লক্ষ্য দখলদারিত্ব টিকিয়ে রাখা
ভিনদেশে মোসাদের হত্যা মিশন
ইসরাইলের আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্র তো আছেই, সঙ্গে আছে বিশ্বের অন্যতম দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা বাহিনী মোসাদ। তাদের খুনে-কীর্তি সম্পর্র্কে লোকমুখে অনেক কথাই প্রচলিত। এমন শক্তি মোসাদের যে, তাদের ব্যর্থতার খাতা আকারে অনেক ছোট। সেটা স্বাভাবিক হলেও সেই তালিকার একেবারে কিন্তু শূন্য নয়...
প্রকাশ | ০৩ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি ডেস্ক
ফিলিস্তিনের প্রধান রাজনৈতিক সংগঠন হামাসের নেতাকর্মীদের সবসময় প্রাণনাশের আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তার মধ্যে বাস করতে হয়। কারণ এখন পর্যন্ত শত্রম্নদের পাঠানো গুপ্তচরের হাতে নিহত হওয়া হামাস নেতার সংখ্যা নেহাত কম নয়। সবশেষ শিকার হামাসের রাজনৈতিক শাখার প্রধান ইসমাইল হানিয়া।
গত কয়েক দশকে ভিনদেশের মাটিতে সবচেয়ে বেশি গুপ্তহত্যা ঘটিয়েছে ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ। তাদের টার্গেটের শীর্ষস্থানে থাকে স্বাধীনতাকামী ফিলিস্তিনিরা। তারাই এই গোয়েন্দা সংস্থার টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হয়েছে বেশি। নিজেদের অবৈধ দখলদারিত্ব টিকিয়ে রাখা এবং যুদ্ধ পরিস্থিতি আরও দীর্ঘায়িত করতে এরই মধ্যে হামাসের কয়েক ডজন নেতাকে হত্যা করেছে দখলদার রাষ্ট্রটি। বিভিন্ন দেশে গিয়ে এসব কিলিং মিশন চালায় সংস্থাটি।
শুধু তাই নয়, ১৯৫৬ সালে মিসরের দুই সামরিক কর্মকর্তা মুস্তাফা হাফিজ ও সালাহ মুস্তফাকে পার্সেল বোমা পাঠিয়ে হত্যা করে ইসরাইল। মনে করা হয়ে থাকে, তারাই মোসাদের টার্গেট কিলিংয়ের প্রথম শিকার। সেই থেকে যে শুরু হয়েছে তা যা এখনো চলমান। ফিলিস্তিনে নিজেদের দখলদারিত্ব টিকিয়ে রাখতে অগুনতি মানুষকে হত্যা করেছে এই গোয়েন্দা সংস্থা।
ইসমাইল হানিয়া হত্যাকান্ডের পর আবারও সামনে মোসাদের কুখ্যাত কিলিং মিশনের পদ্ধতি। এর আগেও হামাসের বহু প্রভাবশালী নেতা তেল আবিবের লক্ষ্যবস্তু হয়েছে। ১৯৯৬ সালে মোসাদের গুপ্ত হামলায় নিহত হয় আলোচিত হামাস নেতা বোমা তৈরির ইঞ্জিনিয়ার ইয়াহইয়া আয়াশ। ২০০৪ সালে মাত্র এক মাসের ব্যবধানে মিসাইল ছুড়ে হত্যা করা হয় সংগঠনের দুই প্রতিষ্ঠাতা শেখ আহমেদ ইয়াসিন ও আবদুল আজিজ আল-রান্তিসিকে।
২০০২ সালে আল-কাসাম ব্রিগেডসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সালাহ শাহাদিকে হত্যা করেছিল ইসরাইল। ২০০৪ সালে হামাসের সামরিক শাখার আরেক শীর্ষ নেতা আদনান আল-ঘৌল এবং ২০২৪ সালে হামাস নেতা সালেহ আল-আরৌরিও হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন। এই তালিকায় আছে হাজারো মুক্তিকামী ফিলিস্তিনির নামও। এমনকি তাদের গুপ্তহত্যা থেকে রেহাই পাননি হিজবুলস্নাহর নেতারাও। সংগঠনটির সাবেক প্রধান সায়েদ আব্বাস আল-মোসাউইকেও তার দেশ লেবাননেই হত্যা করেছে ইসরাইল।
মোসাদের কিলিং মিশন নিয়ে এখন পর্যন্ত বহু বিশ্লেষণ হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রথমে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা ইসরাইলের বৃহত্তম গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক এবং ইসরাইল রাজনৈতিক নেতৃত্বের সমন্বয়ে হত্যার টার্গেট নির্ধারণ করে এই দুর্র্ধর্ষ সংস্থাটি। যাকে হত্যার পরিকল্পনা নেওয়া হয়, দ্বিতীয় ধাপে এসে তার সম্পর্কে বিস্তারিত গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের পর তা মূল্যায়ন করে মোসাদ।
মূল্যায়নকৃত প্রতিবেদন ইসরাইলে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রধানদের নিয়ে গঠিত ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস কমিটির প্রধানের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই কমিটিই সুপারিশ হাজির করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে হত্যা করা যায় কিনা। প্রধানমন্ত্রী প্রতিরক্ষামন্ত্রীর মতো গুরুত্বপূর্ণ ২-১ জনকে সঙ্গে নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেন। গুপ্তহত্যা পরিচালনায় গঠিত মোসাদের বিশেষ ইউনিট ক্যাসেরিয়া সেই নির্দেশ বাস্তবায়ন করে।
সরাসরি হামলা এবং প্রধানতম প্রতিপক্ষ ইসরাইলের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র তো আছেই, সঙ্গে আছে বিশ্বের অন্যতম দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা বাহিনী মোসাদ। তাদের খুনে-কীর্তি সম্পর্র্কে লোকমুখে অনেক কথাই প্রচলিত। এমন শক্তি মোসাদের যে, তাদের ব্যর্থতার খাতা আকারে অনেক ছোট। সেটা স্বাভাবিক হলেও সেই তালিকার একেবারে কিন্তু শূন্য নয়। যেমন, মোসাদের ৭৪ বছরের ইতিহাসে একটি বড় ব্যর্থতা হলো হামাস নেতা খালেদ মেশাল হত্যা অভিযান। অথচ তাকে হত্যা করতে পারলে অনেক স্বস্তিতে থাকতে পারত ইসরাইল। কিন্তু ইসরাইলের এই গলার কাঁটা এখনো টিকে আছেন সতর্কতার জন্য।
খালেদ মেশাল হত্যাচেষ্টা
সময়টা ১৯৯৭ সাল। ইসরাইলের সঙ্গে ফিলিস্তিনের সম্পর্ক কখনো ভালো না গেলেও সে সময় নানা কারণে চরম অবনতি ঘটে। ইসরাইল অধিকৃত জেরুজালেম এবং তেল আবিবে হামাসের আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীরা বেশ কিছু বিস্ফোরণ ঘটায়, যাতে প্রায় ২০ ইসরাইলি নিহত এবং শতাধিক আহত হয়। সে সময়কার পরিস্থিতি নিয়ে খালেদ মেশাল বলেন, 'সেবার গ্রীষ্ম থেকেই ইসরাইল নানা রকম হুমকি দিয়ে আসছিল। হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও যখন তারা ফিলিস্তিনিদের হামলাগুলো প্রতিহত করতে পারছিল না, তখন তারা বন্দুকের নল ঘোরায় হামাস নেতাদের দিকে। এরপর আমাদের কাছে একের পর এক হুমকি আসতে থাকে। তাদের হুমকি শুনেই বোঝা যাচ্ছিল, তারা আসলে কী করতে চাইছে। তবে তখন জর্ডানে এসে তারা এমন হামলা চালাতে পারে, সেটা আমরা ভাবতেও পারিনি। কারণ সে সময় জর্ডান ও ইসরাইলের মধ্যে অত্যন্ত তিক্ত সম্পর্ক বিরাজ করছিল।'
জর্ডানে অবস্থানকারী খালেদ মেশাল তখনো হামাসের প্রধান হননি। ১৯৯৬ সালে তিনি সংগঠনের রাজনৈতিক শাখার প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন। এছাড়া প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সক্রিয়ভাবে হামাসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে তিনি ছিলেন সংগঠনের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা। ১৯৯৭ সালে উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে ইসরাইলের বদরাগী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু মোসাদ ও ইসরাইলের অন্য সব নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে এক জরুরি গোপন বৈঠকে বসেন। এতে তিনি তার বাহিনীদের হামাসের বিরুদ্ধে একটি সত্যিকারের বড় আঘাত হানার নির্দেশ দেন, যার মূল অর্থ ছিল হামাস নেতাদের হত্যা করা।
