ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর জরুরি সরকার থেকে পদত্যাগ করেছেন দেশটির যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য বেনি গ্যান্তজ। ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় চলমান যুদ্ধ নিয়ে মতবিরোধের জেরে পদত্যাগ করলেন তিনি। গাজা নিয়ে নেতানিয়াহুর 'যুদ্ধোত্তর পরিকল্পনা দেখতে না পেয়ে' পদত্যাগ করেন দপ্তরবিহীন এই মন্ত্রী। তার পদত্যাগে বেশ চাপের মুখে পড়েছেন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। বিশেষ করে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে তার সরকারের অস্তিত্বই এখন হুমকির মুখে পড়েছে। তথ্যসূত্র : রয়টার্স, এএফপি, আল-জাজিরা
তেল আবিবে রোববার এক সংবাদ সম্মেলন করে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে বেনি গ্যান্তজ বলেন, 'ভারক্রান্ত হৃদয়ে' তাকে এ সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। তিনি বলেন, 'দুর্ভাগ্যবশত, নেতানিয়াহু আমাদের সত্যিকারের বিজয়ের দিকে যেতে বাধা দিচ্ছেন, যা চলমান বেদনাদায়ক সংঘাতকে সমর্থন করছে।'
বেনি গ্যান্তজকে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী পদের সম্ভাব্য দাবিদার হিসেবে দেখেন অনেকে। পদত্যাগের পর তিনি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার আহ্বান জানিয়েছেন নেতানিয়াহুর প্রতি। এর প্রতিক্রিয়ায় নেতানিয়াহু 'এক্স' পোস্টে লিখেছেন, 'বেনি, যুদ্ধ থেকে সরে যাওয়ার সময় এখন নয়, যোদ্ধা হিসেবে যোগ দেওয়ার সময় এটা।'
নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বেনি গ্যান্তজ ইসরাইলের ডিফেন্স ফোর্সের সাবেক চিফ অব স্টাফ। ২০২৩ সালের অক্টোবরে যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভা গঠনের আগ পর্যন্ত তার মধ্যপন্থি দল 'ন্যাশনাল ইউনিটি পার্টি' বিরোধী দলে ছিল। ৭ অক্টোবর হামাসের আক্রমণের পর তিনি নেতানিয়াহুর সঙ্গে যুদ্ধকালীন সরকার গঠনে সায় দেন। যুদ্ধকালীন সরকারে ন্যাশনাল ইউনিটি পার্টির পাঁচজন মন্ত্রী আছেন।
এদিকে গ্যান্তজের সিদ্ধান্তকে 'গুরুত্বপূর্ণ ও সঠিক' বলে বর্ণনা করেছেন বিরোধীদলীয় নেতা ইয়ার লাপিদ। বেনি গ্যান্তজের পদত্যাগের ঘোষণার পরপরই মন্ত্রিসভায় জায়গা চেয়েছেন উগ্র ডানপন্থি জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন-গাভির।
ডানপন্থি জোট সরকারের এই শরিক নেতা গ্যান্তজ এর আগে হুমকি দিয়েছিলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু সায় দিলে তিনি পদত্যাগ করবেন এবং জোট সরকার ধসিয়ে দেবেন। গ্যান্তজ গত মাসেই বলেছিলেন, ছয়টি 'কৌশলগত লক্ষ্য' অর্জনে ৮ জুনের মধ্যে গাজার জন্য একটি যুদ্ধোত্তর পরিকল্পনা ঠিক না করলে তিনি পদত্যাগ করবেন। ওইসব লক্ষ্যের মধ্যে গাজায় হামাসের শাসন অবসান ঘটিয়ে সেখানে একটি বহুজাতিক বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠার দাবিও ছিল। নেতানিয়াহু এসব মন্তব্যকে 'অর্থহীন কথা' বলে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, এর অর্থ হবে 'ইসরাইলের জন্য পরাজয়'।
ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্তের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর সাবেক জেনারেল ও নেতানিয়াহুর সমালোচক গ্যান্তজকেও যুদ্ধকালীন সরকারে গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারক হিসেবে বিবেচনা করা হতো। সরকারে গ্যান্তজের যে প্রভাব, সেটা নেতানিয়াহুর জোট সরকারে ডানপন্থিদের কর্মকান্ডে 'ভারসাম্য' রাখছিল বলে বিবেচনা করা হচ্ছিল। সংবাদ সম্মেলনে গ্যান্তজ বলেন, তিনি কেবল সরকার থেকে পদত্যাগ করছেন না, ন্যাশনাল ইউনিটি পার্টির প্রধানের পদও ছেড়ে দিচ্ছেন।
যদিও গ্যান্তজের এই সিদ্ধান্ত ইসরাইলি সরকারকে দৃশ্যত কোনো সমস্যায় ফেলবে না। কারণ পার্লামেন্ট নেসেটের ১২০ আসনের মধ্যে ৬৪ আসনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে নেতানিয়াহুর। তবে প্রধানমন্ত্রী যে আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন এবং তার যুদ্ধ পরিচালনার কৌশল নিয়ে রাজনৈতিক বিভেদ আরও গভীর হচ্ছে, তা গ্যান্টজের এই সিদ্ধান্তে প্রকাশ পাচ্ছে। যুদ্ধবিরতির চুক্তির জন্য চাপ সৃষ্টি করতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি বিস্নংকেনের ইসরাইল, মিসর, জর্ডান ও কাতারে তিন দিনের সফরের আগের দিন গ্যান্তজ পদত্যাগ করলেন।
চাপের মুখে নেতানিয়াহু
বিশ্লেষকরা বলছেন, উগ্র দক্ষিণপন্থি জোট সরকারের একমাত্র মধ্যপন্থি দলের প্রস্থান একাধিক সংকটের সময়ে ইসরাইলে অস্থিরতা সৃষ্টি করবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এখনই সরকার পতনের আশঙ্কা না থাকলেও নেতানিয়াহুকে এবার জোটের কট্টরপন্থি সদস্যদের ওপর আরও বেশি নির্ভর করতে হবে। ফলে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহযোগী দেশ আমেরিকার সঙ্গে মনোমালিন্য আরও তীব্র হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নেতানিয়াহু নিজের সরকারের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে মার্কিন প্রশাসনের অনেক চাপ উপেক্ষা করার চেষ্টা করে চলেছেন। গাজায় বিতর্কিত সামরিক অভিযানের পাশাপাশি উত্তরে লেবানন সীমান্তের অপর প্রান্তে হিজবুলস্নাহর সঙ্গে আরও তীব্র সংঘাতের আশঙ্কা ইসরাইলে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। গাজায় এক সেনা অভিযানে হামাসের কবল থেকে চার বন্দিকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা সম্ভব হলেও হামাসের কবলে এখনো অনেক বন্দি থেকে যাওয়ায় ইসরাইলে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ চলছে।