শুক্রবার, ১১ অক্টোবর ২০২৪, ২৭ আশ্বিন ১৪৩১
ভারতের লোকসভা নির্বাচন

মোদি জোয়ারের আড়ালে 'উল্টো স্রোত'

বিভিন্ন কারণে ভোটে আগ্রহ হারানো 'গেরুয়া ভক্তদের' কেন্দ্রে আনতে 'হিন্দু শ্রেষ্ঠত্ব' বাঁচানোর বার্তা নিয়ে বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন সংঘের সেবকরা। বিজেপির 'অন্দরমহলে'র খবর রাখেন- এমন ব্যক্তিদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে এক প্রতিবেদনে সেই চিত্র তুলে এনেছে রয়টার্স
যাযাদি ডেস্ক
  ২৩ মে ২০২৪, ০০:০০
নির্বাচনী জনসভায় বক্তব্য রাখছেন নরেন্দ্র মোদি

ভারতে লোকসভা নির্বাচনের মধ্যে 'মোদি জোয়ারের' আড়ালে এক 'উল্টো স্রোত' মোকাবিলা করতে মাঠে নামতে হয়েছে ক্ষমতাসীন বিজেপির আদর্শিক সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘকে (আরএসএ), যারা দীর্ঘদিন ধরে ভোটার টেনে 'পদ্মফুল' এর জয় নিশ্চিত করতে কাজ করে আসছে।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার দলের নির্বাচনী প্রচারের প্রধান মুখ হিসেবে রাজ্যে রাজ্যে চষে বেড়াচ্ছেন, করছেন বড় বড় জনসভা। তবে তার জনপ্রিয়তার বিশালত্বের আড়ালে 'খাস সমর্থকদের' একাংশের কেন্দ্রবিমুখ হওয়ার ঘটনাকে উল্টো স্রোত হিসেবে দেখা হচ্ছে।

সেই সঙ্গে কিছু রাজ্যে পুনরুজ্জীবিত বিরোধীদের প্রতিরোধ জোরদার হওয়ায় সামগ্রিক পরিস্থিতি চলমান লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির মাথা ব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে। কোথাও কোথাও 'মোদি ম্যাজিক' কাজ না করায় দলের অন্দরে উদ্বেগ দেখা দিতেই সেসব জায়গায় 'বিকল্প জাদু' হিসেবে মাঠে নেমে পড়েছে আরএসএস এবং হিন্দুত্ববাদ কায়েমের লড়াই করে আসা অন্য সংগঠন।

বিভিন্ন কারণে ভোটে আগ্রহ হারানো 'গেরুয়া ভক্তদের' কেন্দ্রে আনতে 'হিন্দু শ্রেষ্ঠত্ব' বাঁচানোর বার্তা নিয়ে বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন সংঘের সেবকরা। বিজেপির 'অন্দরমহলে'র খবর রাখেন- এমন ব্যক্তিদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে এক প্রতিবেদনে সেই চিত্র তুলে এনেছে রয়টার্স।

ভারতে এবার ছয় সপ্তাহজুড়ে সাত ধাপে জাতীয় নির্বাচন (লোকসভা) হচ্ছে, এরই মধ্যে পার হয়েছে চার সপ্তাহের বেশি। দেখা যাচ্ছে, ভোটার উপস্থিতি আগের নির্বাচনের চেয়ে কম।

রয়টার্স লিখেছে, ভোটার কমার বিষয়টি বিজেপির মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে এ কারণে যে, দলের মূল সমর্থক গোষ্ঠীর একাংশই ভোট দিতে কেন্দ্রে যাচ্ছে না।

টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় যেতে মরিয়া হয়ে লড়ছে বিজেপি। সারা দেশে বইছে 'মোদি জোয়ার'। বিপরীতে মুষ্টিমেয় কিছু রাজ্যে প্রবল বিরোধিতার মুখে পড়তে হচ্ছে তাদের।

ভোটের হাওয়া দেখে নির্বাচন ও বাজার অর্থনীতির শীর্ষ পর্যায়ের বিশ্লেষকরা যে ফলাফলের পূর্বাভাস দিচ্ছেন, তা মোদির দলের বিশাল জয়ের সম্ভাবনার কথা বলছে।

অবশ্য সপ্তম ধাপে ১ জুন ভোটগ্রহণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেন্দ্রফেরত ভোটারদের নিয়ে কোনো জরিপ প্রকাশ করতে পারবে না কেউ। ফলে যেসব আসনে এরই মধ্যে ভোটগ্রহণ হয়ে গেছে, সেখানকার প্রার্থীরা কতটা ভালো বা খারাপ করছেন, তা আগেভাগে বলা কঠিন।

