ভারতে জোট সরকার

'ইনডিয়া'র নজরে থাকবেন দুই 'কিংমেকার'

জোট রাজনীতির ধর্ম একটা সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। হয় মোদি নীতিশ কুমার এবং চন্দ্রবাবুর চাহিদা মেটাবেন, অথবা তারা বিজেপির ওপর থেকে সমর্থন তুলে নেবেন। কারণ তাদের কাছে কতগুলো আসন রয়েছে এবং তাদের ক্ষমতা কতটা, সেটা তারা দু'জনেই জানেন...

প্রকাশ | ০৮ জুন ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
এন চন্দ্রবাবু নাইডু নীতিশ কুমার
ভারতে টানা তৃতীয় দফায় সরকার গঠনের দিকে এগোচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি। বিরোধী জোট 'ইনডিয়া'র শরিক দলগুলোর মধ্যে আলাপ আলোচনা হওয়ার আগেই, একেবারে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় গত বুধবার তিনি সেরে ফেলেছেন 'এনডিএ' জোটের শরিকদের সঙ্গে বৈঠক। কারণ একটাই, এবার বিজেপির হাতে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই, তাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন জোটসঙ্গীরা। এই জোট সরকারে বিরোধীরা 'ভাঙন' ধরানোর সুযোগ পাক, তা নরেন্দ্র মোদি চাননি। গত বুধবার মোদি এবং বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে এনডিএর বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন শরিক শিবসেনার একনাথ শিন্ডে, এলজেপির চিরাগ পাসোয়ান, আরএলডির জয়ন্ত চৌধুরী, জনসেনা দলের পবন কল্যাণসহ আরও অনেকে। তবে বলা বাহুল্য, এই জোটের 'প্রাণভোমরা' হতে চলেছেন তেলুগু দেশম পার্টির সভাপতি এন চন্দ্রবাবু নাইডু এবং বিহারের মুখ্যমন্ত্রী ও জনতা দল (ইউনাইটেডের) প্রধান নীতিশ কুমার, যাদের ঝুলিতে রয়েছে যথাক্রমে ১৬ এবং ১২টি আসন। এনডিএ জোটকে এরই মধ্যে তারা সমর্থনপত্রও দিয়ে ফেলেছেন, একই সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির সামনে রেখেছেন তাদের একগুচ্ছ দাবিদাওয়াও। যার মধ্যে রয়েছে- নিজেদের রাজ্যের জন্য বিশেষ প্যাকেজ এবং নিজ দল থেকে একের বেশি পূর্ণমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর পদ ইত্যাদি। সরকার গঠনকে ঘিরে এরই মধ্যে চাপে থাকা বিজেপির ওপর আরও চাপ বাড়িয়ে এনডিএ-তে এই দুই প্রবীণ নেতা যে জাঁকিয়ে বসতে চাইবেন, সে বিষয়ে অনুমান করেছিলেন অনেকেই। এদিকে এ মুহূর্তে দাঁড়িয়ে এ দুই 'কিংমেকারের' দিকে তাকিয়ে কিন্তু বিরোধী ইনডিয়া জোটও। ভোটের ফল ঘোষণার পর থেকেই বিজেপি-বিরোধী জোটের শরিকদের তরফে এই দুই প্রবীণ রাজনীতিবিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। গত বুধবার সন্ধ্যায় ইনডিয়া জোটের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কংগ্রেসের সোনিয়া গান্ধী, মলিস্নকার্জুন খাড়্‌গে, রাহুল গান্ধী, ডিএমকের এমকে স্টালিন, সমাজবাদী পার্টির অখিলেশ যাদব, উদ্ধব ঠাকরের ঘনিষ্ঠ সঞ্জয় রাউত, তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে অভিষেক ব্যানার্জিসহ অন্য শরিক দলের নেতারা। সেখানে ঠিক হয়, আপাতত বিরোধী দলের ভূমিকাতেই থাকবে ইনডিয়া জোট। বৈঠক শেষে কংগ্রেসের সভাপতি মলিস্নকার্জুন খাড়্‌গে জোটের প্রতিনিধি হিসেবে জানিয়ে দেন, সর্বসম্মতিক্রমে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, বিরোধী জোট হিসেবে যেসব দাবি-দাওয়া নিয়ে তারা লড়াই করে এসেছেন, সেই পথেই আগামীদিনে এগিয়ে যাবে ইনডিয়া। কংগ্রেসের সভাপতি মলিস্নকার্জুন খাড়্‌গে আরও বলেছেন, 'যথোপযুক্ত সময়ে যথোপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।' একই সঙ্গে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন, পরিস্থিতি তেমন হলে সরকার উল্টে দিতেও পিছপা হবে না ইনডিয়া জোট। রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করছেন, ইনডিয়া জোটের নজর আপাতত থাকবে বিজেপির জোটসঙ্গীদের ওপর। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে, জনতা দল ইউনাইটেড এবং তেলেগু দেশম পার্টির ওপর। কারণ (দুটি দল মিলিয়ে) ২৮টি আসন ঝুলিতে রাখা এন চন্দ্রবাবু নাইডু এবং নীতিশ কুমারের সমর্থন ছাড়া সরকার গড়া কঠিন হয়ে দাঁড়াবে নরেন্দ্র মোদির পক্ষে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাংবাদিক শিখা মুখার্জি বলেন, 'জোটের রাজনীতির অঙ্ক খুব সহজ। যে দল সমর্থন করছে, সেই সমর্থনের বদলে তারা কিছু সুযোগ-সুবিধা পেতে চায়। এখন সেই দাবি-দাওয়া না মিটলে তারা অন্যদের দিকে তাকাবে।' রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও লেখক স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য বলেন, 'চন্দ্রবাবু নাইডু এবং নীতিশ কুমারের কাছ থেকে কংগ্রেস প্রত্যাশা করতেই পারে। এর কারণ খুব সহজ। এরা দু'জনেই নিজেদের স্বার্থ ভালো বোঝেন এবং তার ওপর ভিত্তি করে অতীতে বারবার তাদের জোট বদল করতেও দেখা গেছে। এই স্বার্থ পূরণ না হলে তারা বেরিয়ে আসতে দ্বিধা করবেন না।' স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য ব্যাখ্যা করেছেন, এ ক্ষেত্রে স্বার্থ বলতে নিজেদের রাজনৈতিক ফায়দা এবং তাদের রাজ্যের জন্য বিশেষ সুবিধা বোঝানো হচ্ছে। কিংমেকার চন্দ্রবাবু ও নীতিশ অন্ধ্রপ্রদেশে একাধিকবার মুখ্যমন্ত্রী পদে আসীন ছিলেন চন্দ্রবাবু নাইডু। শুধু রাজ্য রাজনীতি নয়, জাতীয় রাজনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। অতীতে কংগ্রেস ও বিজেপি দুই দলের সঙ্গেই সম্পর্ক ছিল নাইডুর। তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু কংগ্রেসের হাত ধরে। পরে শ্বশুর এনটি রামারাও-এর প্রতিষ্ঠিত তেলুগু দেশম পার্টিতে যোগ দেন তিনি। ১৯৯৬ সালে প্রথম ইউনাইটেড ফ্রন্ট সরকারের আহ্বায়ক হিসেবে জাতীয় রাজনীতিতে উলেস্নখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন তিনি। ১৯৯৯ সালে এনডিএ-কে সমর্থন করেন তিনি। যদিও সরাসরি তাতে যোগ দেননি। সেই থেকে জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতিতে তার গুরুত্ব বোঝা যেতে থাকে। ২০১৪ সালে মোদি সরকারকে সমর্থন করেন তিনি। যদিও ২০১৮ সালে বেরিয়ে আসেন। ২০১৮ সালে তার দল এনডিএ থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার পর নির্বাচনে ভরাডুবি হয় তেলুগু দেশম পার্টির। ২০১৮ সালে টিডিপি তেলেঙ্গানা বিধানসভায় মাত্র দু'জন বিধায়ক নিয়ে টিকে ছিল এবং গত লোকসভা নির্বাচনে তারা মাত্র তিনটি আসন জিতেছিল। ২০২৩ সালে অন্ধ্রপ্রদেশ স্কিল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগে জেলে যেতে হয়েছিল তাকে। পরে অবশ্য তিনি জামিন পান। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ওয়াইএস জগন মোহন রেড্ডির কাছে পরাজিত হওয়ার পর তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার নিয়ে যখন প্রশ্ন উঠতে থাকে, ঠিক তখনই আবার চন্দ্রবাবু সব সমীকরণ পাল্টে দেন। চলতি বছরের ফেব্রম্নয়ারি মাসে আবার এনডিএ-তে যোগ দেয় তার দল। এরপর অন্ধ্রপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে ১৭৫টি আসনের মধ্যে ১৩৫টি এবং লোকসভা নির্বাচনে ১৬টি আসন তাদের ঝুলিতে আসে। আপাতত তিনি জাতীয় রাজনীতির অন্যতম কিংমেকার হিসেবে বিবেচিত হচ্ছেন। অন্যদিকে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমারকে বিজেপির জোট এবং বিজেপি বিরোধী জোট, দুই শিবিরেই দেখা গেছে। ১৯৯৬ সালে অটল বিহারি বাজপেয়ির আমলে এনডিএ জোটে যোগ দেন তিনি। ২০১৩ সালে নরেন্দ্র মোদিকে প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য মনোনীত করার পর তিনি সম্পর্ক ছিন্ন করেন ওই জোটের সঙ্গে। নাম লেখান বিরোধী শিবিরে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে অবশ্য নীতিশ কুমার বিজেপির সঙ্গে জোট বেঁধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। এরপর ২০২০ সালে একসঙ্গে বিহার বিধানসভা নির্বাচনে লড়েছিলেন তিনি। ২০২২ সালে বিজেপির সঙ্গে বিচ্ছেদের পর তিনি আরজেডির (যারা কংগ্রেসের সঙ্গে জোটে ছিল) সঙ্গে হাত মেলান। নীতিশ এক সময় ইনডিয়া জোটেরও অংশ ছিলেন। গত বছরের জুন মাসে পাটনায় ইনডিয়া জোটের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এর উদ্যোগ নিয়েছিলেন নীতিশ কুমার এবং এই বৈঠকটি পাটনায় তার বাসভবনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই সময় তিনি জোটের শরিক ছিলেন এবং বলেছিলেন, 'কেন্দ্রের বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে সব নেতা ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করতে সম্মত হয়েছেন।' এরপর সেই জোট ভেঙে বেরিয়ে আসতেও দ্বিধা করেননি তিনি। মাস ছয়েক যেতে না যেতেই বিজেপিকে সঙ্গে নিয়ে রাজ্যে সরকার গড়েন নীতিশ কুমার। এখন তিনি আবারও নরেন্দ্র মোদির প্রতি আস্থা দেখিয়েছেন। বিজেপির এই দুই শক্তিশালী জোটসঙ্গীর অতীতের ভোলবদলের ঘটনা অজানা নয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষক স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য বলেন, 'অতীত ঘাঁটলে দেখা যাবে, নীতিশ কুমার এবং চন্দ্রবাবু নাইডু একাধিকবার দিকবদল করেছেন। চন্দ্রবাবু ২০১৪ সালে বিজেপির শরিক ছিলেন, ২০১৮-তে ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন। ২০১৯ সালে ভোটে তার ভরাডুবি হয়। নীতিশ কুমারের ক্ষেত্রেও তাই। উনি ইনডিয়া জোটের অংশ ছিলেন। সেখানে তার রাশ সেইভাবে থাকছে না দেখে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। ইঙ্গিত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিজেপি তার সঙ্গে যোগাযোগ করে।' জোট সরকার ও নরেন্দ্র মোদি এখন দেখার বিষয়, শরিক-নির্ভর সরকারে নরেন্দ্র মোদির কর্তৃত্ব অটুট থাকবে কিনা, সে নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। প্রশ্ন রয়েছে জোট-নির্ভর সরকারে শরিকদের চাপে কতটা 'নরম' হতে হবে তাকে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক শিখা মুখার্জি বলেন, '২০১৪ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত মোটামুটি বিজেপির একাধিপত্য ছিল। যার সম্পূর্ণ সুযোগ মোদি নিয়েছেন। এবার তারা জোট সরকার গড়ছে... মানে গড়তে বাধ্য হচ্ছে। কারণ গরিষ্ঠতা নেই।' একই মত প্রকাশ করেছেন স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্যও। তিনি বলেছেন, 'নরেন্দ্র মোদির কিন্তু অভিজ্ঞতা নেই জোট সরকার চালানোর। এতদিন এনডিএ সরকার থাকলেও সেটা নামেই ছিল। তার গুরুত্ব ছিল না। অধিকাংশ বড় সিদ্ধান্ত বিজেপি নিজে নিত। কিন্তু এখন তাদের শরিকদের কথাও শুনতে হবে এবং গুরুত্ব দিতে হবে। এই বিষয়টা মোদি কতটা সামলাতে পারেন সেটাই দেখার। আর এই অপেক্ষায় বিরোধীরাও থাকবে। শরিকদের সঙ্গে তলায় তলায় যোগাযোগও রাখবে।' জোট সরকারের অন্য একটি বিষয়ের কথা বলছিলেন শিখা মুখার্জি। তিনি বলেন, 'জোট রাজনীতির ধর্ম একটা সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। হয় মোদি নীতিশ কুমার এবং চন্দ্রবাবুর চাহিদা মেটাবেন, অথবা তারা বিজেপির ওপর থেকে সমর্থন তুলে নেবেন। কারণ তাদের কাছে কতগুলো আসন রয়েছে এবং তাদের ক্ষমতা কতটা, সেটা তারা দু'জনেই জানেন!' তথ্যসূত্র : বিবিসি নিউজ