রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১
যুক্তরাজ্য

কবরস্থানে বাড়ছে প্রাণের কোলাহল!

যাযাদি ডেস্ক
  ২৬ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
কবরস্থানে বাড়ছে প্রাণের কোলাহল!

বর্ণিল এ পৃথিবীতে থাকার দিন ফুরিয়ে এলে সবাইকে শেষ পর্যন্ত এক জায়গায় যেতেই হয়। জায়গাটির নাম কবরস্থান। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সংস্কৃতির কোথাও সাধারণত এ সমাধিক্ষেত্র জায়গাটিকে খুব একটা ভালো চোখে দেখা হয় না। 'শ্মশানের নীরবতা'-কে দেশে দেশে কবি-সাহিত্যিকরা অশুভ একটি বিশেষণ হিসেবেই ব্যবহার করে এসেছেন। আর অনেকেই এ সমাধিক্ষেত্রকে পুঁজি করে ভূত-প্রেত ইত্যাদির গল্প লিখে 'অশুভ'র ট্যাগটা পাকাপাকি করে বসিয়ে দিয়েছেন। বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেন মঙ্গলজনক কিছু এখানে কখনোই থাকতে পারে না।

সমাধিক্ষেত্রের প্রতি এমন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের সময় এসেছে বলেই ধরে নেওয়া যায়। কেবল পাথরে নাম খোদাই করা নিষ্প্রাণ বিরানভূমি হিসেবে আর সমাধিক্ষেত্রদের চিহ্নিত করা যাবে না। কারণ সম্প্রতি জানা গেছে, সমাধিক্ষেত্রগুলো শহরায়নের তাড়ায় পালিয়ে বেড়ানো বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর আশ্রয়স্থল হয়ে উঠছে। 'শ্মশানের নীরবতা' বিশেষণটির দিনও তাই শেষ হয়ে আসছে বলে ধরে নেওয়া যায়। সম্ভবত সমাধিক্ষেত্রকেই ভবিষ্যতে সাহিত্যিকদের 'প্রাণপ্রাচুর্যের সরবতা'-র একটি মোক্ষম উপমা হিসেবে ব্যবহার করতে হবে।

সভ্যতা মানুষকে এককালে তার প্রতিবেশী প্রজাতিগুলো থেকে আলাদা করে তাকে 'সৃষ্টির সেরা জীব'র মুকুট দিয়েছে। মূলত মানব সভ্যতা যেদিন থেকে তার দিগ্বিজয়ী অভিযানে বের হলো, বলা যায় সেদিন থেকেই সভ্যতার ফলস্বরূপ অন্য প্রজাতিগুলোর রাহুর দশার সূচনা হয়েছে। কৃপণ সভ্যতা মানুষকে অনেক দিলেও মৃতু্যর নিত্যনতুন উপায় ছাড়া প্রতিবেশী এই প্রজাতিগুলোকে খুব কম উপহারই দিয়েছে। তাই মানবজাতির সঙ্গে পৃথিবীর অন্য প্রজাতিগুলোর 'তোমার হলো শুরু, আমার হলো সারা' ধরনের সম্পর্ক আছে। সমাধিক্ষেত্রেও মানুষের শেষ, অবশিষ্ট জীবজগৎ সেখানেই ঘরকন্না পাতলো।

সমাধিক্ষেত্রে প্রাণবৈচিত্র্যের এ বিপুল সমারোহের তথ্যকে কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে যুক্তরাজ্য। কারণ পৃথিবীতে টিকে থাকার জন্য অপরিহার্য এই প্রাণবৈচিত্র্য। দেশটির ম্যানচেস্টারে সবচেয়ে বড় সমাধিক্ষেত্রটি অবস্থিত। ১৮৯৭ সালে প্রায় ৪০ হেক্টর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত এই সমাধিক্ষেত্রটিকে এখন জীববৈচিত্র্যের একটি সংরক্ষিত আশ্রয়স্থল হিসেবে গড়ে তুলতে চাইছে ব্রিটিশ সরকার। প্রাণপ্রাচুর্যতায় পূর্ণ করে সমাধিক্ষেত্র সাজিয়ে তোলার ঘটনা যুক্তরাজ্যে এটাই প্রথম নয়। দেশটিতে 'জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষিত আশ্রয়স্থল' হিসেবে ব্যবহৃত সমাধিক্ষেত্রের সংখ্যা প্রায় ১০টি। এদের অনেকগুলোই প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় স্থান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কারণ যুক্তরাজ্যে যে ১৮ প্রজাতির বাদুড় পাওয়া যায়, তার মধ্যে তিন প্রজাতিরই খোঁজ মিলেছে সমাধিক্ষেত্রে। বাদুড় বিশেষজ্ঞ ক্লেয়ার শেফটন জানান, 'সমাধিক্ষেত্রের মতো এত পোকা আর কোথাও পাওয়া যাবে না শহুরে এলাকায়। এটাই এই পতঙ্গভূকদের এখানে টেনে এনেছে।'

