ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মীরে একের পর এক সশস্ত্র হামলার পর দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তাদের দমনে যেসব ব্যবস্থাপনা আছে, তা যেন অতি দ্রম্নত সেখানে কাজে লাগানো হয়। গত রোববার থেকে শুরু হয়ে পরপর কয়েকটি সশস্ত্র হামলা ও তিন জায়গায় অস্ত্রধারীদের সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘর্ষ হয়েছে। ওইসব ঘটনায় ৯ জন হিন্দু তীর্থযাত্রী, একজন কেন্দ্রীয় বাহিনীর সদস্য ও দুজন সন্দেহভাজন সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্য নিহত হয়েছেন।
কাশ্মীরের পুলিশ সন্দেহ করছে, নতুন কোনো সশস্ত্র গোষ্ঠী জম্মু-কাশ্মীরে প্রবেশ করে এই হামলাগুলো চালাচ্ছে। আরও অস্ত্রধারী কাঠুয়া আর ডোডা অঞ্চলে লুকিয়ে থাকতে পারে বলে সন্দেহ করছে পুলিশ। তাই অচেনা ব্যক্তি বা সন্দেহজনক বস্তুর ব্যাপারে এলাকার বাসিন্দাদের সতর্ক করে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে পুলিশ, এমনটাই খবর সংবাদ সংস্থা পিটিআইয়ের।
কী নির্দেশ দিলেন নরেন্দ্র মোদি
জম্মু-কাশ্মীরে লাগাতার সশস্ত্র হামলার পরিপ্রেক্ষিতে গত বৃহস্পতিবার রাতে প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালসহ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বৈঠকে বসেছিলেন। সংবাদ সংস্থা 'এএনআই' জানিয়েছে, বৈঠকে জম্মু-কাশ্মীরের সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি প্রধানমন্ত্রীর সামনে ব্যাখ্যা করেন ডোভালসহ পদস্থ কর্মকর্তারা। সশস্ত্র গোষ্ঠী দমনে নিরাপত্তা বাহিনী এবং এজেন্সিগুলো কী কী ব্যবস্থা নিচ্ছে, তারও বিস্তারিত জানানো হয় বৈঠকে।
এরপরই মোদি নির্দেশ দেন, সশস্ত্র গোষ্ঠী দমনের যত ব্যবস্থাপনা আছে, তার প্রত্যেকটিকে কাজে লাগাতে হবে। বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনী ও এজেন্সির মধ্যে সমন্বয় সাধন করে সম্ভাব্য হুমকিগুলোর মোকাবিলা করার কথা বলেছেন মোদি, সরকারি সূত্রগুলো উদ্ধৃত করে জানিয়েছে এএনআই। বাড়তি নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর সঙ্গে আলাদা করেও কথা বলেছেন নরেন্দ্র মোদি।
গত রোববার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তৃতীয়বার শপথ নেওয়ার দিনই এই সপ্তাহের প্রথম সশস্ত্র হামলা হয় জম্মু-কাশ্মীরের রিয়াসি জেলায়। হিন্দু তীর্থযাত্রীদের বহন করা একটি বাসের ওপর হামলা চালায় অস্ত্রধারীরা, যাতে ৯ জনের মৃতু্য হয়। এরপর কাঠুয়া ও ডোডা জেলায় পরপর সশস্ত্র ব্যক্তি ও নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে।
হিন্দু তীর্থযাত্রীদের ওপর হামলা
গত রোববার রিয়াসিতে তীর্থযাত্রীদের একটি বাসে হামলার মধ্য দিয়ে সাম্প্রতিক সশস্ত্র হামলাগুলোর সূত্রপাত। জম্মুর রিয়াসিতে তীর্থযাত্রীদের একটি বাস লক্ষ্য করে গুলি চালাতে থাকে অস্ত্রধারী ব্যক্তিরা। বাসটি খাদে পড়ে যাওয়ার পরও গুলি বৃষ্টি চলতে থাকে বলে ওই বাসের জীবিত যাত্রীরা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন। ওই ঘটনায় বাসটির চালক এবং কন্ডাক্টরসহ ৯ জন মারা যান ও ৩৩ জন আহত হন।
হামলায় আহত অতুল মিশ্র সংবাদ সংস্থা 'পিটিআই'কে বলেন, 'আমাদের বাসটি শিবখোরি থেকে কাটরা যাচ্ছিল। হঠাৎই একজন অস্ত্রধারী গুলি চালাতে শুরু করে, যার পরে আমরা বাসে শুয়ে পড়ি। তখনই বাসটি খাদে পড়ে যায়। গোলাগুলি থেমে গেলে কিছু লোক আমাদের খাদ থেকে তুলে আনে এবং তারপর অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নিয়ে যায়।'
চলতি বছরে জম্মু ও কাশ্মীরে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর এটিই সব থেকে বড় প্রাণঘাতী হামলা। তবে আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, হামলাটি এমন একটি এলাকায় সংঘটিত হয়েছে, যা এর আগে শান্তিপূর্ণ বলেই বিবেচিত হতো। রিয়াসি হামলার সময়ে বাসটিতে অন্তত ৫০ জন যাত্রী ছিলেন। বাসের নিহত চালক ও কন্ডাক্টর জম্মুর বাসিন্দা। নিহতদের মধ্যে চারজন রাজস্থানের এবং তিনজন উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা।
একই দিনে দুই জায়গায় সংঘর্ষ
রিয়াসির ঘটনার পর জম্মুর কাঠুয়া ও ডোডায় অস্ত্রধারীদের সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর তিনটি সংঘর্ষ হয়েছে, যার সর্বশেষটি শুরু হয় বৃহস্পতিবার। সংবাদ সংস্থা 'পিটিআই' জানিয়েছে যে, বৃহস্পতিবার বিকাল থেকে কাঠুয়া জেলার সাইদা সুখাল গ্রামটি ঘিরে ফেলে তলস্নাশি অভিযান শুরু করে নিরাপত্তা বাহিনী। সেখানে দুজন অস্ত্রধারী লুকিয়ে থাকতে পারে, গোপন সূত্রে এই খবর পেয়ে তলস্নাশি চালানো হচ্ছে বলে সংবাদ সংস্থা জানিয়েছে।
জম্মু পুলিশ এক বিবৃতি দিয়ে বলেছে, ১১ জুন সন্ধ্যায় সাইদা সুখাল গ্রামে দুই ব্যক্তি আসে। কয়েকটি বাড়িতে তারা পানি চাইতে গেলে গ্রামবাসীর সন্দেহ হয়। গ্রামবাসী দরজা বন্ধ করে দেয়। এ সময় কেউ কেউ চেঁচামেচি শুরু করলে অস্ত্রধারী এই ব্যক্তিরা আতঙ্কিত হয়ে শূন্যে গুলি চালাতে শুরু করে। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হন গ্রামের এক ব্যক্তি। তার চিকিৎসা চলছে। এরপরই নিরাপত্তা বাহিনী চলে যায় গ্রামটিতে এবং সশস্ত্র ব্যক্তিদের সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু হয়।
কাঠুয়ার ওই গ্রামটিতে নিরাপত্তা বাহিনীর প্রথম অভিযানটি চলে প্রায় ১৫ ঘণ্টা। দীর্ঘ ওই অপারেশনের পর দুজন সন্দেহভাজন অস্ত্রধারী ব্যক্তিকে মৃত অবস্থায় খুঁজে পান নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। কেন্দ্রীয় বাহিনীর এক সদস্যও ওই সংঘর্ষে মারা গেছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।
পুলিশ জানিয়েছে, 'মৃতদেহ দুটির কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণে গুলিসহ একটি এম-ফোর রাইফেল, একটি একে অ্যাসল্ট রাইফেল, একটি স্যাটেলাইট ফোন এবং দুই লাখ ১০ হাজার ভারতীয় রুপি পাওয়া গেছে। এছাড়াও পাকিস্তানে প্রস্তুত খাদ্যদ্রব্য, ওষুধ ও কিছু বৈদু্যতিক যন্ত্রও উদ্ধার করা হয়েছে। মৃতদের একজন জৈশ-এ-মুহম্মদের বড়মাপের সদস্য বলে মনে করছে নিরাপত্তা বাহিনী।' একই দিনে ডোডা জেলাতেও মঙ্গলবার বিকাল থেকে সশস্ত্র ব্যক্তিদের সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর পৃথক একটি সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে।
জম্মুর পীরপাঞ্জালে বাড়ছে
সশস্ত্র হামলা
জম্মু অঞ্চলের পুঞ্চ এবং রাজৌরি জেলা দুটি পীরপাঞ্জাল পর্বতমালার মধ্যে পড়ে। গত মাসে পুঞ্চ জেলার সুরানকোটে ভারতীয় বিমান বাহিনীর একটি কনভয়ে হামলা চালায় সশস্ত্র ব্যক্তিরা। এতে বিমান বাহিনীর এক সদস্য নিহত ও চারজন আহত হন। এরপরই ওই এলাকায় ব্যাপক তলস্নাশি অভিযান চালায় নিরাপত্তা বাহিনী, যা বেশ কয়েকদিন ধরে চলে। সশস্ত্র ব্যক্তিদের অবশ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি।
আবার ৩১ মে পুঞ্চের মারহা বুফলিয়াজে রাতভর তলস্নাশি অভিযানের সময় নিরাপত্তা বাহিনী ও সশস্ত্র ব্যক্তিদের মধ্যে গুলি বিনিময় হয়। কিন্তু অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে অস্ত্রধারীরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
রিয়াসিতে তীর্থযাত্রীদের বাসের ওপর এই হামলার ঘটনা ২০২২ সালের পর জম্মুতে তীর্থযাত্রীদের ওপর দ্বিতীয় হামলা। প্রথম হামলা হয়েছিল ২০২২ সালের মে মাসে। হিন্দু তীর্থস্থান বৈষ্ণোদেবী থেকে ফেরার পথে একটি বাসে আগুন লাগে। এতে চার তীর্থযাত্রী নিহত ও ২৪ জন আহত হন। প্রাথমিক তদন্তে এটিকে দুর্ঘটনা বলা হলেও পরে জানা যায় ওই বাসে বোমা রেখে দেওয়া হয়েছিল। সেই বোমা বিস্ফোরণেই বাসে আগুন ধরে যায়।
বছর তিনেক ধরে, ২০২১ সাল থেকে জম্মুর পীরপাঞ্জাল অঞ্চলের রাজৌরি ও পুঞ্চ জেলায় সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো বেশ কয়েকটি হামলা চালিয়েছে এবং এতে নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এসব ঘটনায় গত বছর জম্মু অঞ্চলে মোট ১৯ জন সেনা সদস্য নিহত হয়েছেন। গত দুই বছরে পীরপাঞ্জলে দুই ডজনেরও বেশি সেনা সদস্য নিহত হয়েছে। 'সাউথ এশিয়া টেররিজম পোর্টাল'র তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে জম্মু ও কাশ্মীরে নিরাপত্তা বাহিনীর হতাহতের ঘটনা বেড়েছে। তথ্যসূত্র : বিবিসি নিউজ