তবে বেশির ভাগ বিশ্লেষক আভাস দিচ্ছেন, ৪ জুন যখন ফল ঘোষণা হবে, ৫৪৩ আসনের লোকসভায় মোদির দলকেই কম-বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করতে দেখা যাবে।

নয়াদিলিস্নভিত্তিক থিংক ট্যাংক অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ভিজিটিং ফেলো রশিদ কিদওয়াই বলেছেন, 'প্রবণতা থেকে বোঝা যাচ্ছে, এবার সংখ্যাগরিষ্ঠতা হয়ত কম হবে, তবে মোদির দলই ফের ক্ষমতায় বসতে চলেছে।

'আর বিজেপি যদি নিশ্চিত জয়রেখা ৩০০ আসনের কম পায়, তাহলে তা মোদির (ভাবমূর্তির) ওপর বাজে প্রভাব ফেলবে।'

রয়টার্স বলছে, নির্বাচনী প্রচারের শুরুতে অনেকের ধারণা ছিল, মোদির দল এবার তিন-চতুর্থাংশ আসনে জিতবে, আর গান্ধী-নেহেরুর রাজনৈতিক উত্তরাধিকার রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস দ্বিতীয় স্থানে থাকবে।

অবশ্য প্রথম দুই ধাপের ভোটের মাঠ পর্যবেক্ষণ করে বিশ্লেষক ও রাজনৈতিক কর্মীরা আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছেন। সংবিধান পরিবর্তনের জন্য ৩৬২টি, অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশ আসন প্রয়োজন, যা এককভাবে বিজেপি নাও পেতে পারে বলে এখন তারা মনে করছেন।

মুসলমানদের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ জায়গায় নির্মিত 'রামমন্দির' গত জানুয়ারিতে উদ্বোধন করে ভারতের সংখ্যাগুরু হিন্দুদের মধ্যে উগ্র জাতীয়তাবাদের যে জাগরণ তৈরি করতে পেরেছিলেন মোদি, তা এখন অনেকটাই ম্স্নান। এর কিছুটা সুযোগ নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বিরোধীরা।

অনেক জায়গায় রুটি-রুজি অর্থাৎ জীবিকার সমস্যাগুলো ধর্মীয় আবেগের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্য হরিয়ানায় নির্বাচনী প্রচারের সময় বেকার তরুণ-তরুণীরা বিজেপির বিরুদ্ধে রাস্তায় বিক্ষোভ করেছেন। দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য মহারাষ্ট্রে পেঁয়াজ রপ্তানির ওপর মোদি সরকার নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে বিজেপিবিরোধী প্রার্থীর পক্ষে প্রচারে নেমেছেন কৃষকরা।

বিহার রাজ্যকে এবার নির্বাচনী 'যুদ্ধক্ষেত্র' বলা হচ্ছে। সেখানে বিজেপির একজন বিধায়ক কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন। দল বদলের কারণ হিসেবে তিনি বলেছিলেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ভারত বিশ্বে আলাদা স্থান দখল করলেও দেশের গরিব মানুষ আরও পিছিয়ে পড়েছে।

বিশ্লেষকরা বলেছেন, মোদি সরকারের প্রতি কিছু ক্ষেত্রে অসন্তোষের কারণে ভোটাদের একাংশ বিরোধীদের দিকে ঝুঁকছেন অথবা বিজেপি-বিমুখ হয়ে পড়ছেন।

এ পরিস্থিতি বিজেপি বা আরএসএসের নজর এড়ায়নি। সংঘের কর্মকর্তা রাজীব তুলি বলেন, 'প্রথম কয়েক সপ্তাহে ভোট পড়ার হার কম, যা উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। আমরা কেন্দ্রে উপস্থিতি বাড়িয়ে এই সংখ্যায় পরিবর্তন আনতে কাজ করছি।'

'কেন্দ্রে যান এবং ভোট দিন'

নয়াদিলিস্ন অঞ্চলে আরএসএসের জ্যেষ্ঠ প্রচার কর্মকর্তা রিতেশ আগারওয়াল বলেছেন, কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেওয়ার জন্য মানুষকে উৎসাহ দিচ্ছেন সংঘের সেবকরা। সেজন্য তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে কথা বলছেন এবং পাড়া-মহলস্নায় সভা করছেন।

বিজেপির জাতীয় পর্যায়ের তিনজন মুখপাত্র ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে সংঘের তৎপরতা সম্পর্কে জানার কথা স্বীকার করেছেন। তবে আরএসএসের এই কাজ কীভাবে বিজেপিকে সুবিধা দেবে, সে সম্পর্কে মন্তব্য করতে রাজি হননি তারা।

বিজেপির একজন মুখপাত্র শেহজাদ পুনাওয়ালা বলেছেন, 'আমি মনে করি না যে বিজেপি দুর্বল অবস্থানে রয়েছে। কম ভোট পড়ার বিষয়টি সব দলকেই প্রভাবিত করেছে এবং প্রথম দু'টি পর্বের পরে ভোটার সংখ্যা বেড়েছে।'

একদিকে সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ কমানো, অন্যদিকে ঢাউস প্রতিরক্ষা বাজেট নিয়ন্ত্রণের জন্য অস্থায়ী কমিশন গঠনে সরকারের নেওয়া সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন হরিয়ানার বেকার তরুণ-তরুণীরা। তাদের ভাষায়- চাকরি এখন সোনার হরিণ। গাজায় যুদ্ধের পর ইসরাইলে কাজ হারানো ভারতীয়রা এখন দেশে কাজের সন্ধানে লাইনে দাঁড়াচ্ছেন।

হরিয়ানার জাহাঙ্গীরপুর গ্রামের ২৮ বছর বয়সি কুলদীপ সিং বলেন, 'আমরা নিজেদের জন্য এই দেশে কোনো ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি না।'

পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করায় মোদি সরকারকে শাস্তি দিতে বিজেপিবিরোধী প্রার্থী ভাস্কর ভাগারের জন্য তহবিল সংগ্রহ করে দিয়েছেন মহারাষ্ট্রের ডিন্ডোরি নির্বাচনী এলাকার কৃষক গণেশ ওয়াধয়ান।

তিনি বলেন, 'আমরা বিশ্বাস করতাম মোদি আমাদের আয় দ্বিগুণ করে দেবেন। তার বদলে আয় এখন অর্ধেক হয়ে গেছে।'

বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশটির অন্যতম দরিদ্র রাজ্য বিহারেও সরকারের প্রতি যথেষ্ট অসন্তোষ রয়েছে। অন্যান্য রাজ্যে যেখানে নাগরিকদের আয় বেড়েছে, এখানে তা শোচনীয় মাত্রায় কম।

বিশ্লেষকদের বরাত দিয়ে রয়টার্স লিখেছে, মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা ও বিহার মিলে লোকসভায় প্রায় ১০০ আসন রয়েছে। এসব আসনে জনরোষ ভোটের ফলে কতটা প্রভাব রাখবে, বিজেপিকে কীভাবে ভোগাবে; তা এখনই খুব স্পষ্ট করে বলা যাচ্ছে না।

বিহারে রাহুল গান্ধীর নির্বাচনী প্রচারে ভালো উপস্থিতি দেখা গেছে। বিজেপিবিরোধী জোট 'ইন্ডিয়া'র একজন নেতা হিসেবে তিনি জনসভায় জোরের সঙ্গে বলেছেন, বিজেপির পতন হবে, সরকার গঠন করবে কংগ্রেস।

ভোটের মোড় ঘুরে যায় কিনা, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয় ভারতের পুঁজিবাজারেও। গত ১৩ মে ঘটে আকস্মিক পতন; অবশ্য সপ্তাহ শেষে বাজার ঘুরে দাঁড়ায়।

কালোবাজারে বাজি ধরার করবার চালানো একটি কোম্পানির মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে রয়টার্সকে বলেন, '৩০০ আসনের কাছাকাছি জিতবে আমাদের বিজেপি, তবে তা ২৭২ আসনের চেয়ে বেশিই হবে।'

ভোট নিয়ে জরিপ পরিচালনাকারী সি-ভোটার ফাউন্ডেশনের পরিচালক যশবন্ত দেশমুখ বলেছেন, নির্বাচনের সব সূচকই মোদির জয়ের আভাস দিচ্ছে।

'বেকারত্ব ও কর্মসংস্থান আসলেই খুব বড় ইসু্য, তবে নির্বাচনের ক্ষেত্রে সত্যিই তেমন নয়। কর্মসংস্থান, মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব, অর্থনৈতিক সংকট- কে এসব সমস্যার সমাধান দিতে পারবেন? মোদি নাকি রাহুল? উত্তরে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে দু'জন মোদির কথা বলেছেন তো একজন বলেছেন রাহুলের কথা।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে