরের সীমান্তের সঙ্গে গাজা অংশে এটি ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ, কিছু অংশে এটি প্রায় ১০০ মিটার প্রশস্ত। এর বাইরে ইসরাইলের ছাড়া গাজার অন্য কোনো দেশের সঙ্গে সীমান্ত নেই। একজন ফিলিস্তিনি কর্মকর্তা, যিনি দোহায় যুদ্ধবিরতির আলোচনার বিষয়ে অবগত, তিনি বলেন, 'মিসরীয় গোয়েন্দারা এরই মধ্যে দোহায় একটি দল পাঠিয়েছে এবং ইরানের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া থেকে অঞ্চলটিকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করার জন্য বৈঠক হচ্ছে... বিনিময়ে থাকবে যুদ্ধবিরতি।' এই মুহূর্তে, সংঘর্ষের দামামা ক্রমশ বাড়ছে, কারণ হামাসের সবচেয়ে চরমপন্থি ব্যক্তিত্ব সিনওয়ার আগামী পাঁচ বছরের জন্য দলটির নেতৃত্ব দিতে যাচ্ছেন- যদি তিনি এই যুদ্ধ থেকে বেঁচে থাকতে পারেন। তথ্যসূত্র : বিবিসি নিউজ