মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থিতা

বাইডেনের সরে যাওয়া অবধারিত!

প্রার্থীর সরে দাঁড়ানোটা অভূতপূর্ব কোনো ঘটনা নয়। ১৯৮০ সালে আমেরিকার ৩৯তম প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের সঙ্গে এমনটি হয়েছিল। তিনি ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তবে অনেকের মনে সংশয় ছিল দ্বিতীয়বার প্রার্থী হলে তিনি ভোটে হারবেন। তাছাড়া সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি তাকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। ফলে কার্টারকে সরে দাঁড়াতে হয়েছিল। ১৯৬৮ সালের আরেকটি ঘটনা রয়েছে, যেখানে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট হয়েও লিন্ডন বি জনসনকে চাপের মুখে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে হয়েছিল। জনসনের জন্য সেটি ছিল দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হওয়ার সুযোগ। তবে বয়সের চাপে স্মৃতি লোপ পাওয়ার অভিযোগে তাদের কাউকে সরে দাঁড়াতে হয়নি...

প্রকাশ | ১৪ জুলাই ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট 'বুড়ো' জো বাইডেনকে নিয়ে তার দলে অস্বস্তি বেড়েই চলেছে। একের পর এক 'ভুলভাল' কথা বলায় ডেমোক্রেটিক পার্টির শীর্ষ পর্যায় থেকেও প্রার্থিতা প্রত্যাহারে বাইডেনের ওপর চাপ বাড়ছে। দলীয় আইনপ্রণেতা, তহবিল সংগ্রহকারী, এমনকি দলের নীতিনির্ধারকদের একাংশ চাইছেন না, ৮১ বছর বয়সি বাইডেন নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করুন। তবে শত চাপেও 'গোঁ' ধরে আছেন দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে বয়স্ক প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী বাইডেন। তিনি নিজেই নিজেকে যোগ্য দাবি করছেন, বলছেন- ঈশ্বর না চাইলে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়াবেন না। গত বৃহস্পতিবারও ওয়াশিংটন ডিসিতে ন্যাটো সম্মেলন শেষে সংবাদ সম্মেলনে ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসকে 'ট্রাম্প', ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে 'প্রেসিডেন্ট পুতিন' বলে সম্বোধন করে হাস্যরসের জন্ম দিয়েছেন বাইডেন। অথচ মার্কিন সংবাদ মাধ্যমগুলো বলছিল, ন্যাটো সম্মেলনই বাইডেনের টিকে থাকা বা না-থাকার বিষয়টি প্রমাণের মঞ্চ। সেই সুযোগও তিনি নিয়েছিলেন, তবে ফল হয়েছে উল্টো। সম্মেলনের ফাঁকে ফাঁকে সমালোচকদের উদ্দেশে বাইডেন বার্তা দিয়েছেন, বারবার বলে গেছেন, তিনি দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য পুরোপুরি 'প্রস্তুত' সেই শারীরিক সক্ষমতাও তার রয়েছে। তবে এখনকার বাইডেনকে নিয়ে ব্যক্তিগত পর্যায়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে নির্বাচিত সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এবং দীর্ঘদিন হাউস স্পিকারের দায়িত্ব পালন করা ন্যান্সি পেলোসি। দুজনই দলের নীতিনির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শদাতা। গত বৃহস্পতিবারের সংবাদ সম্মেলনে জানতে চাওয়া হয়, ডেমোক্রেটিক পার্টির জাতীয় সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর চূড়ান্ত মনোনয়নে ভোট দিতে আসা 'ডেলিগেটরা' (প্রতিনিধি) যদি অন্য কোনো প্রার্থীকে সমর্থন দিতে চান, তাহলে সেই প্রার্থী কি বাইডেনের আশীর্বাদ পাবেন। জবাবে বাইডেন বলেন, 'তারা যা চান, পুরোপুরি স্বাধীনতা নিয়েই তারা সেটা করতে পারেন।' এরপরই বাইডেন যোগ করেন, 'আগামীকালই (জাতীয়) যদি সম্মেলনে দাঁড়িয়ে আচমকাই আমি দেখি, সবাই বলছে- আমরা অন্য কাউকে চাই; সেটাও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অংশ। তবে সেটা হওয়ার নয়।' ডেমোক্রেট প্রার্থী বাছাইয়ের প্রাইমারি পর্বে বিপুলভাবে জয়ী হয়েছেন বাইডেন। নিয়ম অনুযায়ী ডেলিগেটরা পার্টির প্রার্থী হিসেবে তাকেই সমর্থন দিতে প্রতিশ্রম্নতিবদ্ধ। আত্মবিশ্বাস নিয়ে প্রার্থিতায় টিকে থাকার পক্ষে সাফাই গাইলেও একই সংবাদ সম্মেলনে তার মুখ ফসকে বের হয় একের পর এক ভুলভাল কথা। কখনো কখনো তার হাত কাঁপতে দেখা যায়, তাকে ঢোক গিলতে ও খুকখুক করে কাশি দিতে দেখা যায়। আবার মঞ্চেই লম্বা হাই ছাড়ছেন, এমন দৃশ্যও ধরা পড়েছে ক্যামেরায়। ট্রাম্প তো টিপ্পনি কাটছেনই, ডেমোক্রেটদেরও মধ্যে এখন প্রকাশ্যে আলোচনা হচ্ছে, 'বুড়ো জো' ভোটে গেলে তিনি নিজেকে তো ডোবাবেনই দলকেও নাকানিচুবানি খাওয়াবেন। তাহলে বাইডেনকে প্রার্থিতা থেকে টেনে নামানোর কোনো পথ কি ডেমোক্রেটিক পার্টির সামনে কাছে? কী বলছে দলটির অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক চর্চা, তাদের দলীয় নিয়মনীতিই বা কেমন? 'ব্রম্নকিংস ইন্সটিটিউশন'র জ্যেষ্ঠ গবেষক এলাইন কামার্ক, যিনি প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বাছাইয়ের প্রাইমারি প্রক্রিয়া নিয়ে অনেক লেখালেখি করেছেন। নিবিড়ভাবে ডেমোক্রেটিক পার্টির সঙ্গে যুক্ত থেকে আইন ও বিধি প্রণয়ন কমিটিতে দীর্ঘদিন কাজ করছেন কামার্ক। তিনি বলছেন, বাইডেনকে প্রার্থিতার দৌড় থেকে সরানোর প্রক্রিয়াটি জাতীয় সম্মেলনে প্রার্থীর চূড়ান্ত মনোনয়ন নিশ্চিত করার জন্য আমেরিকার ৫০টি রাজ্য থেকে জড়ো হওয়া ডেমোক্রেটিক পার্টির তিন হাজার ৯৪৯ জন ডেলিগেটের দলীয় রীতিনীতি চর্চার ওপর নির্ভর করছে। আগে কখনো এমন হয়েছে? এলাইন কামার্ক বলছেন, হঁ্যা, তা তো হয়েছেই। এটি অভূতপূর্ব কোনো ঘটনা নয়। ১৯৮০ সালে আমেরিকার ৩৯তম প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের সঙ্গে এমনটি হয়েছিল। তিনি ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট ছিলেন তবে অনেকের মনে সংশয় ছিল দ্বিতীয়বার প্রার্থী হলে তিনি ভোটে হারবেন। তাছাড়া সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি তাকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। ফলে কার্টারকে সরে দাঁড়াতে হয়েছিল। ১৯৬৮ সালের আরেকটি ঘটনা রয়েছে, যেখানে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট হয়েও লিন্ডন বি জনসনকে চাপের মুখে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে হয়েছিল। জনসনের জন্য সেটি ছিল দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হওয়ার সুযোগ। তবে বয়সের চাপে স্মৃতি লোপ পাওয়ার অভিযোগে তাদের কাউকে সরে দাঁড়াতে হয়নি। ১৯৭৬ সালে রিপাবলিকান পার্টিতেও এমনটি ঘটেছিল। সেবার রোনাল্ড রিগান ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ডকে চ্যালেঞ্জ করে বসেন। সে ছিল এক বিরাট লড়াই। তবে সামান্য ব্যবধানে পরাজিত রিগান শেষপর্যন্ত ফোর্ডকে সাধুবাদ জানান। বিকল্প খোঁজা বেশি দেরি হয়ে গেছে? বিশেষজ্ঞ কামার্ক বলছেন, মোটেও তা নয়। বাইডেনের বদলে অন্য একজন প্রার্থীকে বেছে নেওয়ার জন্য এখনো যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে ডেমোক্রেটদের হাতে। আইনের দিক থেকে এবং দলীয় বিধিবিধানের আলোকে জাতীয় সম্মেলনে ডেলিগেটদের 'নাম ডাকা'র (রোল কল) আগ পর্যন্ত যে কোনো সময় নতুন কোনো প্রার্থীকে দাঁড় করানো যেতে পারে। তবে রাজনৈতিকভাবে বিষয়টি এখন বেশ কঠিন। কারণ কমলা হ্যারিস ছাড়া নির্বাচনে দাঁড়ানোর মতো জাতীয় পর্যায়ে সুপরিচিত কোনো প্রার্থী ডেমোক্রেটদের নেই। আরও একটি কারণ রয়েছে, তা হলো- ডেলিগেটদের সঙ্গে পরিচিতি। বাইডেনের পর কমলা হ্যারিস ছাড়া এমন কোনো নেতা নেই, ৫০টি রাজ্যের বেশিরভাগ ডেলিগেটের সঙ্গে যার ব্যক্তিগত যোগাযোগ রয়েছে। এই দুজন বাদে বিকল্প কোনো নেতার এই মুহূর্তে আলাবামা, মেইন, উটাহর মতো রাজ্যের ডেলিগেটদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের সমর্থন পাওয়ার সামর্থ্যও নেই। কমলা হ্যারিসই সম্ভাব্য বিকল্প প্রার্থী? এলাইন কামার্ক বলেন, 'হঁ্যা, ঠিক তাই'। তার ভাষ্য, 'এটা আইন বা অন্য কিছু দিয়ে নির্ধারিত নয়। তবে কথা হচ্ছে, ওই প্রায় চার হাজার মানুষ (ডেলিগেট) তারা কাকে চান। প্রথমত, ডেলিগেটরা বাইডেনের খুবই অনুগামী। ফলে বিকল্প কাউকে বেছে নিতে ডেলিগেটদের প্রতিও বাইডেনের সমর্থন থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়ার কারণে কমলা হ্যারিস তাদের (ডেলিগেট) চেনেন। আমার বিশ্বাস, এই চার হাজার মানুষের সঙ্গে তার একাধিকবার দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। ফলে এমন আর কেউ নেই, প্রার্থী হিসেবে যার কথা বলা যায়।' ডেলিগেটরা কীভাবে প্রার্থী মনোনীত করেন? প্রতিটি রাজ্যে প্রার্থী বাছাইয়ের প্রাইমারি শেষ হওয়ার পর জেলা কংগ্রেশনাল সম্মেলন করে ডেলিগেট নির্বাচন করে ডেমোক্রেটিক পার্টি। জেলা সম্মেলনে ডেলিগেট হতে আগ্রহী রাজনৈতিক নেতাকর্মী প্রার্থিতা ঘোষণা করেন। কাছের কোনো হাইস্কুল বা অন্য কোনো জায়গায় যতটা পারা যায় প্রার্থীরা তাদের বন্ধুবান্ধব, শুভাকাঙ্ক্ষী ও সমর্থকদের জড়ো করেন। এরপর প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে ডেলিগেট নির্বাচনে লড়াই করেন। এভাবে তারা জাতীয় সম্মেলনের জন্য ডেলিগেট নির্বাচিত হন। ডেলিগেট নির্বাচনের এই প্রক্রিয়াটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় গণমান্য ও অভিজাতদের সমর্থন নিয়েই তারা ডেলিগেট হন। ফলে বলা যায়, তারা সমাজের শিক্ষক বা এ পর্যায়ের লোক। তারা কোনো না কোনো ইউনিয়নের সদস্য, কেউ দলীয় ভাবাদর্শের সামাজিক ইসু্য নিয়ে নেতৃত্বে রয়েছেন, কেউবা কাউন্টি কাউন্সিলর; আবার তাদের কেউ হয়তো রাজ্যের ডেলিগেট বা এমন কিছুর নেতৃত্বে রয়েছেন। ডেলিগেটরা স্থানীয় পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। কারণ তারা রাজনৈতিকভাবে খুবই সক্রিয়, ভোটে দাঁড়ান এবং লড়াই করে নির্বাচিত হয়ে আসেন। ডেমোক্রেটরা কি আলোচনা করছেন না? ১৯৬৮ ও ১৯৮০ সালে চাপের মুখে দুই প্রার্থী সরে দাঁড়ালেও ১৯৭৬ সালে ফোর্ডকে চ্যালেঞ্জ করে হেরে যান রিগান। প্রশ্ন উঠেছে, বাইডেনের বেলায় কী হতে চলেছে? এলাইন কামার্কের বক্তব্য হচ্ছে, ডেমোক্রেটরা পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। যেহেতু সবাই প্রেসিডেন্ট বাইডেনের প্রতিদিনকার জীবনযাপন কাছ থেকে দেখছেন না, ফলে তাদের সার্বিক বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করা ছাড়া উপায় নেই। তবে এ কথা বলা যায়, মানুষ এখন খুবই সতর্ক। তারা যথাসময়ই তাদের সঠিক রায় শুনিয়ে দেবে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে বাইডেনের সরে দাঁড়ানোর পক্ষে আওয়াজ জোরালো হচ্ছে। গত শুক্রবার বাইডেনের প্রচার শিবিরের জন্য সংগ্রহ করা ৯০ মিলিয়ন ডলার আটকে দিয়েছেন দাতারা। এ অবস্থায় বাইডেনের জন্য প্রার্থিতায় ইতি টানার পথই অবধারিত হয়ে উঠতে পারে। তথ্যসূত্র : সিএএন