আশ্রয় দিয়ে বিপাকে

যেভাবে নিজ ভূখন্ড হারাল ফিলিস্তিনিরা

জায়নবাদিরা ইহুদি রাজ্য গড়ে তুলতে প্রথমে তুর্কি সুলতানের কাছে ফিলিস্তিন বিক্রির প্রস্তাব দেয়। সুলতান আবদুল হামিদ তাদের সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে জায়নবাদিরা ভিন্ন কৌশলে হাঁটতে শুরু করে। তারা ধনী ইহুদিদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে বহিরাগত ইহুদিদের জন্য ফিলিস্তিনিদের কাছ থেকে জমি কেনা শুরু করে...

প্রকাশ | ২৪ জুলাই ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
আধুনিক বিশ্বে বছরের পর বছর মানুষ হত্যা করে পার পেয়ে যাওয়া একমাত্র 'রাষ্ট্র' হচ্ছে ইসরাইল। সাত দশকের বেশি সময় ধরে অসহায় ফিলিস্তিনিদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে গেলেও পশ্চিমা দুনিয়া ইসরাইলকে সন্তানের মতোই লালন-পালন করছে। অথচ ১৯৪৭ সালের আগে ইহুদি রাষ্ট্র তো দূরের কথা, ইসরাইল নামে কোনো দেশই ছিল না পৃথিবীর বুকে। ইউরোপ থেকে জীবন বাঁচাতে নগ্নপায়ে আসা যে ইহুদিদের ফিলিস্তিনিরা আশ্রয় দিয়েছিল, এখন তাদেরই বুকে প্রায় প্রতিদিন গুলি চালাচ্ছে ইসরাইল। তাহলে কেন এই সংঘাত? এর উত্তর জানতে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করতে হবে। ইহুদি ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী, হজরত ইসহাকের (আ.) পুত্র হজরত ইয়াকুব (আ.)-এর আরেক নাম ইসরাইল। তার নামানুসারে বংশধররা 'বনি ইসরাইল' হিসেবে পরিচিত। বনি ইসরাইল পরবর্তী সময় নিজেদের 'ইহুদি' নামে পরিচয় দিতে থাকে। হজরত ইয়াকুবের (আ.) এক পুত্রের নাম ছিল ইয়াহুদা। সেই নামের অংশবিশেষ থেকে 'ইহুদি' নামকরণ হয়। বনি ইসরাইলিদের প্রথম রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত তালুতের সময়। পরে নবী দাউদ (আ.) এই রাজত্ব বিস্তৃত করেন। দাউদের (আ.) ছেলে সুলাইমানের (আ.) সময় পর্যন্ত এই রাজত্ব টিকে ছিল। তার ছেলে রেহোবামের শাসন আমলে বনি ইসরাইলিদের রাষ্ট্র দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। উত্তরে ইসরাইল দক্ষিণে জুদাহ। পরবর্তী সময় ব্যাবিলনীয় আক্রমণে ইহুদিদের নির্বাসিত হতে হয়। বাইবেলের আদি পুস্তক অনুযায়ী, মিসর থেকে সিনাই উপত্যকা হয়ে কেনানে ফিরে ইহুদিদের শান্তিতে বসবাসের জন্য সৃষ্টিকর্তা নবী মুসাকে দুধ ও মধুর দেশের প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছিলেন। কিন্তু তার বিধান লঙ্ঘনের দায়ে ইহুদিদের তাদের সেই দেশ থেকে বিতাড়িত করেছিলেন ঈশ্বর। প্রথমবার ব্যালিনীয়দের এবং দ্বিতীয়বার রোমানদের হাতে বিতাড়িত হতে হয়েছিল তাদের। মধ্যযুগে মুসলিম শাসনামলে ইহুদিরা মর্যাদার সঙ্গে বসবাস করেছে। স্পেনে উমাইয়া শাসনামালে তাদের মন্ত্রী হওয়ার নজিরও রয়েছে। এ কারণেই গ্রানাডা পতনের পর বিজয়ী রাজা ফার্দিনান্দ ও রানি ইসাবেলা ইহুদিদের খ্রিষ্টান হওয়ার, নয়তো দেশ ছাড়ার নির্দেশ দেন। যেসব ইহুদি স্পেনে থেকে গিয়েছিল, তাদের 'ইনকুইজিশন' হিসেবে পরিচিত চার্চের কঠোর নির্যাতনের মুখে পড়তে হয়। ইউরোপের অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়লেও শান্তিতে থাকতে পারেনি ইহুদিরা। আচরণগত কারণে তাদের বরাবরই সন্দেহের চোখে দেখা হতো। এ ছাড়া উনবিংশ শতাব্দীতে জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটলে খ্রিষ্টানদের চরম নির্যাতনের মুখে পড়তে হয় তাদের। আজকে যে যুক্তরাজ্য ইসরাইলিদের পরম মুরুব্বি, সেই দেশটির রাজারা ইহুদিদের ওপর গণহত্যা পর্যন্ত চালিয়েছিলেন। ঊনবিংশ শতকের শুরুতে ইউরোপে নিপীড়নের শিকার ইহুদিদের মধ্যে 'জায়নবাদ' আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এই আন্দোলনের মূল বিষয় ছিল জেরুজালেমকে কেন্দ্র করে ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। ১৮৮০ সালে নাকান বেরেনবুয়ান নামে এক অস্ট্রিয়ান ইহুদিদের জেরুজালেমে ফিরে যাওয়ার প্রস্তাব করেন। ১৮৯৬ সালে অস্ট্রিয়ান ইহুদি সাংবাদিক আনুষ্ঠানিকভাবে জায়নবাদ প্রকাশ করেন। তিনি 'দ্য জিউস স্টেট' গ্রন্থে জায়নবাদের রূপরেখা প্রণয়ন করেন এবং 'ইন্টারন্যাশনাল জায়নিস্ট অরগানাইজেশন' নামে একটি রাজনৈতিক পস্ন্যাটফর্ম গড়ে তোলেন। জায়নবাদীরা ইহুদি রাজ্য গড়ে তুলতে প্রথমে তুর্কি সুলতানের কাছে ফিলিস্তিন বিক্রির প্রস্তাব দেয়। সুলতান আবদুল হামিদ তাদের সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে জায়নবাদিরা ভিন্ন কৌশলে হাঁটতে শুরু করে। তারা ধনী ইহুদিদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে বহিরাগত ইহুদিদের জন্য ফিলিস্তিনিদের কাছ থেকে জমি কেনা শুরু করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে তুরস্ক থেকে গিস্নসারিন কিনতো ব্রিটিশরা। সমরাস্ত্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই গিস্নসারিন। বিশ্বযুদ্ধের সময় তুরস্ক গিস্নসারিন বাণিজ্য বন্ধ করে দিলে বিপাকে পড়ে ব্রিটিশরা। এরপর ইহুদি বিজ্ঞানী ওয়াইজম্যান গিস্নসারিনের বিকল্প এসিটোন আবিষ্কার করেন এবং এর ফর্মুলা ব্রিটিশদের কাছে তুলে দেন। ওয়াইজম্যান এর বিনিময় ব্রিটিশদের কাছে ইহুদিদের জন্য আলাদা আবাসভূমির দাবি করেন। যুক্তরাজ্যের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড আর্থার জেমস বেলফোর ব্রিটিশ ইহুদি নেতা লিওনেল ওয়াল্টার রথসচাইল্ডকে লেখা ৬৭ শব্দের চিঠিতে ফিলিস্তিন ভূখন্ডে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রম্নতি দেন, যা 'বেলফোর ঘোষণা' নামে পরিচিত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কের পরাজয়ের পর ফিলিস্তিনসহ আরবের বেশ কিছু অঞ্চল চলে যায় ব্রিটিশদের হাতে। আলাদা রাষ্ট্রের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হওয়ার পর বিপুল সংখ্যক ইহুদি ইউরোপ থেকে ফিলিস্তিনে গিয়ে বসতি স্থাপন শুরু করে। ১৯০৫-১৯১৪ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনে ইহুদিদের সংখ্যা ছিল মাত্র কয়েক হাজার। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ১৯২৩ সাল নাগাদ ফিলিস্তিনে ইহুদিদের সংখ্যা ৩৫ হাজারে পৌঁছে যায়। ১৯৩১ সালে ইহুদিদের এই সংখ্যা প্রায় পাঁচ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে এক লাখ ৮০ হাজারে পৌঁছায়। ১৯৪৮ সালে ইহুদিদের সংখ্যা ছয় লাখে উন্নীত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জাহাজে করে হাজার হাজার ইহুদি অভিবাসী ফিলিস্তিনে যেতে শুরু করলে আরবরা বুঝতে পাওে, তাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ছে। ফলে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য বিদ্রোহ করে। শুরু হয় ইহুদি-আরব সংঘাত। আরবদের উৎখাতের জন্য ১৯১৮ সালে যুক্তরাজ্যের সহযোগিতায় গঠন হয় ইহুদিদের গুপ্ত সংগঠন 'হাগানাহ'। পরে 'ইরগুন' ও 'স্টার্ন গ্যাং' নামে আরও দুটি জায়নবাদী সন্ত্রাসী সংগঠন গড়ে ওঠে। তারা ইউরোপ থেকে অস্ত্রশস্ত্র ও সামরিক প্রশিক্ষণ পায়। এই সংগঠনের সদস্যরা আরবদের বাড়িঘর ও ক্ষেতখামার দখল করে তাদের ফিলিস্তিন থেকে বিতাড়ন শুরু করে। এ ছাড়া বিভিন্ন জায়গায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। আরবদের ওপর ইহুদি সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর হত্যার কথা যখন আন্তর্জাতিকভাবে প্রচারিত হচ্ছিল, তখন নিজেদের দিকে সহানুভূতি টানতে হাগানাহ আত্মহননের পথ বেছে নেয়। ১৯৪০ সালে 'এসএস প্যাট্রিয়া' নামক একটি জাহাজকে হাইফা বন্দরে তারা উড়িয়ে দিয়ে ২৭৬ জন ইহুদিকে হত্যা করে। ১৯৪২ সালে আরেকটি জাহাজকে উড়িয়ে ৭৬৯ জন ইহুদিকে হত্যা করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফিলিস্তিন ইসু্যটি চাপা পড়ে থাকে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর আলাদা রাষ্ট্র গঠনের বিষয়টি আবারও সামনে আনতে ফিলিস্তিনে মোতায়েন ব্রিটিশ বাহিনীর ওপর হামলা শুরু করে ইহুদি সশস্ত্র দলগুলো। একপর্যায়ে ফিলিস্তিন ইসু্য সমাধানের জন্য যুক্তরাজ্যের ওপর চাপ বাড়তে থাকে। নিজের ওপর একতরফা দায় এড়াতে যুক্তরাজ্য কৌশলে বিষয়টিকে জাতিসংঘে উপস্থাপন করে। আমেরিকার চাপে ১৯৪৭ সালের নভেম্বরে ফিলিস্তিন ভূখন্ডে দ্বি-রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় জাতিসংঘ- একটি ইহুদিদের জন্য এবং অপরটি আরবদেও জন্য। ইহুদিরা ১০ শতাংশ ভূখন্ডের মালিক হলেও তাদের দেওয়া হয় মোট জমির অর্ধেক। অথচ আরবদের জনসংখ্যা ও জমির মালিকানা ছিল দ্বিগুণ। জাতিসংঘের এই অযৌক্তিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ইহুদিরা জয় পাওয়ার পর ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ কর্মকান্ড শুরু হয়। এ সময় লাখ লাখ আরব বাধ্য হয় দেশ ছাড়তে। আরব ও ইহুদিদের মধ্যে যখন দাঙ্গা ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে, তখন ফিলিস্তিন ছেড়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয় যুক্তরাজ্য। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে তারা ফিলিস্তিন ছেড়ে চলে যায়। তৎকালীন ইহুদি নেতারা এরপর ঘোষণা দেন, ১৪ মে রাতেই ইহুদি রাষ্ট্রের জন্ম হবে। সেদিন রাত ১২টায় ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্মের মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যে আমেরিকা স্বীকৃতি দেয় এবং তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্য সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করে। পরদিন আরব দেশগুলো ইসরাইলের ওপর হামলা চালায়। যুদ্ধে অসংগঠিত আরবরা পরাজিত হলে জর্ডান ও সিরিয়ার বড় অংশ দখল করে নেয় ইসরাইল। আরব-ইসরাইলের মধ্যে এরপর ফিলিস্তিন ইসু্যতে ১৯৫৬, ১৯৬৭ এবং ১৯৭৩ সালে তিনটি যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধগুলোতে যথারীতি দুর্বল আরবদের পরাজয় ঘটে এবং শেষ পর্যন্ত ফিলিস্তিনের ভাগ্যে দুর্ভোগ ছাড়া আর কিছুই জোটেনি। সেই দুর্ভোগের জের এখনো টানতে হচ্ছে নিজ ভূমিতে পরবাসী ফিলিস্তিনিদের। সংবাদসূত্র : হিস্টরি ডট কম, উইকিপিডিয়া