গাজায় ইসরাইলি হামলা

নিখোঁজরা খুন, না-কি গুমের শিকার

ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তা সংস্থার অংশ গাজার সিভিল ডিফেন্সের হিসাবে ১০ হাজারের ওপর মানুষ শুধু এসব ধ্বংস হওয়া ভবনের নিচে চাপা পড়ে আছেন। জাতিসংঘ হিসাব দিয়েছে, গাজা উপত্যকাজুড়ে যে পরিমাণ ধ্বংসাবশেষ জমা হয়েছে, এর পরিমাণ হবে প্রায় ৩৭ মিলিয়ন টন, আর এর নিচে যে রকম শরীর চাপা পড়ে আছে, তেমনি প্রায় আরও সাড়ে সাত হাজার টন অবিস্ফোরিত গোলাবারুদ আছে, যা স্বেচ্ছাসেবক ও ত্রাণকর্মীদের জন্য আরেকটা ভয়াবহ হুমকি ... ইসরাইলের জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন-গাভির বলেছেন, ইসরাইলে বন্দি করে রাখা হামাস যোদ্ধাদের ব্যাপারে রেডক্রসকে কিছুই জানতে দেওয়া হবে না, যতক্ষণ না তারা ইসরাইল রাষ্ট্রকে আমাদের যাদের বন্দি করে নেওয়া হয়েছে গাজায়, তাদের ব্যাপারে কোনো তথ্য না জানাতে পারবে; মানবিকতার বিনিময়ই কেবল মানবিকতা...

প্রকাশ | ০১ জুন ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
এসব ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়ে আছেন বহু ফিলিস্তিনি
গাজায় যখন প্রতিনিয়ত মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে, তখনো ১৩ হাজারের বেশি মানুষের কোনো সন্ধান নেই, এক রকম নিখোঁজ তারা। তাদের অনেকে হয়তো এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছেন, কিন্তু অনেক মানবাধিকার সংস্থা বলছে, বাকি অনেকেই সম্ভবত 'গুমের' শিকার হয়েছেন। আহমেদ আবু ডিউক তার ভাই মুস্তাফাকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন মাসের পর মাস ধরে। যুদ্ধের কারণে শরণার্থী হওয়া এই পরিবারটি এখন খান ইউনিসের দক্ষিণে নাসের হাসপাতালের সামনের চত্বরে আশ্রয় নেয়। কিন্তু তারা যখন জানতে পারেন যে, কাছেই তাদের ঘর আগুনে পুড়ে গেছে, তখন সেটার অবস্থা জানতে ওখানে যান মুস্তাফা। এরপর তিনি আর কখনোই ফিরে আসেননি। আহমেদ আবু ডিউক বলেন, 'আমরা যতটা পারি খুঁজেছি।' তিনি বলছিলেন, একসময় যেখানে তাদের বাড়ি ছিল, সেটা এখন পুড়ে যাওয়া এক ধ্বংসস্তূপ। আশপাশের সব বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং অনেক উঁচু উঁচু ভবন মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত অ্যাম্বুলেন্সের চালক মুস্তাফার খোঁজ চালাতে থাকে পরিবার, হামাস নিয়ন্ত্রিত সিভিল ডিফেন্সের দল ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে যেসব মৃতদেহ উদ্ধার করেছে, সেখানে এবং কাছের গণকবরগুলোতে, কিন্তু তার দেখা পাওয়া যায়নি। আহমেদ আবু ডিউক বলেন, 'আমাদের এখনো আশা যে, হাসপাতালে প্রতিনিয়ত যেসব অ্যাম্বুলেন্স আসছে, এর কোনো একটাতে আমরা খুঁজে পাবো তাকে।' হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, এখন পর্যন্ত এই যুদ্ধে যে পরিমাণ মানুষ মারা গেছেন, সেটি ৩৫ হাজারের বেশি। কিন্তু সংখ্যাটা শুধুমাত্র হাসপাতাল থেকে যে মৃতের সংখ্যা জানা গেছে, এর ওপর ভিত্তি করে। মুস্তাফাদের মতো এমন অনেক পরিবার আছে, যারা আসলে জানেন না গত সাত মাসে নিখোঁজ হওয়া তাদের প্রিয়জনরা কোথায় আছেন, কেমন আছেন। গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরাইলের ইরেজ সীমান্ত পেরিয়ে হামাসের এক অতর্কিত হামলায় প্রায় ১২০০ জন মারা যায় ও ২৫২ জনকে বন্দি করা হয়। জবাবে ইসরাইল গাজায় সামরিক অভিযান শুরু করে। জেনেভাভিত্তিক একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান 'ইউরো-মেড হিউম্যান রাইটস মনিটর'র মতে, এই অভিযানে হাজার হাজার মানুষ মারা যাওয়ার পাশাপাশি ১৩ হাজারের ওপর ফিলিস্তিনি নিখোঁজ হয়েছে, তাদের কোনো সন্ধানই আর নেই। এই পরিসংখ্যানে কতজন হামাস যোদ্ধা ও কতজন সাধারণ নাগরিক আছেন, তা আলাদা করা নেই। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তা সংস্থার অংশ গাজার সিভিল ডিফেন্সের হিসাবে ১০ হাজারের ওপর মানুষ শুধু এসব ধ্বংস হওয়া ভবনের নিচে চাপা পড়ে আছেন। জাতিসংঘ হিসাব দিয়েছে, গাজা উপত্যকাজুড়ে যে পরিমাণ ধ্বংসাবশেষ জমা হয়েছে, এর পরিমাণ হবে প্রায় ৩৭ মিলিয়ন টন, আর এর নিচে যে রকম শরীর চাপা পড়ে আছে, তেমনি প্রায় আরও সাড়ে সাত হাজার টন অবিস্ফোরিত গোলাবারুদ আছে, যা স্বেচ্ছাসেবক ও ত্রাণকর্মীদের জন্য আরেকটা ভয়াবহ হুমকি। সিভিল ডিফেন্স বলছে, তারা তাদের কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে চাপা পড়া শরীর উদ্ধারে কাজ করছেন, কিন্তু তাদের খুবই সাধারণ কিছু যন্ত্রপাতি আছে, যাতে প্রায়ই মৃতের শরীরের কাছে পৌঁছানোটা কঠিন হয়ে যায়। এ ছাড়া আরেকটা শঙ্কাও আছে যে, শরীর যদি না ঢেকে নিচে ওভাবেই পঁচা অবস্থায় ফেলে রাখা হয়, তাহলে সামনে গরম যখন আরও বাড়বে, তখন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মারাত্মক অবনতি ঘটতে পারে। আবদুর রহমান ইয়াঘি নিচে চাপা পড়া তার আত্মীয়ের শরীর বের করতে গিয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন। মধ্য গাজার দেইর আল-বালাহ শহরে তাদের পরিবারের একটি তিনতলা বাড়ি ছিল, গত ২২ ফেব্রম্নয়ারি যখন এতে ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে, তখন তার পরিবারের ৩৬ জন সদস্য সেই বাড়িতে ছিলেন। তিনি জানান, ১৭টি মৃতদেহ তারা উদ্ধার করতে পেরেছেন, এ ছাড়া শরীরের যেসব অংশ বিশেষ পাওয়া গেছে, সেগুলো শনাক্ত করা যায়নি। আবদুর রহমান ইয়াঘি বলেন, 'আমরা বাড়িতে থাকা বেশির ভাগ শিশুর মৃতদেহ খুঁজে পাইনি।' সিভিল ডিফেন্স জাতিসংঘ ও অন্যান্য দেশ, যাদের উদ্ধার কাজে অভিজ্ঞ ও পারদর্শী কর্মী আছেন, তাদের কাছ থেকে আন্তর্জাতিক সহায়তার আবেদন জানানো হয়েছে। তারা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার কাছেও আবেদন করেছে, যাতে এ ক্ষেত্রে 'জরুরি হস্তক্ষেপ' করা হয় এবং ইসরাইলের ওপর চাপ দেওয়া হয়, যাতে তারা গাজায় উদ্ধারকাজের জন্য ভারী যন্ত্রপাতি আসার অনুমতি দেয়, কিন্তু তাদের সেই আবেদনে এখনো কোনো সাড়া মেলেনি। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বিশ্বাস, যাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তাদের ইসরাইল ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ) তাদের পরিবারকে অন্ধকারে রেখে আটক করে থাকতে পারে, যেটাকে তারা বর্ণনা করছে 'গুম' হিসেবে। 'ইউরো-মেড হিউম্যান রাইটস মনিটর'র হিসাবে, আইডিএফ পরিবারদের না জানিয়েই গাজার শত শত ফিলিস্তিনিকে আটক করেছে। কিন্তু জেনেভা কনভেনশন, যেটাতে ইসরাইলও স্বাক্ষর করেছে, সেখানে বলা আছে- একটা দেশ যদি কোনো বেসামরিক নাগরিককে আটক করে রাখে, তাহলে তার পরিচয় ও তাকে কোথায় রাখা হয়েছে, সেটা জানাতে হবে। গত ৭ অক্টোবরের হামলার পর থেকে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ তাদের আটক কেন্দ্রে আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটির সব পরিদর্শন বাতিল করেছে। গাজায় রেডক্রসে কর্মরত হিশাম মুহানা বলেন, 'আমরা বারবার ফিলিস্তিনিদের যেখানে ধরে রাখা হয়, সেখানে প্রবেশাধিকার চেয়েছি। কিন্তু আমাদের সেই অনুমতি এখনো দেওয়া হয়নি।' আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটি জানায়, ইসরাইলি বন্দিদের রাখা হামাসের আটককেন্দ্রেও তারা যাওয়ার অনুমতি পায়নি। এ ব্যাপারে বিবিসি আইডিএফের কাছে মন্তব্য জানতে চেয়ে কোনো উত্তর পায়নি। তবে সামাজিক মাধ্যম 'এক্স'-এ এক পোস্টে ইসরাইলের জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন-গাভির লিখেছেন, 'ইসরাইলে বন্দি করে রাখা হামাস যোদ্ধাদের ব্যাপারে রেডক্রসকে কিছুই জানতে দেওয়া হবে না, যতক্ষণ না তারা ইসরাইল রাষ্ট্রকে আমাদের যাদের বন্দি করে নেওয়া হয়েছে গাজায়, তাদের ব্যাপারে কোনো তথ্য না জানাতে পারবে; মানবিকতার বিনিময়ই কেবল মানবিকতা।' মধ্য গাজার আরেকটা শহর আল-জুয়াইদাতে আরেকটা পরিবার তাদের হারানো সন্তানের সন্ধানে রয়েছে। তাদের ভয়, তাদের সন্তানকেও হয়তো 'গুম' করা হয়েছে। মোহাম্মদ আলির মা, তার সন্তানের একটি ছবি হাতে নিয়ে ততদিন পর্যন্ত খুঁজেছেন, যতদিন না তাকে কেউ বলেছে যে, তার ছেলেকে আইডিএফ ধরে নিয়ে গেছে। তারা বলছেন যে, শেষবার জীবিত অবস্থায় তার সঙ্গে দেখা হয়েছে। কিন্তু তারা এরপর আর জানেন না যে, তার কী হয়েছে। গত ২৩ ডিসেম্বর যখন উত্তর গাজার জাবালিয়ায় মারাত্মক বোমাবর্ষণ শুরু হয়, তখন এই পরিবারটি আশ্রয়ের খোঁজে নিজ বাসা ছেড়ে একটি স্কুলে এসে ওঠে, আর সেদিন থেকেই মোহাম্মদের কোনো খোঁজ নেই। মোহাম্মদের স্ত্রী আমানি আলি বলেন, একপর্যায়ে ইসরাইলি সেনারা স্কুলেও ঢুকে পড়ে এবং নারী ও শিশুদের সেখান থেকে চলে যেতে বলে। তিনি বলেন, এরপর সেই রাতে সব পুরুষ তাদের পরিবারের কাছে ফেরত এলেও মোহাম্মদ আর আসেননি। তিনি কোথায় আছেন, কেমন আছেন, কিছুই তারা আর জানেন না। আমানি বলেন, তিনি বুঝতে পারছেন না যে, তার স্বামী কি মারা গেছেন, নাকি তাকে আইডিএফ ধরে গেছে, আর এ কারণেই তার বেঁচে থাকার একটা ক্ষীণ আশা এখনো রয়ে গেছে তার। আমানির বিশ্বাস, 'যদি সে বেঁচে থাকতেন ও মুক্ত থাকতেন, তাহলে সে ঠিকই আমাদের খুঁজে বের করতেন।' হামাস নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পরিবারগুলোর জন্য একটা অনলাইন ফর্ম তৈরি করেছে, যেখানে তারা মৃত ও নিখোঁজদের ব্যাপারে জানাতে পারে, যাতে করে ৭ অক্টোবর থেকে যারা নিখোঁজ, তাদের ব্যাপারে একটা পরিপূর্ণ তথ্যভান্ডার গড়ে তোলা যায়। তবে তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে, না জানা পর্যন্ত অনেক পরিবারই তাদের প্রিয়জনকে খুঁজে ফিরবে। তথ্যসূত্র : বিবিসি নিউজ