যুক্তরাজ্যের সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনে যেসব ইসু্য নিয়ে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো প্রচারণা চালিয়েছিল, তার মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল অভিবাসন। কনজারভেটিভ পার্টি অবশ্য বরাবরই তাদের প্রচারে অভিবাসনের প্রশ্নটিকে খুবই গুরুত্ব দিয়ে থাকে, তবে এবার লেবার পার্টিও ঠিক সেই একই রাস্তায় হেঁটেছে। বিদেশ থেকে যত লোক যুক্তরাজ্যে গেছেন এবং যত লোক যুক্তরাজ্য ছাড়ছেন, এই দুয়ের মধ্যে যে ব্যবধান- সেই 'নেট মাইগ্রেশন লেভেল'টা অবশ্য উভয় দলই কমিয়ে আনার প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছিল। ভোটের আগে একটি প্রথম সারির বেসরকারি সংস্থার করা জরিপেও দেখা গিয়েছিল, দেশের ৪৩ শতাংশ লোক মনে করেন, অভিবাসন ব্রিটিশ সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। আর অভিবাসন ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে জানিয়েছিলেন ৩৭ শতাংশ লোক। কিন্তু নির্বাচনে জয়ী লেবার পার্টির অভিবাসন নীতিতে ঠিক কী কী জিনিস ছিল? কনজারভেটিভ পার্টি বা টোরিদের অভিবাসন নীতির সঙ্গে সেগুলোর পার্থক্যই বা কী? এই প্রতিবেদনে ঠিক সেই বিষয়গুলোই তুলে ধরা হয়েছে। ডিঙি নৌকায় অবৈধ অভিবাসন প্রতি বছর হাজার হাজার লোক ইউরোপের মূল ভূখন্ড থেকে ডিঙি বা ছোট নৌকায় চেপে ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে ভিসা ছাড়াই যুক্তরাজ্যে প্রবেশ করার চেষ্টা করে থাকেন। সাগর পেরিয়ে আসা এই নৌকাগুলোকে যুক্তরাজ্যের উপকূলে ভেড়ার আগেই আটকে দেওয়া হবে, যেটাকে বলা হয় 'স্টপ দ্য বোটস'- তা কিন্তু দুই প্রধান দলেরই প্রতিশ্রম্নতিতে অন্তর্ভু?ক্ত ছিল। চলতি বছরের প্রথম কয়েক মাসে (৭ জুন পর্যন্ত) চ্যানেল পেরিয়ে মোট ১১ হাজার ৯৫ জন অভিবাসী যুক্তরাজ্যে প্রবেশ করেছেন। গত বছর (২০২৩) ও তার আগের বছরের (২০২২) একই সময় পর্যন্ত যতজন অবৈধ অভিবাসী যুক্তরাজ্যের সাগরতটে এসে নামেন, এবারের সংখ্যাটি তার তুলনায় যথাক্রমে ৪৬ ও ১১ শতাংশ বেশি। এই রুটে অবৈধ অভিবাসন আটকানোর জন্য টোরি সরকার ফ্রান্সের সঙ্গে সহযোগিতা বৃদ্ধি করেছিল, যাতে ওই নৌকাগুলোকে ব্রিটিশ জলসীমায় প্রবেশ করার আগেই আটকে দেওয়া যায়। এ ছাড়া মানব পাচারকারীদের চক্রগুলোর মোকাবিলা করতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সমঝোতাও সই করেছিল তারা। তবে এ ব্যাপারে ঋষি সুনাক সরকারের সবচেয়ে কঠোর ও বিতর্কিত পদক্ষেপ ছিল 'রোয়ান্ডা নীতি' ঘোষণা করা; যার আওতায় অবৈধ অভিবাসীদের যুক্তরাজ্যে না রেখে সোজা আফ্রিকার দেশ রোয়ান্ডায় পাঠিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল। কনজারভেটিভ পার্টির বক্তব্য ছিল, এই রোয়ান্ডা নীতি অবৈধ অভিবাসীদের যুক্তরাজ্যে আসতেই নিরুৎসাহিত করবে। আর লেবার পার্টির অবস্থান হলো, রোয়ান্ডা নীতি বাস্তবায়নের নামে যে অর্থ খরচ করা হচ্ছে, তারা সেটা অভিবাসন রোখার জন্য আইন প্রয়োগের ('এনফোর্সসেন্ট') কর্মকান্ডে খরচ করবে। নির্বাচনী প্রচারণার শুরুতেই তারা যে নীতিগুলো ঘোষণা করে, তার অন্যতম ছিল, যেসব অপরাধী চক্র এই ডিঙি নৌকাগুলোতে মানুষ পাঠায়, তাদের বিচারের আওতায় আনতে একটি নতুন 'বর্ডার সিকিওরিটি কমান্ড' গঠন করা হবে। নির্বাচিত হলে লেবার পার্টি 'পরিবর্তনের প্রথম যেসব পদক্ষেপ' নেবে বলে ঘোষণা করেছিল, তার তিন নম্বরেই ছিল 'শত শত নতুন বিশেষজ্ঞ তদন্তকারী' নিয়োগ করার কথা। বলা হয়েছিল, এরা জঙ্গি দমনের বিশেষ ক্ষমতা ব্যবহার করে এই 'বোট গ্যাং'গুলোকে নির্মূল করার কাজ চালাবে। এ ছাড়া লেবার পার্টি জানিয়েছে, তারা অবৈধ অভিবাসন রুখতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে নিরাপত্তা সহযোগিতা বাড়াবে, সন্দেহভাজন পাচারকারীদের তলস্নাশি ও তাদের আর্থিক লেনদেন মনিটর করার জন্য পুলিশকে অতিরিক্ত ক্ষমতা দেবে এবং ইইউ-ভুক্ত দেশগুলো যাতে অবৈধ অভিবাসীদের ফিরিয়ে নেয়, সেজন্য ইইউ-এর সঙ্গে নতুন সমঝোতা করার আলোচনা করবে। রোয়ান্ডা নীতিতে ভিন্ন অবস্থান অভিবাসনের ইসু্যতে যে প্রশ্নটিতে কনজারভেটিভ ও লেবারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভিন্নতা; তা অবশ্যই বিতর্কিত রোয়ান্ডা নীতি। গত এপ্রিল মাসেই ঋষি সুনাক সরকারের আনা 'সেফটি অব রোয়ান্ডা বিল' পার্লামেন্টে পাস হওয়ার পর আইনে পরিণত হয়েছে। এর ফলে যদি কেউ বিশ্বের কোনো 'নিরাপদ দেশ' থেকে এসে অবৈধভাবে যুক্তরাজ্যে প্রবেশ করেন, তাহলে তাকে আফ্রিকার ওই দেশটিতে পাঠিয়ে দেওয়া যাবে এবং তিনি সেখান থেকে অ্যাসাইলামের (আশ্রয়) আবেদন করতে পারবেন। লেবারের নির্বাচনী ইশতেহারে পরিষ্কার বলা হয়েছে, তারা ক্ষমতায় এলে রোয়ান্ডা পরিকল্পনা পুরোপুরি বাতিল করা হবে। সুতরাং সেক্ষেত্রে অবৈধ অভিবাসীদের নিয়ে কোনো বিমান রোয়ান্ডার উদ্দেশে রওনা দেবে না। তবে এতদিন যিনি লেবার পার্টির শ্যাডো হোম সেক্রেটারি (ছায়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) ছিলেন, সেই ইয়িভেট কুপার কিন্তু অবৈধ অভিবাসীদের অ্যাসাইলামের আবেদন বাইরের কোনো দেশে 'প্রসেস' করার সম্ভাবনা নাকচ করে দেননি। লেবার পার্টির নেতা স্যার কিয়ের স্টারমারও গত বছর জানিয়েছিলেন, অভিবাসীদের আবেদন তৃতীয় কোনো দেশে 'প্রসেস' করার লক্ষ্যে একটি 'অফশোর স্কিম' তারাও বিবেচনা করবেন; তবে সেই তৃতীয় দেশটি ওই অভিবাসীকে শেষ পর্যন্ত যেখানে ফেরত পাঠানোর কথা ভাবা হচ্ছে সাধারণত সেই রুটেই হবে। তবে আন্তর্জাতিক আইনি সনদগুলোর প্রতি যুক্তরাজ্যের অঙ্গীকার রক্ষিত হবে বলে লেবার পার্টি কথা দিয়েছে। তাদের ইশতেহারেও পরিষ্কার জানানো হয়েছে, 'দ্ব্যর্থহীনভাবে আমরা বলতে চাই যুক্তরাজ্য অবশ্যই ইসিএইচআরের (ইউরোপীয়ান কমিশন অন হিউম্যান রাইটস) সদস্য থাকবে।' তবে যে অভিবাসীরা ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে এরপরও ঢুকবেন, তাদের যুক্তরাজ্যে থেকেই অ্যাসাইলামের আবেদন করতে দেওয়ার পুরনো ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া হবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে। 'অ্যাসাইলাম ব্যাকলগ' ২০১৮ থেকে ২০২২ সালের ভেতরে যুক্তরাজ্যে অ্যাসাইলাম সিকার বা আশ্রয়প্রার্থীদের আবেদনের পাহাড় জমতে শুরু করে, যেগুলো প্রসেসই করা যায়নি। ২০২৩ থেকে অবশ্য 'ব্যাকলগে'র সেই সংখ্যাটা কিছুটা হলেও কমতে শুরু করেছে। চলতি বছরের মার্চের শেষে হোম অফিসের (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়) পরিসংখ্যান বলছে, তখন পর্যন্ত মোট এক লাখ ১৮ হাজার ৩২৯ আবেদনকারী যুক্তরাজ্যে তাদের অ্যাসাইলামের ব্যাপারে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত জানার অপেক্ষায় রয়েছেন। বস্তুত ২০১০ সালের তুলনায় যুক্তরাজ্যে 'অ্যাসাইলাম রিমুভালে'র সংখ্যাও (অর্থাৎ? আবেদনকারীদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর সংখ্যা) প্রায় ৪০ শতাংশ কমে গেছে। লেবার পার্টি প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছে, এ পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে তারা নতুন এক হাজার 'কেসওয়ার্কার' নিয়োগ করে একটি 'রিটার্নস অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট ইউনিট' গঠন করবে। তাদের ইশতেহারে বলা হয়েছে, নিরাপদ দেশ থেকে আসা যেসব লোকের এখানে থাকার অধিকার নেই, তাদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া 'ফাস্ট-ট্র্যাক' বা ত্বরান্বিত করতে এই ইউনিট কাজ করবে। ফেরত পাঠানোর আরও নতুন নতুন ব্যবস্থা চালু করতেও আলোচনা চালানো হবে। লেবার পার্টি আরও বলেছে, এই কাজের জন্য তারা দেশের ভেতরে ও বাইরে সিভিল সার্ভেন্টদের নিয়োগ করবে। বিদেশে নিযুক্ত কর্মকর্তারা সেসব দেশের অভিবাসীকে ফেরানো নিয়ে ওই দেশের সঙ্গে সমঝোতা আলোচনা করবেন। আর এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অর্থ আসবে অ্যাসাইলাম আবেদনের 'ব্যাকলগ ক্লিয়ার করে'। কারণ এখন আশ্রয়প্রার্থীদের হোটেলে রাখতে যে অর্থ খরচ হচ্ছে, তার অনেকটাই তখন সাশ্রয় করা সম্ভব হবে। 'বৈধ অভিবাসন' নিয়ে লেবার যা বলছে বৈধ পথে যুক্তরাজ্যে সবচেয়ে বেশি অভিবাসন হয়ে থাকে মূলত দুটো পদ্ধতিতে; ওয়ার্ক মাইগ্রেশন ও স্টুডেন্ট মাইগ্রেশন। প্রথমটা বিশেষভাবে দক্ষ কর্মীদের জন্য, দ্বিতীয়টা শিক্ষার্থীদের জন্য। ওয়ার্ক মাইগ্রেশনের আওতায় যুক্তরাজ্যে সবচেয়ে বেশি লোক আসেন 'স্কিলড ওয়ার্কার ভিসা'য়। এখানে প্রার্থীকে কোনো সংস্থায় চাকরি নিয়ে আসতে হয়; সেই নিয়োগকর্তার তাকে 'স্পন্সর' করতে হয়, এ ছাড়া প্রার্থীর দক্ষতা ও বেতনের ক্ষেত্রেও পূরণ করতে হয় বিশেষ কয়েকটি শর্ত। গত ২ জুন স্যার কিয়ের স্টারমার ঘোষণা করেছিলেন, যুক্তরাজ্যে আরও বেশি বেশি সংখ্যক কর্মীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে এবং কাজের উপযুক্ত পরিবেশ রক্ষা করে তারা 'নেট মাইগ্রেশন'র সংখ্যা কমিয়ে আনবেন। তিনি আরও জানান, যেসব নিয়োগকর্তা ব্যবসা চালানোর জন্য বিদেশ থেকে দক্ষ কর্মী আনার ওপরই নির্ভরশীল, তাদের সেই প্রবণতা বন্ধ করার জন্য আইন আনা হবে। এ ছাড়া লেবার পার্টি যুক্তরাজ্যের নিজস্ব কর্মীদের বেশি করে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্যও আইন আনবে, যাতে কোম্পানিগুলোকে বিদেশ থেকে কর্মী নিয়োগ করতে না হয়। তবে স্বাস্থ্য খাতের কর্মী ও সেবা প্রদানকারীদের (কেয়ার ওয়ার্কার) বিদেশ থেকে নিজের পরিবারের সদস্যদের যুক্তরাজ্যে আনার ক্ষেত্রে যে নিষেধাজ্ঞা আছে, তা পরিবর্তন করার কোনো 'পরিকল্পনা নেই' বলেও লেবার পার্টি জানিয়েছে। লেবারের ইশতেহারেও 'নেট মাইগ্রেশন' (যতজন আসছেন আর যতজন ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, তার ব্যবধান) কমিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে; তবে তারা এজন্য কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেনি। ২০১৯ সাল থেকে ব্রিটেনের 'নেট মাইগ্রেশনে' এককভাবে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের। বিদেশ থেকে আসা ছাত্রছাত্রী যুক্তরাজ্যে তাদের গ্র্যাজুয়েশন (স্নাতক স্তরের পড়াশোনা) শেষ করার পর দুই বছর সে দেশে বসবাস ও কাজ করতে পারেন। যদি ওই শিক্ষার্থী পিএইডি ডিগ্রিধারী স্নাতক হন, তাহলে তার ক্ষেত্রে এই সময়সীমা হলো তিন বছর। তবে তখন ওই ছাত্রছাত্রীদের স্টুডেন্ট ভিসাকে 'গ্র্যাজুয়েট ভিসা'য় বদলে নিতে হয়। চলতি বছরের জানুয়ারিতে কনজারভেটিভ সরকার বেশিরভাগ বিদেশি শিক্ষার্থীর যুক্তরাজ্যে তাদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আসার নিয়মটি বাতিল করে দিয়েছে। শুধু পোস্টগ্র্যাজুয়েট (স্নাতকোত্তর) রিসার্চ কোর্সের ছাত্রছাত্রী এই নিষেধাজ্ঞা থেকে ছাড় পেয়েছেন। লেবারের এতদিন যিনি শ্যাডো হোম মিনিস্টার ছিলেন, সেই ইয়িভেট কুপার আগেই জানিয়েছেন তারা জিতে ক্ষমতায় এলে এই পরিবারের সদস্যদের আনার নিষেধাজ্ঞাটি বহাল রাখা হবে। তবে যে 'গ্র্যাজুয়েট ভিসা' পদ্ধতিতে পড়াশোনা শেষ করার পরও ছাত্রছাত্রী দুই বা তিন বছর আরও থাকা, কিংবা কাজ করার সুযোগ পান, সেই পদ্ধতি পুনর্বিবেচনা করা হবে কি-না, তা নিয়ে লেবার পার্টি কিছু জানায়নি। তথ্যসূত্র : বিবিসি নিউজ