ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার নিরপরাধ শিশুদের ওপর হামলা ও হাজার হাজার শিশুর মৃতু্যর কারণে ইসরাইলি সেনাবাহিনীকে কালো তালিকায় যুক্ত করেছে জাতিসংঘ। তবে মহাসচিবের এই সিদ্ধান্তকে 'লজ্জাজনক' বলে নিন্দা জানিয়েছেন জাতিসংঘে ইসরাইলের রাষ্ট্রদূত গিলাদ এরদান। ইসরাইলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরেল কাৎজ বলেছেন, এই পদক্ষেপের কারণে জাতিসংঘের সঙ্গে ইসরাইলের সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ও জাতিসংঘকে এর পরিণতি ভোগ করতে হবে। এদিকে, নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছেন, হামাস ও ফিলিস্তিনের ইসলামিক জিহাদকেও এই তালিকায় যুক্ত করা হবে। তথ্যসূত্র : রয়টার্স, আল-জাজিরা, এএফপি
যেসব দেশ মূলত সশস্ত্র সংঘাতের সময় শিশুদের বিরুদ্ধে নিপীড়ন ও অত্যাচার করে থাকে, সেসব দেশকে এই তালিকায় যুক্ত করে থাকে জাতিসংঘ। টানা আট মাস ধরে গাজায় ইসরাইলের আগ্রাসন চলছে এবং ইসরাইলি সেনাবাহিনীর অব্যাহত হামলায় হাজার হাজার ফিলিস্তিনি শিশু নিহত হয়েছে।
শুক্রবার সোস্যাল মিডিয়ায় দেওয়া এক পোস্টে জাতিসংঘে নিযুক্ত ইসরাইলের রাষ্ট্রদূত গিলাদ এরদান বলেন, ইসরাইলের সেনাবাহিনীকে 'কালো তালিকাভুক্ত' করার বিষয়ে তিনি জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের সিদ্ধান্তের আনুষ্ঠানিক বিজ্ঞপ্তি পেয়েছেন। এরদান দাবি করেন, 'এটি সম্পূর্ণভাবে আপত্তিজনক এবং ভুল। আমি লজ্জাজনক এই সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় বলেছি- আমাদের সেনাবাহিনী বিশ্বের সবচেয়ে নৈতিক। ইসরাইলকে কালো তালিকাভুক্ত করেছেন একমাত্র মহাসচিব, যিনি সন্ত্রাসবাদকে উৎসাহিত করেন এবং ইসরাইলের প্রতি ঘৃণার মাধ্যমে পরিচালিত হন।'
এদিকে, এ বিষয়ে ফোনকলের ভিডিও তিনি 'এক্সে' প্রকাশ করায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তেনিও গুতেরেসের মুখপাত্র স্টিফেন দুজারিক। জাতিসংঘের ওই সিদ্ধান্তের কথা জানাতে গিলাদ এরদানকে ফোন করেছিলেন বৈশ্বিক এই সংস্থাটির এক কর্মকর্তা। গিলাদ ফোনকলে তার প্রতিক্রিয়া জানান এবং এর অংশবিশেষই পরে এক্সে পোস্ট করেন। দুজারিক বলেন, বার্ষিক 'সশস্ত্র সংঘাতে শিশু' প্রতিবেদনে সংযোজিত নতুন তালিকাভুক্ত দেশগুলোর কথা জানাতেই জাতিসংঘের একজন কর্মকর্তা ইসরাইলি দূতকে ফোন করেছিলেন।
প্রসঙ্গত, জাতিসংঘের মহাসচিব প্রতি বছর নিরাপত্তা পরিষদে একটি প্রতিবেদন পাঠান, যেখানে বিশ্বব্যাপী সংঘাতে 'শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও নিপীড়নে সম্পৃক্ত পক্ষগুলোর' তালিকা দেওয়া হয়। এতে শিশুদের হতাহত করাসহ নিপীড়নের প্রমাণ এবং যৌন সহিংসতার তথ্য থাকে।
জাতিসংঘ মহাসচিবের চলতি বছরের এই প্রতিবেদনটি আগামী ১৪ জুন নিরাপত্তা পরিষদে উপস্থাপন করা হবে। তবে তার আগেই ইসরাইলি রাষ্ট্রদূত এরদানকে বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
গাজায় ১৫ হাজারের বেশি শিশুকে হত্যা করেছে ইসরাইল
গাজায় ১৫ হাজারের বেশি শিশুকে হত্যা করেছে ইসরাইলি বাহিনী। অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখন্ড পশ্চিম তীরে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ ফ্রান্সেস্কা আলবানিজ এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, এই পদক্ষেপ তাদের দীর্ঘ সময়ের অপেক্ষার ফল।
সামাজিক মাধ্যমে এক পোস্টে আলবানিজ বলেন, শিশুদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইনের জঘন্য লঙ্ঘনকারী রাষ্ট্রগুলোর তালিকায় ইসরাইলকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তারা ১৫ হাজার শিশুকে হত্যা করেছে এবং আরও ২০ হাজার শিশুকে এতিম বানিয়েছে। গাজার কয়েক হাজার শিশু ইসরাইলি হামলায় শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হারিয়েছে। এই সংখ্যা কমপক্ষে তিন হাজার বলে জানা গেছে। এমনটা তাদের করা উচিত হয়নি। গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে স্পষ্টভাবে সমালোচনা করে আসছেন আলবানিজ। মে মাসের শেষের দিকে ইসরাইলি সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি।
এদিকে, গাজার হামাস-নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরাইলি হামলায় সেখানে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৭৭ জন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া আহত হয়েছেন আরও ২২১ জন। আট মাসের বেশি সময় ধরে চলা সংঘাতে গাজায় ৩৬ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। হামাস নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সেখানে ৩৬ হাজার ৭৩১ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া আহত হয়েছে আরও ৮৩ হাজার ৫৩০ জন। হতাহতদের মধ্যে অধিকাংশই নারী এবং শিশু। ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজার প্রতি ১০ ফিলিস্তিনি শিশুর ৯ জনই 'ভয়াবহ খাদ্য সংকটে' রয়েছে। এ ছাড়া ক্ষুধা, পিপাসা এবং মারাত্মক অপুষ্টির কারণে অনেক ফিলিস্তিনি শিশু মারা গেছে।
এ ছাড়া ইসরাইলি আগ্রাসন গাজাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। জাতিসংঘের মতে, ইসরাইলের বর্বর হামলার কারণে গাজার প্রায় ৮৫ শতাংশ ফিলিস্তিনি বাস্তুচু্যত হয়েছেন। এ ছাড়া অবরুদ্ধ এই ভূখন্ডের ৬০ শতাংশ অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে। ইসরাইলকে এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে। গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির দাবি জানিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব সত্ত্বেও ইসরাইল অবরুদ্ধ এই ভূখন্ডে তার নৃশংস হামলা অব্যাহত রেখেছে।