গাজায় যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব নিয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে হামাস। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠনটি বলেছে, তাদের 'ইতিবাচক' সাড়া এ উপত্যকায় আট মাস ধরে চলা যুদ্ধের অবসানে একটি চুক্তিতে পৌঁছার ক্ষেত্রে 'সুপ্রশস্ত পথ' খুলে দিয়েছে। তারা চায় এমন এক যুদ্ধবিরতি, যার মধ্য দিয়ে গাজায় বৈরিতার স্থায়ী অবসান ঘটবে।
হামাসের এমন ইতিবাচক মনোভাবের পরও এই সংগঠন বা ইসরাইল কোনো পক্ষ চুক্তি সইয়ের ব্যাপারে প্রকাশ্যে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত না করায় ওই প্রস্তাবের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত বলে বিশ্লেষকরা জানাচ্ছেন।
গত ৩১ মে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ঘোষিত গাজা যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবের ওপর গত মঙ্গলবার ওই আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায় হামাস। তবে ইসরাইল বলেছে, এই সাড়া প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করারই শামিল। কেননা হামাসের এক কর্মকর্তা বলেছেন, বর্তমান পরিকল্পনায় তাদের দীর্ঘদিনের দাবির প্রতিফলন নেই।
প্রস্তাবের ওপর হামাসের প্রতিক্রিয়া পাওয়ার কথা জানিয়েছে গাজায় যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার মধ্যস্থতাকারী মিসর ও কাতার। তবে এর বিষয়বস্তু প্রকাশ করা হয়নি।
বুধবার হামাসের রাজনৈতিক বু্যরোর সদস্য ইজ্জাত আল-রিশক বলেন, এক বিবৃতিতে হামাস যে জবাব দিয়েছে, তা 'দায়িত্বশীল, গুরুত্বপূর্ণ ও ইতিবাচক'। এটি যুদ্ধবিরতি বিষয়ে চুক্তি সইয়ের 'এক সুপ্রশস্ত পথ' খুলেছে।
আগের দিন মঙ্গলবার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হামাসের আরেক কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেছেন, প্রতিক্রিয়ায় হামাসের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। তাদের অবস্থান হলো, এ যুদ্ধবিরতির মধ্য দিয়ে গাজায় বৈরিতার স্থায়ী অবসান, ইসরাইলি সেনাদের প্রত্যাহার, গাজা উপত্যকার পুনর্গঠন ও ইসরাইলি কারাগারে থাকা ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তি দিতে হবে।
এ কর্মকর্তা আরও বলেন, 'আমরা আমাদের আগের অবস্থানই পুনর্ব্যক্ত করছি। আমি মনে করি, এর মধ্যে বড় ধরনের কোনো ফারাক নেই। বল এখন ইসরাইলের কাছে।'
ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, ইসরাইল তাদের প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। যদিও ইসরাইল প্রকাশ্যে এমন কিছু বলেনি।
সম্প্রতি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদেও বাইডেনের ওই প্রস্তাব প্রায় সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়েছে। প্রস্তাবটির পক্ষে ভোট পড়ে ১৪টি। বিপক্ষে কোনো ভোট না পড়লেও মার্কিন সমর্থিত প্রস্তাবটি নিয়ে রাশিয়া ভোটদানে বিরত ছিল।
এই প্রস্তাব পাস হওয়া সত্ত্বেও গাজায়, বিশেষ করে এর কেন্দ্র ও দক্ষিণাঞ্চলে পুরোদমে তান্ডব চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল। এতে প্রতিদিনই ঘটছে ব্যাপক প্রাণহানি। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বারবারই বলছেন, হামাসকে নির্মূল না করা পর্যন্ত গাজায় অভিযান শেষ করবে না ইসরাইল।
এদিকে ইসরাইলের এক কর্মকর্তা মঙ্গলবার বলেন, মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে তারা হামাসের জবাব জানতে পেরেছেন। হামাস তাদের সাড়ায় 'প্রস্তাবের প্রধান ও সবচেয়ে অর্থপূর্ণ বিষয়াবলি বদলে দিয়েছে'। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এ কর্মকর্তা বলেন, হামাস জিম্মি মুক্তির বিষয় নাকচ করে দিয়েছে।
ইতোমধ্যে, তেল আবিবে ইসরাইলি কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি বিস্নঙ্কেন। হামাসের মন্তব্যকে 'আশার চিহ্ন' বলে আখ্যায়িত করেছেন তিনি। তবে বলেছেন, এটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নয়।
তেল আবিবে সাংবাদিকদের অ্যান্টনি বিস্নঙ্কেন বলেন, 'আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, গাজা থেকে ও হামাসের নেতাদের কাছ থেকে এই বক্তব্য এসেছে। প্রস্তাবের ওপর তাদের এমন আনুষ্ঠানিক বক্তব্য আমরা আগে পাইনি।'
পরিকল্পনাটি তিনটি পর্যায়ে বাস্তবায়ন করার কথা বলা হচ্ছে। প্রথম পর্যায়ে ছয় সপ্তাহের যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা হবে। এ সময় গাজার সব জনবহুল এলাকা থেকে ইসরাইলি সেনাদের তুলে নেওয়া হবে।
যুদ্ধবিরতির সময় হামাস 'নির্দিষ্ট সংখ্যক' জিম্মিকে মুক্তি দেবে। তাদের মধ্যে নারী, বয়স্ক ব্যক্তি ও আহত জিম্মিরা থাকবেন। এর বিনিময়ে ইসরাইলে বন্দি থাকা কয়েকশ' মানুষকে মুক্তি দেওয়া হবে। এ ছাড়া হামাসের হাতে জিম্মি অবস্থায় মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মরদেহ পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হবে।
গাজার সব এলাকায় বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘরে ফিরতে সুযোগ দেওয়া হবে। সেই সঙ্গে গাজায় মানবিক সহায়তা কার্যক্রম বাড়ানো হবে। গাজায় প্রতিদিন মানবিক সহায়তাবাহী ৬০০ ট্রাক ঢুকতে দেওয়া হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় গাজাবাসীর জন্য হাজারও সাময়িক আবাসনের ব্যবস্থা করবে।
ছয় সপ্তাহের যুদ্ধবিরতি চলাকালে যুক্তরাষ্ট্র ও কাতারের মধ্যস্থতায় শান্তি আলোচনা চলমান থাকবে। যদি আলোচনা সফল হয়, তবে পরবর্তী পর্যায়ের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করা হবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে বাকি জিম্মিদের মুক্তি দেবে হামাস। তাদের মধ্যে জিম্মি সেনারাও থাকবেন।
সেই সঙ্গে গাজা উপত্যকা থেকে ইসরাইলি বাহিনীর সর্বশেষ সেনাকেও সরিয়ে নেওয়া হবে। যুদ্ধবিরতিকে 'স্থায়ীভাবে শত্রম্নতা বন্ধে' উন্নীত করা হবে।
তৃতীয় পর্যায়ে জিম্মি ফেরানোর প্রক্রিয়া পুরোপুরি শেষ করা হবে। গাজার জন্য বড় ধরনের একটি 'পুনর্গঠন পরিকল্পনা' বাস্তবায়ন শুরু করা হবে। এর আওতায় মার্কিন ও আন্তর্জাতিক সহায়তায় এ উপত্যকায় বাড়ি, বিদ্যালয় ও হাসপাতাল পুনর্নির্মাণ করা হবে।