মিয়ানমার সংকট

ফিরে যাওয়ার পথ নেই বিদ্রোহীদের

হাজার হাজার তরুণ তাদের পড়াশোনা ও ক্যারিয়ারকে বিসর্জন দিয়েছেন। ইয়াঙ্গুনের মতো বড় শহরগুলোর অনেক ডাক্তার, গণিতবিদ, মার্শাল আর্ট যোদ্ধা, যারা দীর্ঘকাল ধরে সামরিক শাসনের বিরোধিতা করেছিলেন; তারা বিদ্রোহী দলে যোগদান করতে শহর ছেড়ে পালিয়েছেন...

প্রকাশ | ২৫ মে ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
মিয়ানমারের দুই তরুণ বিদ্রোহী -ফাইল ছবি
নিজের সমান আকৃতির দুটো বিশাল স্পিকার বহন করে পাথুরে পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে যান বহনকারী। প্রায় ৮০০ মিটার নিচে পাসাং শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মিয়ানমারের সেনাঘাঁটি। সেদিনের তাপমাত্রা ছিল ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে। কিন্তু সেই তীব্র গরমকে উপেক্ষা করে আরও কিছু তরুণ যোদ্ধা বাঁশের খুঁটিতে করে বড় ও ভারী ব্যাটারি প্যাক ও অ্যামপিস্নফায়ার পরিবহণ করছিলেন। সেই দলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন সাবেক সেনা ক্যাপ্টেন নে মায়ো জিন। তিনি ১২ বছর সেনাবাহিনীতে ছিলেন। গাঢ় সবুজ রঙ্গের ক্যামোফ্লেজ জ্যাকেটটিকে এক কাঁধে জড়িয়ে মঞ্চে ওঠেন তিনি। নিচের ঘাঁটিতে থাকা ক্ষমতাসীন সামরিক বাহিনীর প্রতি অনুগত সেনাদের পক্ষ পরিবর্তনের অনুরোধ করা তার মূল লক্ষ্য। মিয়ানমারের পূর্বাঞ্চলের কারেন্নি রাজ্যের এই গভীর জঙ্গলে দুই দলের মাঝে গত কয়েক দশক ধরে লড়াই চলছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বিদ্রোহীরা যে দ্রম্নতগতিতে সাফল্য পাচ্ছে, তা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, তারা বেশ কিছু দিক থেকে এগিয়ে রয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় এই দেশ এখন একটি জটিল পরিস্থিতির মাঝে রয়েছে। কারণ কয়েক দশকের সামরিক শাসন এবং নৃশংস দমন-পীড়নের পর দেশটির নৃগোষ্ঠী ও তরুণ বিদ্রোহীদের নিয়ে গঠিত নতুন সেনাবাহিনী মিয়ানমারের স্বৈরশাসনকে একটি সংকটের পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। গত সাত মাসে দেশটির অর্ধেক থেকে দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা প্রতিরোধের মুখে পড়েছে। ২০২১ সালে মিয়ানমারে সামরিক অভু্যত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের পর থেকে বহু শিশুসহ কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। প্রায় ২৫ লাখ মানুষ বাস্তুচু্যত হয়েছে। শুধু তাই নয়, সামরিক বাহিনী তার শাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে একটি অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। এই অবস্থায় বিদ্রোহীদের ব্যর্থ করার জন্য তারা নিয়মিত যুদ্ধবিমান থেকে বেসামরিক মানুষ, স্কুল এবং গির্জায় বোমা বর্ষণ করছে। নে মায়ো জিন তার সাউন্ড ইকুইপমেন্ট চালু করার আগে নিচ থেকে সেনাবাহিনী তার ওপর গুলি চালায়। তিনি তখন মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে চিৎকার করে সবার উদ্দেশে বলেন, 'সবাই যুদ্ধ বন্ধ করুন! দয়া করে যুদ্ধে বিরতি দিন। শুধুমাত্র পাঁচ মিনিট, ১০ মিনিট শুনুন আপনারা।' কিছুটা আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, তার এই কথা শুনে সেনাবাহিনী থেমে যায়। এরপর তিনি তাদের মিয়ানমারের উত্তরের শান রাজ্যে বিরোধীদের কাছে আত্মসমর্ণকারী চার হাজার সেনার কথা বলেন এবং দেশটির রাজধানী নেইপিডোতে সামরিক ভবনগুলোর ওপর হওয়া সাম্প্রতিক ড্রোন হামলার কথাও উলেস্নখ করেন। মূল বার্তা হলো- আমরা জয়ী হচ্ছি। আপনার শাসনের পতন হচ্ছে। পদত্যাগের সময় হয়েছে। এখানে পাসাং ও কারেন্নি রাজ্যসহ দেশটির বেশির ভাগ অঞ্চলজুড়ে যুদ্ধ ও অচলাবস্থা চলছে। কারণ এমন এক বিদ্রোহ দানা বেঁধেছে, যা সামরিক জান্তার শাসনকে হুমকির মুখে ফেলেছে। ২০২১ সালের সেনা অভু্যত্থানের মাধ্যমে দেশটির সামরিক বাহিনী পুনরায় ক্ষমতা দখল করে নেয় এবং তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের প্রধান অং সান সু চিকে কারাগারে বন্দি করা হয়। তবুও এই বিষয়টি নিয়ে বিশ্বে তেমন কোনো আলোচনা হচ্ছে না। কারণ বিশ্বের সব মনোযোগ এখন ইউক্রেন এবং ইসরাইল-গাজা সংঘাতের ওপর। মিয়ানমারে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বলে কোনো বিষয় নেই। বিদেশি সাংবাদিকরা সেখানে সরকারিভাবে প্রবেশ করতে পারে না বললেই চলে এবং যদি কেউ যায়, তাহলে তাদের কঠোর নজরদারিতে রাখা হয়। সরকার যেসব ক্ষেত্রে অনুমতি দেয়, সেসব ক্ষেত্রে বিদ্রোহীদের বিষয়গুলো শোনার উপায় নেই। আসলে এটি এমন একটি যুদ্ধ, যা শুধুমাত্র আদর্শিক জায়গায় সীমাবদ্ধ নেই। এটি একটি প্রজন্মের যুদ্ধ। তরুণরা 'এসট্যাবলিশমেন্টের' বিরুদ্ধে। তারা পুরাতন কঠোর আদেশ থেকে মুক্তির জন্য লড়াই করছে। এই তরুণদের কেউ কেউ ব্যর্থ বিপস্নবের গল্প শুনেছে এবং কেউ কেউ আবার বিপস্নবের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সামরিক শাসনের অর্ধ শতাব্দী পর ২০১৫ সালে মিয়ানমার সু চি এবং তার ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির অধীনে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য গণতন্ত্রের স্বাদ পেয়েছিল। অনেক তরুণ-তরুণীর জন্য সেই বছরগুলো স্বাধীনতার একটি অতি সংক্ষিপ্ত যুগ। কিন্তু পরে অনেককে হত্যা ও গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এখন যারা লড়াই করছে, তাদের অনেকেই বলেছে যে, অস্ত্র হাতে নেওয়া ছাড়া তাদের হাতে আর কোনো বিকল্প নেই। হাজার হাজার তরুণ তাদের পড়াশোনা ও ক্যারিয়ারকে বিসর্জন দিয়েছেন। ইয়াঙ্গুনের মতো বড় শহরগুলোর অনেক ডাক্তার, গণিতবিদ, মার্শাল আর্ট যোদ্ধা, যারা দীর্ঘকাল ধরে সামরিক শাসনের বিরোধিতা করেছিলেন; তারা বিদ্রোহী দলে যোগদান করতে শহর ছেড়ে পালিয়েছেন। এই ফ্রন্টের সব যোদ্ধার বয়স ২৫ বছরেরও কম। কারেন্নি ন্যাশনালিটিস ডিফেন্স ফোর্স, সংক্ষেপে কেএনডিএফ-এর ২২ বছর বয়সি ন্যাম রি ব্যাখ্যা করেছেন, কেন তিনি প্রতিরোধে তথা বিদ্রোহী দলে যোগ দিয়েছেন। তিনি বলেন, 'কুকুরগুলো (কুকুর শব্দটি সাধারণত সামরিক বাহিনীকে অপমান করার জন্য বলা হয়) অন্যায় করেছে। তারা বেআইনি সামরিক অভু্যত্থান ঘটিয়েছে। আমরা, তরুণরা এতে অসন্তুষ্ট।' কেএনডিএফ হলো তরুণ যোদ্ধা এবং কমান্ডারদের সমন্বয়ে গঠিত একটি নতুন বাহিনী, যারা অভু্যত্থানের পর সামনে এসেছিল। কারেন্নি বা কায়াহ রাজ্যজুড়ে গত কয়েক দশক ধরে নৃগোষ্ঠীরা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ছে। কেএনডিএফ তাদেরকে ঐক্য ও যুদ্ধক্ষেত্রে সাফল্য এনে দিয়েছে। গত বছরের ২৭ অক্টোবর যখন মিয়ানমার সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জোয়ার ওঠে। তারপর থেকে দেশজুড়ে কয়েক ডজন শহর সেনা বিরোধীদের হাতে চলে গেছে। দেশটির প্রধান শহরগুলোর নিয়ন্ত্রণ এখনো মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাতেই আছে। তবে তারা গ্রাম ও সীমান্তের নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। কেএনডিএফ বলে, তারা ও অন্যান্য বিদ্রোহী দল কারেন্নি রাজ্যের ৯০ শতাংশ এলাকা দখল করছে। হতে পারে এটি মিয়ানমারের ছোট একটি রাজ্য, কিন্তু এটিই এখন প্রতিরোধের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। বিদ্রোহী দল কেএনডিএফের ডেপুটি কমান্ডার মাউই ফো থাইকে সর্বপ্রথম বন্দুক হাতে তুলে নেন আজ থেকে তিন বছর আগে। থাইকে একজন পরিবেশবিদ, যিনি পড়াশোনা করেছেন আমেরিকায়। তিনি মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে সরকার হিসেবে স্বীকৃতি দেন না। তিনি বলেন, সামরিক জান্তা দেশটির অনেক নৃগোষ্ঠীর নিপীড়ক। তিনি বলেন, পুরো দেশ এখন সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। তার ভাষায়, 'কৌশল পরিবর্তন হচ্ছে। সব আক্রমণ এখন সমন্বিত।' কেএনডিএফের কোনো যোদ্ধার অভাব নেই। কিন্তু গোলাবারুদ ও অস্ত্রের সরবরাহ খুবই কম। বেশির ভাগ আক্রমণই প্রবাসীদের অনুদানের অর্থায়নে করা হচ্ছে। মাউই আরও বলেন, 'আমাদের যথেষ্ট সাহস আছে, আমাদের মনোবল আছে, আমাদের যথেষ্ট মানবতা আছে। এভাবেই আমরা তাদের পরাজিত করার পথে হাঁটছি।' মিয়ানমারে প্রবেশ করা মানে কেবল ভুলে যাওয়া একটি যুদ্ধ না, বরং বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন একটি দেশে যাত্রা করা। কারেন্নি রাজ্যের বেশির ভাগ মোবাইল নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেট ও বিদু্যৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। সেনাবাহিনীর অবশিষ্ট ঘাঁটিগুলো রাজ্যের প্রধান সড়কগুলো নিয়ন্ত্রণ করে। পাসাং থেকে ডেমোসো'র দূরত্ব ৬০ কিলোমিটার। কিন্তু ময়লার ট্রাককে পেছনে ফেলে পাহাড়, নদী ও উপত্যকার মধ্য দিয়ে এই দূরত্ব অতিক্রম করতে ১০ ঘণ্টারও বেশি সময় লেগে গেছে। নিকটবর্তী শহর মোয়েবেতে অবস্থিত একটি সামরিক ঘাঁটিতে একটি ব্যর্থ হামলার পর গিয়ে জানা গেল, সেখানে বিদ্রোহী দলের ২৭ জন সদস্য নিহত হয়েছিলেন। জঙ্গলের একটি হাসপাতালের নোংরা মেঝেতে পাতা বিছানায় কেএনডিএফের তরুণ যোদ্ধারা শুয়ে ছিলেন। তারা হাসছিলেন এবং 'থাম্বস আপ' দিচ্ছিলেন। তাদের বেশির ভাগই শরীরের অঙ্গ হারিয়েছেন। যুদ্ধে এক ধরনের ধীরগতির হিংস্রতা আছে। শান রাজ্যের দক্ষিণ দিকে সিহসেং শহরের দিকে, সেখানে একটি পাল্টা আক্রমণ চলছিল, কারণ সেনাবাহিনী লোইকাওয়ের একটি রুট দখল করার চেষ্টা করছিল। যদিও সেটি নিয়ে এখনো দুই দলের মাঝে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে। এটি তাদের রাজ্য নয়। তারপরও এটির দায়িত্বে আছে কেএনডিএফ। এখানকার কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে দারথাওর নামক একজনের মাধ্যমে। অনেকের মতো তিনিও আগের হামলায় আহত হয়েছেন। তার টি-শার্টের বাহুর নিচ থেকে একটি গাঢ় লাল রঙের দাগ স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে। তিনি বলেন, 'আমাদের কাছে এই জায়গাটি রক্ষা করা আমাদের বাড়ি রক্ষা করার মতো।' তখন তিনি মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরের সেনাবাহিনীর অবস্থানগুলো দেখান। আশপাশে থেকে শেল ছোড়া হচ্ছিল, যা গড়িয়ে পাহাড়ের ঢালে পড়ছিল। মর্টারের মতো শেলগুলো ধেয়ে আসছিল। খুব কাছাকাছি কোনো জায়গা থেকে স্বয়ংক্রিয় বন্ধুকযুদ্ধের আওয়াজ আসছি। এরপর এটি খুব দ্রম্নত স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, একটি সেনাদল মাইনফিল্ড দিয়ে এগিয়ে আসছিল। এ সময় একটি মর্টার শেল এসে গাড়ির ঠিক সামনের রাস্তায় এসে আঘাত করে। দারথাওর ব্যাখ্যা করেন, 'তাদের সেনারা আহত হয়েছে, তাই তারা এলোমেলোভাবে সর্বত্র গুলি করছে।' এই বিদ্রোহ কোন দিকে নিয়ে যাবে, তা অনুমান করা কঠিন। তবে উভয় পক্ষের জন্য এটি অস্তিত্বের জন্য লড়াই এবং এটি ক্রমবর্ধমান রক্তপাত ও তিক্ততার দ্বারা চিহ্নিত। ফিরে যাওয়ার পথ নেই। তথ্যসূত্র : বিবিসি নিউজ