স্বাধীনতাকমী সশস্ত্র ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়াকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছে, তার উত্তর খোঁজা হচ্ছে। প্রাথমিক তদন্ত ইঙ্গিত করছে যে, তেহরানের যে বাড়িতে তিনি ও তার দেহরক্ষী অবস্থান করছিলেন, সেখানে একটি রকেট আঘাত হানে। ফলে এখন সব সন্দেহের তীর ইসরাইলের দিকে। কারণ গত বছরের ৭ অক্টোবর হামাস ইসরাইলের ভূখন্ডে হামলা চালানোর পর ইসরাইল সব হামাস নেতাকে খুঁজে বের করে শাস্তি দেওয়ার শপথ নিয়েছিল। হামাসের ওই হামলার প্রায় ১,২০০ জন ইসরাইলি ও বিদেশি নিহত হন।
ধারণা করা হয়, ইসরাইল ইরানের আকাশসীমার বাইরে থেকে লক্ষ্যবস্তুগুলোর দিকে রকেট ছুড়েছিল। এই হামলার বিবরণ ধীরে ধীরে প্রকাশিত হচ্ছে এবং রাজনৈতিক প্রভাবও ক্রমশই আলোচিত হচ্ছে। এই হত্যাকান্ডের প্রভাব গিয়ে পড়বে গাজায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে চলমান আলোচনার ওপরেও।
ইসমাইল হানিয়া হয়তো গাজার প্রতিদিনের ঘটনাগুলোতে ভূমিকা পালন করতে পারেননি। কিন্তু হামাসের নির্বাসিত নেতা হিসেবে তিনি কাতার, আমেরিকা এবং মিসরের মধ্যস্থতায় গাজায় যুদ্ধবিরতির আলোচনায় খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
গাজার প্রতিদিনের ঘটনাবলি পরিচালনার দায়িত্ব ছিল হামাসের সামরিক শাখার কমান্ডার ইয়াহিয়া সানওয়ারের ওপর। মার্কিন কর্মকার্তারা সম্প্রতি বলেছিলেন, যুদ্ধবিরতির আলোচনা শিগগিরই শেষ হতে পারে। যদিও গত সপ্তাহের শেষে রোমে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এর কোনো অগ্রগতি হয়নি। ইসমাইল হানিয়ার হত্যার পর এই আলোচনার কোনো অগ্রগতি হবে, এটি কল্পনা করা খুব কঠিন।
এখন কেন?
এসব ইসু্যর কারণে কিছু প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। যেমন, সবার ধারণা অনুযায়ী, এটা যদি ইসরাইলি আক্রমণ হয়, তবে এখন কেন এই হামলা চালানো হলো? হামাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত কারও বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছার বাইরে ইসরাইলের লক্ষ্য আর কী ছিল?
তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই অঞ্চলের অনেক গোষ্ঠী এবং দেশের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া একত্র করেছে। এক বিবৃতিতে তারা বলেছে, 'আবারও এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সরকারের শান্তি অর্জনের কোনো ইচ্ছা নেই।'
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সদর দপ্তর রামালস্নাহতে ইসমাইল হানিয়া হত্যার খবর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। ক্ষমতাসীন ফাতাহ পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির ডেপুটি সেক্রেটারি-জেনারেল সাবরি সায়েদাম বলেন, 'এই ঘটনাটি নরকের দরজা খুলে দেবে।' সায়েদাম বলেন, তিনি একইসঙ্গে বিস্মিত হচ্ছেন এবং ক্রোধ অনুভব করছেন। ইসরাইল শুধু ইসমাইল হানিয়ার জীবনকেই নিশানা করেনি, তারা ইরানের বিভিন্ন চুক্তিকেও লক্ষ্যবস্তু করেছে। তিনি আরও বলেন, 'শত্রম্নতার শেষ দেখার জন্য ইসরাইল সব আশা ও আকাঙ্ক্ষাকেও হত্যা করেছে।' ফাতাস ও হামাস দীর্ঘকাল ধরে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু হামাস নেতার মৃতু্যতে ফাতাহ'র উপকৃত হওয়ার বক্তব্যকে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন সায়েদাম। তিনি বলেন, 'ফিলিস্তিনের রাজনীতিতে কখনো এমন বিশ্বাস ছিল না যে, নেতৃত্বকে নির্মূল করা হলো অগ্রগতির একমাত্র মাধ্যম। এর যদি কোনো প্রভাব থাকেই, তবে তা কেবল আরও বেশি উত্তেজনা ও অসন্তোষ।'
এদিকে, রামালস্নাহ ও পশ্চিম তীরে ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সেখানে দোকানপাট সব বন্ধ এবং একটি প্রতিবাদ মিছিল চলছে। রামালস্নাহতে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের জন্য এটি একটি কঠিন সময় হতে পারে। সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে, ইসমাইল হানিয়া মাহমুদ আব্বাসের চেয়ে বেশি জনপ্রিয় ছিলেন।
হানিয়াকে যে সময়ে হত্যা করা হয়েছে, তা নির্দেশ করে যে, এটি একটি বৃহত্তর ইসরাইলি প্রতিশোধের অংশ। কারণ গত শনিবার হিজবুলস্নাহ'র রকেট হামলার জন্য ইসরাইল অধিকৃত গোলান মালভূমিতে ১২ জন শিশু ও কিশোর নিহত হয়েছে। এরপর মঙ্গলবার বৈরুতে হিজবুলস্নাহ'র একজন সিনিয়র কমান্ডারকে হত্যা করা হয়েছে। সে সময়ই ইসরাইল সতর্ক করেছিল যে, তারা ওই হামলার কড়া জবাব দেবে।
ইসরাইলি কর্মকর্তারা ক্রমাগত বলছেন যে, ইরান হলো মধ্যপ্রাচ্যের তথাকথিত 'অ্যাক্সিস অব রেসিসট্যান্স'র সংযোগস্থল। এই তথাকথিত অক্ষশক্তির অংশগুলো হলো লেবাননের হিজবুলস্নাহ, গাজা ও পশ্চিম তীরের হামাস এবং ইয়েমেনের হুতিরা।
বৈরুতে হিজবুলস্নাহকে আঘাত করার পর (এবং সম্প্রতি হোদেইদাহতে হুতিদের ওপর হামলার পর) ইরানে হামাস প্রধানের এই হত্যাকান্ড সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ও ইরানি সমর্থকদের জন্য একটি শক্তিশালী বার্তা। যা অনেকটা এরকম যে, 'তুমি যেখানেই থাকো, ইসরাইল পারে এবং তোমার কাছে আসবে।' তথ্যসূত্র : বিবিসি নিউজ