বিলুপ্তির হুমকির মুখে থাকা অনেক প্রজাতিকেও এখন দেখা যাচ্ছে ম্যানচেস্টারের সমাধিক্ষেত্রতে। দেখা যাচ্ছে হরিণও।

সমাধিক্ষেত্র কি করে বুনোদের আশ্রয়স্থল হতে পারে জানতে চাওয়া হলে প্রকল্পটির প্রধান ডেভিড বার্লো বলেন, 'খালি চোখে আমরা যে নির্গুণ সমাধিক্ষেত্র দেখি, আসলে বিষয়টি সে রকম নয়। এসব সমাধিক্ষেত্রে অনেক লুকনো রত্ন রয়েছে। অর্থাৎ, এগুলো প্রাণীদের বসবাসের জন্য অনেক আরামদায়ক।'

তবে সমাধিক্ষেত্র অবশ্য সব জাতের বৃক্ষ বা প্রাণীর জন্য আশ্রয় হতে পারে না। অনেক প্রাণীই আছে যারা ভেতরের শব খুঁড়ে বের করে ফেলতে পারে। তাই সংশ্লিষ্টদেরও প্রাণবৈচিত্র্য এবং সমাধিক্ষেত্রের ব্যবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়েই পরিকল্পনা করে এগোতে হচ্ছে। প্রাণবৈচিত্র্যের আশ্রয়স্থল করে গড়ে তুলতে হলে পুরো এলাকাই যে ঘন বন হয়ে উঠবে, এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দিলেন বার্লো। তবে পুরনো সমাধিক্ষেত্রগুলোই এমন আশ্রয়স্থল গড়ে তোলার জন্য সুবিধাজনক বলে মত দেন তিনি।

শুধু যে ব্যবস্থাপনা নিয়েই কাজ করছেন না তারা, সমাধিক্ষেত্রও যে জীবনের প্রাচুর্যে ভরপুর হয়ে উঠতে পারে তাও মানুষকে বোঝানো প্রয়োজন। প্রয়োজন দীর্ঘদিনের কুসংস্কার হটিয়ে সমাধিক্ষেত্রের এই 'লুকনো রত্নগুলোর' সঙ্গে তাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া। তাই বার্লোর বাহিনী নিয়মিতই সমাধিক্ষেত্রগুলোয় 'পাখি বা বাদুড় দেখা'র আয়োজন করে থাকে। সারাদিন হয়তো আপাতদৃষ্টিতে নিষ্প্রাণ মনে হতেই পারে, তবে সন্ধ্যার আগ থেকেই এখানে প্রাণের স্পন্দন টের পাওয়া যায়।

কোলাহলপূর্ণ শহরাঞ্চলের মধ্যে 'শ্মশানের নীরবতা' পাওয়াও প্রাণীদের মধ্যে সমাধিক্ষেত্রের জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ। এছাড়াও শহরের বাগান বা গ্রামের কৃষি জমিগুলোয় খুব পরিকল্পনা করে সারি বেঁধে গাছ লাগানো হয় যা প্রাণীদের স্বচ্ছন্দে চলাচলের অনুপযোগী। এছাড়াও বেশিরভাগ কৃষিজমি বা বাগানে কেবলমাত্র এক জাতের গাছই চাষ করা হয়। এটিও প্রাণবৈচিত্র্য গড়ে ওঠাকে বাধাগ্রস্ত করে।

বার্লো বলেন, 'আগাছা এবং ঝোপঝাড় বেড়ে উঠতে দেওয়া উচিত, যেখানে প্রজাতিগুলো একটু আড়ালে তাদের আশ্রয় খুঁজে নিতে পারে। শুধু তাই না, গাছপালাকে নিজেদের মতো বাড়তে দিলে সেখানে একটি খাদ্য-শৃঙ্খল বেড়ে ওঠার সুযোগ পায়। শহরের বনাঞ্চলকে যদি সেভাবে গড়ে উঠতে দেওয়া হয় তবে বৈচিত্র্যের সমৃদ্ধিতে তা গ্রামের প্রাণবৈচিত্র্যকেও ছাড়িয়ে যাবে। কারণ সেখানে মূলত যা আছে, তা হলো এক জাতির গাছের কৃষিজমি।'

ম্যানচেস্টার সমাধিক্ষেত্রের একজন দর্শনার্থী বলেন, 'যতক্ষণ এখানে ছিলাম, আমার কখনোই একে কোনো মনমরা সমাধিক্ষেত্র মনে হয়নি। বরং চারদিক থেকে প্রাণের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। ...অল্প বা বেশি যা-ই বলেন, ম্যানচেস্টারে সবুজ বলতে যা কিছু অবশিষ্ট আছে, তা মূলত এখানেই।' ডেভিড বার্লোও গুরুত্ব দিলেন প্রকৃতিকে বাঁচানোর ওপর, 'যুক্তরাজ্যে প্রথম শিল্পায়িত নগর ম্যানচেস্টার। আর তাই শিল্পের পাশাপাশি প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখাটা আমাদের সবার দায়িত্ব।' তথ্যসূত্র : বিবিসি নেচার

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে