ইসরাইলি সামরিক বাহিনী যে গাজার এলাকাটিকে ফিলিস্তিনিদের জন্য নিরাপদ বলে ঘোষণা করেছিল, সেখানেই ভয়াবহ বিমান হামলা চালিয়েছে তারা। এ ঘটনায় কমপক্ষে ৭১ জন নিহত এবং ২৮৯ জনের বেশি আহত হয়েছেন। শনিবার পশ্চিম খান ইউনিসের আল-মাওয়াসি এলাকায় এই হামলার ঘটনা ঘটে। তথ্যসূত্র : আল-জাজিরা, বিবিসি, রয়টার্স
এর আগে ওই এলাকাটিকে ইসরাইলি সামরিক বাহিনী 'মানবিক অঞ্চল' হিসেবে ঘোষণা দিয়ে ফিলিস্তিনিদের সেখানে আশ্রয় নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল।
ইসরাইলি একজন কর্মকর্তা বলেন, হামাসের সামরিক শাখার প্রধান মোহাম্মদ দেইফকে লক্ষ্য করে আল-মাওয়াসির এক 'উন্মুক্ত এলাকায়' হামলা করা হয়েছে। ওই এলাকায় কেবল হামাসের সদস্যরা ছিলেন। সেখানে কোনো বেসামরিক লোকজন ছিলেন না। খান ইউনিসে হামাসের কমান্ডার রাফা সালামাকেও এই হামলার লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সেখানে হামলা চালানো হয়েছে বলে দাবি করেছেন ওই কর্মকর্তা। ইসরাইলি সেনাবাহিনীর একটি রেডিও স্টেশন জানিয়েছে, এই হামলাকে 'খুব গুরুত্বপূর্ণ' বলে বর্ণনা করেছে সামরিক বাহিনী।
তবে হামাসের নেতাদের লক্ষ্যবস্তু করার ইসরাইলি দাবিকে মিথ্যা বলে অভিহিত করেছে হামাস। এক বিবৃতিতে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী এই গোষ্ঠী বলেছে, ফিলিস্তিনি নেতাদের লক্ষ্যবস্তু করার ইসরাইলি দাবি এটাই প্রথম নয়। অতীতেও তাদের এমন দাবি অসংখ্যবার মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।
আল-মাওয়াসির একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, হামলার স্থানটি দেখে মনে হচ্ছে, সেখানে বড় ধরনের 'ভূমিকম্প' আঘাত হেনেছে। ভিডিওতে দেখা যায়, ধ্বংসাবশেষ থেকে ধোঁয়া উড়ছে এবং স্ট্রেচারে করে হতাহতদের সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। লোকজনকে ?শূন্য হাতে বিশাল গর্তের ধ্বংসস্তূপে মরিয়া হয়ে উদ্ধার তৎপরতার চেষ্টা চালাতে দেখা গেছে।
হামাসের একজন কর্মকর্তা বলেন, ঘোষিত নিরাপদ অঞ্চলে ইসরাইলি বাহিনীর এই হামলা উত্তেজনার গুরুতর বৃদ্ধি। এর মাধ্যমে ইসরাইল যে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে পৌঁছতে আগ্রহী নয়, সেটি পরিষ্কার।
আল-মাওয়াসির কাছে কুয়েতের স্থাপিত একটি ফিল্ড হাসপাতালের ভিডিওতে ব্যাপক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি দেখা যায়। সেখানে হাসপাতালের মেঝেতে আহতদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। খান ইউনিসের নাসের মেডিকেলের চিকিৎসকরা বলেছেন, হাসপাতালে প্রচুর সংখ্যক হতাহত মানুষকে নিয়ে আসা হয়েছে। সেখানে চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনার মতো পরিস্থিতি নেই।
হামাসের সামরিক শাখা আল-কাসমি ব্রিগেডসের প্রধান মোহাম্মাদ দেইফ ইসরাইলের সামরিক বাহিনীর অন্যতম প্রধান টার্গেট। বন্দিদশা থেকে পালিয়ে এবং একাধিক হত্যাচেষ্টা থেকে বেঁচে ফেরা দেইফের অবস্থান ঘিরে ইসরাইলি বাহিনীর মাঝে ধোঁয়াশা রয়েছে।
গত ৭ অক্টোবর ইসরাইলে ঢুকে হামলা চালানোর অন্যতম পরিকল্পনাকারী হিসেবে মনে করা হয় তাকে। ওই দিন ইসরাইলে এক হাজার ২০০ জনকে হত্যা ও আরও ২৫১ জনকে ধরে নিয়ে গাজায় জিম্মি করে হামাস। পরে সেদিনই গাজায় সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করে ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী। গত ৯ মাস ধরে চলা ইসরাইল-হামাস যুদ্ধে গাজা উপত্যকায় ৩৮ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনির প্রাণহানি ঘটেছে।
যুদ্ধবিরতির চুক্তিতে বাধা সৃষ্টি করছেন নেতানিয়াহু
ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস ও দখলদার ইসরাইলের মধ্যে যুদ্ধবিরতির চুক্তি করতে চেষ্টা চালাচ্ছে মধ্যস্থতাকারী দেশগুলো। যুদ্ধবিরতি যেন হয়, সে জন্য হামাস তাদের কঠিন শর্ত থেকেও সরে এসেছে। তবে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এখন এই চুক্তিতে বাধা সৃষ্টি করছেন। ইসরাইলি এক কর্মকর্তা সংবাদমাধ্যম 'চ্যানেল-১২'-কে জানিয়েছেন, আলোচনা এখন যে অবস্থায় রয়েছে, সেটি অব্যাহত থাকলে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে চুক্তি করা সম্ভব। কিন্তু নেতানিয়াহু নতুন করে যেসব শর্ত দিয়েছেন, সেগুলো এই প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত, এমনকি থামিয়ে পর্যন্ত দিতে পারে।
তবে নেতানিয়াহুর দপ্তর থেকে এক বিবৃতিতে এসব অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। নেতানিয়াহু দাবি করেছেন 'হামাস পরিকল্পনা পরিবর্তন করছে'।
ইসরাইলি সংবাদমাধ্যমগুলোতে শুক্রবার খবর প্রকাশিত হয়, নেতানিয়াহু আলোচনার ক্ষেত্রে নতুন করে শর্ত জুড়ে দিয়েছেন। যার মধ্যে অন্যতম হলো গাজা ও মিসর সীমান্তবর্তী স্থানে ইসরাইলি সেনাদের অবস্থান অব্যাহত রাখা হবে এবং গাজার উত্তরাঞ্চলে হামাসের কোনো যোদ্ধাকে ফিরতে দেওয়া হবে না।
কিন্তু নেতানিয়াহুর এসব শর্ত যুদ্ধবিরতির আলোচনা ভন্ডুল করে দিতে পারে।
গত মে মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেন। তিনি দাবি করেন, ইসরাইলই এই প্রস্তাবটি দিয়েছে। বাইডেন ওই সময় জানান, যুদ্ধবিরতি হলে গাজা থেকে ইসরাইল তাদের সব সেনাকে প্রত্যাহার করে নেবে। কিন্তু এখন নেতানিয়াহু সেই অঙ্গীকার ভঙ্গ করছেন।
নেতানিয়াহুর কারণে যুদ্ধবিরতিটির এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে ইসরাইলি জিম্মিদের সংগঠন। তারা বলেছে, নেতানিয়াহু যে অবস্থান এখন নিয়েছেন এতে তারা 'শঙ্কিত এবং অবাক'। সবকিছু বাদ দিয়ে এখন যুদ্ধবিরতির দাবি জানিয়েছেন তারা।