তারপর ১৯৯৭ সালের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে জর্ডানের কুইন আলিয়া বিমানবন্দর দিয়ে কানাডিয়ান পর্যটকের ছদ্মবেশে ছয়জনের একটি দল প্রবেশ করে। তবে এরা সবাই ছিল মেশাল-বধে নিযুক্ত ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সদস্য। জর্ডানে নির্বাসিত নেতা খালেদ মেশালকে হত্যা প্রচেষ্টার দিনের ঠিক এক সপ্তাহ আগে তারা জর্ডানে প্রবেশ করে। সব সন্দেহের ঊর্ধ্বে থাকার জন্য তারা সরাসরি ইসরাইল থেকে না গিয়ে আমস্টারডাম, প্যারিস আর টরন্টো হয়ে জর্ডানে প্রবেশ করে।
মেশালকে হত্যা করার জন্য মোসাদের পদ্ধতি ছিল বেশ অভিনব। কোনো আগ্নেয়াস্ত্র ছাড়াই মেশালের কানে রাসায়নিক বিষ স্প্রে করে তাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে মোসাদ। এই স্প্রে প্রয়োগ করলে শ্বাস-প্রশ্বাস সংক্রান্ত কেন্দ্রটি অচল হয়ে যায়। আর বিষের ক্রিয়ায় সারা দেহ অবশ হয়ে যাওয়ার পর ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে নীরবে মারা যাওয়ার কথা ছিল মেশালের। মজার কথা, এই দলটির কাছে সেই বিষের প্রতিষেধকও তৈরি করা ছিল।
এরপর এক সপ্তাহ ধরে সুযোগসন্ধানী দলটি মেশালকে অনুসরণ করতে থাকে একটি সুবিধাজনক মুহূর্তের জন্য। অতঃপর ১৯৯৭ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর সেই মোক্ষম সুযোগটি এসে যায় তাদের সামনে। সেদিন প্রকাশ্য দিবালোকেই খালেদ মেশালের কানে মোসাদের তৈরি বিষ স্প্রে করা হয়। কিন্তু হায়! পালাতে গিয়েই হলো বিপত্তি। মেশালের নিরাপত্তা বাহিনী যে এত দ্রম্নত পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নেবে, তা ভাবতেই পারেনি মোসাদ। কর্ম সমাধার পরপরই নিরাপত্তায় নিযুক্ত জর্ডানের বাহিনী মোসাদের দলটিকে তাড়া করে এবং দু'জন ধরাও পড়ে। বাকিরা ইসরাইলি দূতাবাসে আত্মরক্ষার জন্য আশ্রয় নেয়।
এরপরের ঘটনাক্রম নেতানিয়াহু ও ইসরাইলের মোসাদের জন্য মোটেও সুখকর ছিল না। কারণ ওই ঘটনার পর রাজধানী আম্মানে ইসরাইলি দূতাবাস ঘিরে ফেলে জর্ডানের বাহিনী। আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনকে নেতানিয়াহু-কান্ড জানানো হলে তিনিও উষ্মা প্রকাশ করেন। হুমকি দেওয়া হয়- কোমায় চলে যাওয়া মেশালের মৃতু্য হলে জর্ডান ও ইসরাইলের মধ্যকার শান্তিচুক্তি শেষ হয়ে যাবে। অবস্থা বেগতিক দেখে নেতানিয়াহু ও তৎকালীন মোসাদ-প্রধান ড্যানি ইয়াতম জর্ডানের রাজা হুসেনের সঙ্গে গোপনে সংলাপ করেন। সেই সংলাপে রাজা হুসেন যে সব শর্ত দেন তা মেনে নেওয়া নেতানিয়াহুর জন্য অনেকটা নাকে খত দেওয়ার মতোই ছিল।
শর্ত অনুযায়ী, যে বিষ মেশালের কানে স্প্রে করা হয়েছিল, তার প্রতিষেধক পাঠাতে বাধ্য হয় মোসাদ। পাশাপাশি ইসরাইলের কারাগারে বন্দি থাকা জর্ডানের ৯ নাগরিক, ৬১ ফিলিস্তিনি এবং সবচেয়ে বড় কথা হামাসের আধ্যাত্মিক নেতা ও ইসরাইলের সবচেয়ে বড় শত্রম্ন বলে পরিচিত আহমেদ ইয়াসিনকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় তারা। এছাড়া হুসেন এবং নেতানিয়াহুর মধ্যে আর কোনো শর্ত হয়েছিল কি-না তা জানা যায়নি। তবে প্রকাশিত শর্তগুলো মেটানোর পরই জর্ডানের জিম্মায় থাকা ইসরাইলের পাঁচ নাগরিককে মুক্তি দেয়। একই সঙ্গে খালেদ মেশালের হত্যায় ব্যর্থতা এবং ইসরাইল রাষ্ট্রের বড় শত্রম্নকে মুক্তি দিতে বাধ্য হওয়ার কারণে তোপের মুখে পড়েন প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হওয়া বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এই ঘটনায় নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তা উদ্ধার করতে তার দীর্ঘদিন লেগেছিল। অন্যদিকে এ ঘটনার মধ্য দিয়ে যে বিশ্ব পরিচিতি এবং সমবেদনা লাভ করে তরুণ সংগঠন হামাস, তা তাদের উত্থানে অনেকখানি সাহায্য করে। তথ্যসূত্র : আল-জাজিরা অনলাইন