যুক্তরাজ্যে সাধারণ নির্বাচন
কনজারভেটিভ পার্টির ভরাডুবি কেন
দলের কেউ কেউ যুক্তি দেন যে, টোরিদের ডানপন্থি মনোভাবই মূল সমস্যা ছিল। তাদের ডানপন্থি মনোভাবের কারণে সমাজের উদার মনোভাব সম্পন্ন ভোটাররা কনজারভেটিভ পার্টির কাছ থেকে দূরে সরে গেছেন। এসব ভোটার আর্থিকভাবে রক্ষণশীল হলেও সামাজিকভাবে উদার। সামনের দিনগুলোতে দলের ভেতরে অনেক চেষ্টা এবং আত্মানুসন্ধান হলেই কেবল এই প্রশ্নের উত্তর মিলবে...
প্রকাশ | ০৮ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি ডেস্ক
যুক্তরাজ্যের কনজারভেটিভ পার্টি অনেকটা ম্যানচেস্টার সিটি ফুটবল ক্লাবের মতো জয়লাভে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। বহু বছর ধরে ক্রমাগত জয়লাভ করতে থাকা নীল জার্সি-ধারী দলটির গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়রা জয়ের বাইরে অন্য কিছু খুব একটা ভাবতে পারতেন না। কিন্তু গত ১৪ বছর ধরে, পরপর চারটি নির্বাচনে টানা ক্ষমতায় থাকা কনজারভেটিভ পার্টি বিজয়ের যে ধারা তৈরি করেছিল, সেটির নাটকীয় সমাপ্তি ঘটেছে। এই ঘটনায় দলটির অনেক নেতা, নির্বাচনে বিজয়ী ও পরাজিত, সবাই প্রায় বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে এবং তারা এখনো এই বিষয়টিতে ধাতস্থ হওয়ার চেষ্টা করছে।
একজন বলেছিলেন যে, এই বিষয়টি কীভাবে ঘটল, তারা এখনো সেটি বুঝতে পারছে না। দলের কৌশল ও নেতৃত্বে কী ভুল ছিল? এবং ভবিষ্যতে কোনদিকে হাঁটতে হবে? সে বিষয়ে এখন আলাপ-আলোচনা শুরু হয়ে গেছে।
কনজারভেটিভ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে অনেকগুলো বিষয় বারবার উঠে এসেছে। অনেকে মনে করেন, লেবার পার্টি যেসব নীতি ঘোষণা করেছে, সেগুলো কনজারভেটিভদের চেয়ে খুব একটা আলাদা নয়। নীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কারা বেশি দক্ষ হবে সেটি ভোটাররা চিন্তা করেছে।
গত ১০ বছরেরও কম সময়ের মাঝে এই দল থেকে পাঁচজন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন। 'ব্রেক্সিট' ইসু্য থেকে শুরু করে কোভিড মহামারি, সেই সঙ্গে একাধিক নেতৃত্বের মাঝে প্রতিযোগিতা- এসব বিষয়ের কারণে দলে মতাদর্শগত বিভক্তি দেখা দিয়েছে। বিরোধী দলের দিকে নজর না দিয়ে কনজারভেটিভ পার্টির নেতারা একে অপরকে টেনে নামানোর জন্য শক্তি ব্যয় করেছেন। তারা নিজেদের মধ্যে দূরত্ব এবং ভুল বোঝাবুঝি দূর করার চেষ্টা করেননি।
দলকে ঘিরে নানা ধরনের কেলেঙ্কারির অভিযোগ সামনে আসছিল। এসব ঘটনা ঠিকমতো সমাধান না করে ক্ষণস্থায়ী সমাধানের চেষ্টা করা হয়েছিল। এর মধ্যে রয়েছে কোভিড লকডাউন-এর সময় পার্টি করা, যৌন অসদাচরণের অভিযোগ এবং মিনি বাজেট, যার ফলে সুদের হার বেড়েছিল।
নির্বাচনী প্রচারণার সময় সাবেক চিফ হুইপ স্যার মার্ক স্পেন্সারকে জিজ্ঞাসা করা হয়, দলের আচরণে কোনো সমস্যা আছে কিনা, তখন তিনি উলেস্নখ করেছিলেন, অন্য দলগুলোও খারাপ আচরণের জন্য তাদের এমপিদের বরখাস্ত করেছিল। তার এই বক্তব্য সত্যি। কিন্তু তিনি এটা স্বীকার করেছেন যে, এমন আচরণ বা বরখাস্তের ঘটনা খুব নিয়মিত হয়ে গেছে। এসব পরিবর্তন করার জন্য তাদের মাঝে নিঃসন্দেহে ইচ্ছা ছিল। সে জন্য তারা তাদের নির্বাচনী প্রচারণায় শ্রম শব্দ জুড়ে দিয়েছিলেন।
জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাওয়া, যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্য পরিষেবার (এনএইচএস) অবনতি এবং ছোট ছোট নৌকায় করে অবৈধভাবে আসা অভিবাসন বন্ধে কনজারভেটিভ পার্টির ব্যর্থতা; ভোটাররা এসব সমস্যার কথা বলেছেন এবং তারা অনুভব করেছেন- পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছিল।
এদিকে, আটবারের চেষ্টার পর প্রথমবারের মতো এমপি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ডানপন্থি 'রিফর্ম ইউকে' পার্টির নেতা নাইজেল ফারাজ। রিফর্ম ইউকে পার্টির নেতা নাইজেল ফারাজ নির্বাচনে ফিরে আসার বিষয়টি কনজারভেটিভ পার্টির জন্য এক ধরনের কাঁটা তৈরি করেছিল। কিছু ডানপন্থি ভোটার রিফর্ম ইউকে পার্টির দিকে ঝুঁকেছিল। তারা চান, যুক্তরাজ্যের আরও কঠোর অভিবাসন নীতি এবং আয়কর কমিয়ে আনা হোক।
বাগাড়ম্বরপূর্ণ কথাবার্তার কারণে কিছু মধ্যপন্থি টোরিদের ত্যাগ করেছিলেন। যেসব মধ্যপন্থি জেরেমি করবিনের অধীনে লেবার পার্টিকে ভোট দিতে চাননি, তাদের জন্য রিফর্ম ইউকে-কে ভোট দেওয়া স্বস্তিকর ছিল। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনে পরাজয় কি অনিবার্য ছিল? যদিও বেশিরভাগ টোরিই নির্বাচনের ফলকে 'অপ্রত্যাশিত নয়' বলেছেন। তবে কেউ কেউ মনে করেন, এই ভরাডুবিকে কিছুটা হলেও কমানো যেত।
প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের এমন গাফিলতি ছিল, যা এড়ানো যায় না। যেমন- তিনি গত ৬ জুন ডি-ডে (নরম্যান্ডি অবতরণ, যেটিকে সংক্ষেপে ডি-ডে বলে। ডি-ডেই ছিল নাৎসি বাহিনীর প্রথম বড় কোনো পরাজয়) স্মরণের দিন তাড়াতাড়ি চলে যান।
যদিও বরিস জনসনও প্রচুর গাফিলতি করেছিলেন। বরিস জনসনের কিছু ভক্ত মনে করেন যে, ঋষি সুনাক ভোটারদের কাছে এত আকর্ষণীয় ছিলেন যে, ভোটাররা তাকে আবার ভোট দেবেন। বরিস জনসনের ভক্তরা এখনো নির্বাচনী প্রচারে তাকে চাঙ্গা রাখতে 'বরিস! বরিস!' বলে চিৎকার করেন। সেই সঙ্গে ঋষি সুনাক কেন জুলাই মাসে নির্বাচনের ডাক দিয়েছিলেন, তা নিয়ে এখনো কারও কারও মাঝে এক ধরনের বিভ্রান্তি রয়েছে।
কনজারভেটিভ পার্টির প্রচার গুরু আইজ্যাক লেভিডো মনে করেন, নির্বাচনের তারিখ আরও পিছিয়ে দিলে দলের জন্য হয়তো ভালো হতো। কারণ, সরকার যেসব নীতি গ্রহণ করেছিল, সেগুলোর দৃশ্যমান প্রভাব দেখার জন্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করার প্রয়োজন ছিল। বিশেষ করে অবৈধ অভিবাসীদের রোয়ান্ডায় পাঠিয়ে দেওয়ার নীতি এবং সুদের হার কমানোর নীতি। এসব বিষয়ের ইতিবাচক ফল দেখার জন্য আরও কিছু সময়ের প্রয়োজন ছিল বলে মনে করেন লেভিডো।
কিন্তু তিনি সেই যুক্তিতে হেরে যান। কনজারভেটিভদের গ্রহণ করা নীতিগুলো যে কাজ করছিল না, সেটি ভোটাররা বুঝতে পেরেছিলেন। ভোটারদের সামনে কনজারভেটিভরা কোনো প্রমাণ হাজির করতে পারেননি। আইজ্যাক লেভিডোদের সমালোচকরা যুক্তি দিয়েছিলেন যে, টোরিদের জন্য আরও খারাপ খবর আসতে পারে, কারণ এই গ্রীষ্মে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে যুক্তরাজ্যে আসার ঘটনা বাড়ছিল। কারাগারে জায়গা না হওয়ার জন্য অনেক অপরাধীকে ছেড়ে দিয়েছিল এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও অধীনস্ত করে ফেলছিল। কিন্তু দলের নীতি ও মূল পরিচয় অনুযায়ী, রক্ষণশীলরা এ ছাড়া আর কী করতে পারতেন? যেহেতু দলের সীমাবদ্ধতা খুঁজে বের করার জন্য কাজ শুরু হয়েছে, তাই দলের দৃষ্টি এখানেই থাকবে এখন।
এরপর কে আসবেন?
ঋষি সুনাক নিশ্চিত করেছেন, তার উত্তরসূরি বেছে নেওয়ার ব্যবস্থা হয়ে গেলেই তিনি টোরি নেতা হিসেবে পদত্যাগ করবেন। তবে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে একধরনের আলোচনা চলছে যে, এই বিশৃঙ্খলা এড়াতে একজন অন্তর্র্বর্তীকালীন নেতাকে নিয়োগ দেওয়া হয় কি-না। এটি কি এমন কেউ হতে পারেন, যিনি আগে মন্ত্রিসভায় কাজ করেছিলেন? যেমন- স্যার অলিভার ডাউডেন, জেমস ক্লেভারল কিংবা জেরেমি হান্ট? যদি তাই হয়, তাহলে সম্ভবত এমন কাউকে হতে হবে, যিনি পুরো সময়ের জন্য দায়িত্ব নিতে চান না। অন্যথায়, পরবর্তী টোরি নেতৃত্ব খুঁজে পাওয়া আগ পর্যন্ত ঋষি সুনাকই দায়িত্বে থাকতে পারেন।
কিছু নেতা আছেন, যারা দীর্ঘদিন ধরে পর্দার আড়ালে কাজ করছেন। যার মধ্যে আছেন কেমি ব্যাডেনোচ এবং টম টুগেনধাত। সুয়েলা ব্র্যাভারম্যান এবং রবার্ট জেনরিককেও চেষ্টা করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তারা দু'জনেই দলের ভেতরে সুনজরে আছেন এবং অভিবাসন সংক্রান্ত বিষয়ে সরকারের সমালোচনা করেছেন।
কনজারভেটিভ পার্টির নেতৃত্বে আসার জন্য আর কারা লড়তে পারেন- এ বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করাটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে। নতুন টোরি এমপি কারা এবং ২০২২ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বরের টোরি নেতৃত্বের প্রতিযোগিতায় তারা কাকে সমর্থন করেছিলেন, সে সম্পর্কে জানার চেষ্টা করা হয়। মজার বিষয় হলো, তাদের বেশিরভাগই সুনাক-সমর্থক। লিজ ট্রাসের সমর্থকদেরও একটি বিশাল অংশ রয়েছে। সুয়েলা ব্রাভারম্যান এবং কেমি ব্যাডেনোচ তাদের কয়েকজন ডানপন্থি মিত্রকে হারিয়েছেন। টুগেনধাতেরও কয়েকজন সমর্থক চলে গেছেন। বাকি এমপিরা কোন দিকে ঝুঁকবেন, সেটি কেন গুরুত্বপূর্ণ? এর একটা কারণ আছে। সেটি হচ্ছে, এর মাধ্যমে নির্ধারিত হবে কনজারভেটিভ পার্টি ভবিষ্যতে কোন দিকে যাবে।
এটি কি ব্যাডেনচ, ব্র্যাভারম্যান বা জেনরিকের মতো ডানপন্থি কাউকে নির্বাচিত করার সিদ্ধান্ত নেবে? যাতে করে তারা রিফর্ম ইউকে'র ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে রোধ করতে পারে? রিফর্ম ইউকে এবারের নির্বাচনে বেশ কয়েকটি আসন থেকে জয়লাভ করেছে। দলের কেউ কেউ বলেন, অভিবাসনের মতো ইসু্যতে কঠোর না হওয়াটাই তাদের পতনের কারণ।
টুজেন্ডহাট অথবা জেরেমি হান্ট-এর মতো নেতা নির্বাচন করে কনজারভেটিভ পার্টি কি নিজেকে মধ্যপন্থার দিকে নিয়ে যাবেন? রাজনৈতিক অঙ্গনে লেবার পার্টি যে জায়গাটি দখল করে আছে, সেটি কি কনজারভেটিভরা পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করবে?
দলের কেউ কেউ যুক্তি দেন যে, টোরিদের ডানপন্থি মনোভাবই মূল সমস্যা ছিল। তাদের ডানপন্থি মনোভাবের কারণে সমাজের উদার মনোভাব সম্পন্ন ভোটাররা কনজারভেটিভ পার্টির কাছ থেকে দূরে সরে গেছেন। এসব ভোটার আর্থিকভাবে রক্ষণশীল হলেও সামাজিকভাবে উদার। সামনের দিনগুলোতে দলের ভেতরে অনেক চেষ্টা এবং আত্মানুসন্ধান হলেই কেবল এই প্রশ্নের উত্তর মিলবে। তথ্যসূত্র : বিবিসি নিউজ