রোববার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৪ আশ্বিন ১৪৩১
ভারতে লোকসভা নির্বাচন

জনপ্রিয় কিন্তু নিরপেক্ষ নন মোদি

সমালোচকদের অভিযোগ, মোদি বিস্ময়করভাবে তার দপ্তরে ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করেছেন। তার সরকার বিচার বিভাগের মতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করেছে। ভিন্নমত ও মিডিয়ার স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করেছে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নড়বড়ে করে দিয়েছে। বিজেপির হিন্দুত্ব ও হিন্দু জাতীয়তাবাদের লক্ষ্য বাস্তবায়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ কারণেই তার শাসনে ভারতের মুসলিম সংখ্যালঘুরা হুমকির সম্মুখীন...
যাযাদি ডেস্ক
  ১৯ মে ২০২৪, ০০:০০
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি -ফাইল ছবি

গত ১০ বছর ধরে ভারতের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ঐতিহাসিক তৃতীয় মেয়াদের জন্য এবারও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তিনি। ভারতের ১৮তম লোকসভা নির্বাচনে ভোটগ্রহণ চলছে। সাত দফার নির্বাচনে এরই মধ্যে চতুর্থ দফার ভোট শেষ হয়েছে। পঞ্চম দফার ভোটগ্রহণ শুরু হবে ২০ মে। এই ভোট নিয়ে জল্পনার মধ্যেই চলছে বিভিন্ন জরিপ। যদিও সাত ধাপে সব কটি আসনে ভোট শেষ না হওয়া পর্যন্ত আগাম জরিপের ফল প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।

ভোট শুরুর আগে সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে, নরেন্দ্র মোদির তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় যাওয়া প্রায় নিশ্চিত। কারণ, ভারতীয় রাজনীতিতে 'মোদি যুগ' নামে পরিচিত গত ১০ বছরে মোদির জনপ্রিয়তা আরও বেড়েছে। বিশেষ করে নরেন্দ্র মোদি হয়ে উঠেছেন বিজেপি তথা পুরো ভারতের একক মুখ। কেন এত জনপ্রিয় বিজেপির মোদি? কিংবা কী এমন বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা মোদিকে বিশেষ করে তুলেছে?

মোদির নির্বাচনী এলাকা বারানসি। উত্তরের এই শহরটির এক তাঁতী শিব জোহরি প্যাটেল বলেন, 'ক্ষমতায় আসার পর থেকে মোদি খুবই ভালো কাজ করছেন। আমরা গরিব মানুষ আর কোনো সরকারের অধীনে এতটা কল্যাণমূলক সুবিধা পাইনি।'

তার ছেলেরা চাকরি পাচ্ছে না। কেন্দ্রীয় সরকারের কল্যাণ পাওয়ার ক্ষেত্রেও স্থানীয় দালালদের প্রতারণার শিকার হয়েছেন তিনি। আর এসব নিয়ে তার দুশ্চিন্তাও রয়েছে। এরপরও এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীকে দোষ দেন না তিনি। তিনি বলেছেন, 'আমি কি পেলাম আর কি পেলাম না, সেটা কোনো বিষয় নয়। আমি এখনো তাকেই (মোদি) ভোট দেবো।'

আমেরিকান থিংক ট্যাংকভিত্তিক জরিপ প্রতিষ্ঠান 'পিউ' (পিইডাবিস্নউ) রিসার্চ সেন্টারের এক জরিপে দেখা গেছে, ৮০ শতাংশ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে পছন্দ করেন। প্রতি ১০ জনের প্রায় সাতজন ভারতীয় মনে করেন, মোদির নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারত আরও প্রভাবশালী দেশে পরিণত হয়েছে। জরিপে ৪৬ শতাংশ মানুষ মোদির পক্ষে, ৩৪ শতাংশ মানুষ বিপক্ষে কথা বলেছেন। জরিপে অংশ নেওয়া ১৬ শতাংশ মানুষ তাদের মতামত প্রকাশ করেননি।

এদিকে, সম্প্রতি ভারতের সংবাদমাধ্যম 'এনডিটিভি' একটি জরিপ করেছে। এই জরিপে দেখা গেছে, বিগত জাতীয় নির্বাচনের আগে যেখানে মোদির জনপ্রিয়তা ছিল ৪৪ শতাংশ, সেখানে এবার এক শতাংশ কমে তা দাঁড়িয়েছে ৪৩ শতাংশে। অন্যদিকে, ২০১৯ সালে রাহুল গান্ধীর জনপ্রিয়তা ছিল ২৪ শতাংশ। বর্তমানে তিন শতাংশ বেড়ে তা দাঁড়িয়েছে ২৭ শতাংশে। অবশ্য, সংবাদমাধ্যমের এসব জরিপ নিয়ে খুব একটা মাথা ব্যথা নেই সাধারণ মানুষের। তাদের মতে, ক্ষমতায় যারাই আসুক না কেন, সাধারণ মানুষের ভাগ্যের তেমন কোনো পরিবর্তন হয় না।

এক সাক্ষাৎকারে সাংবাদিক, লেখক ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ভারতের সাবেক নির্বাহী পরিচালক আকার প্যাটেল বলেন, 'আপনি কী কাজ করছেন, আপনার অবদান কতটা, বিশেষ করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে- এসবের ওপর রাজনৈতিক জনপ্রিয়তা আর নির্ভরশীল নয়।' গুজরাটের সুরাটে জন্ম নেওয়া প্যাটেল 'আওয়ার হিন্দু রাষ্ট্র' ও 'প্রাইস অব দ্য মোদি ইয়ার্স' নামক দুটি বইয়ের লেখক। ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গা নিয়ে বিভিন্ন প্রতিবেদন লিখেছেন তিনি। তার মতে, মোদি জনপ্রিয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিজেপির মনোভাবের কারণে। একমাত্র ওই মনোভাবই ভারতের বিপুল জনগোষ্ঠীকে আকৃষ্ট করতে পেরেছে।

মোদি সমর্থকদের দাবি, তিনি একজন শক্তিশালী ও দক্ষ নেতা। তিনি অবিশ্বাস্য রকম পরিশ্রমী ও রাজনৈতিকভাবে চতুর। ভোটারদের মনোভাব বেশ ভালো বুঝতে পারেন তিনি। পরিস্থিতি বুঝে কথা বলেন ও কৌশল প্রয়োগ করেন। জনমত জরিপেও তিনি এগিয়ে আছেন। তার দল বিজেপিকে বর্তমানে দেশটির বিকল্পহীন শাসক দল বলা হচ্ছে। বিজেপি ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ভারতের পরবর্তী সরকার গঠন করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সমালোচকদের অভিযোগ, মোদি বিস্ময়করভাবে তার দপ্তরে ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করেছেন। তার সরকার বিচার বিভাগের মতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করেছে। ভিন্নমত ও মিডিয়ার স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করেছে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নড়বড়ে করে দিয়েছে। বিজেপির হিন্দুত্ব ও হিন্দু জাতীয়তাবাদের লক্ষ্য বাস্তবায়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ কারণেই তার শাসনে ভারতের মুসলিম সংখ্যালঘুরা হুমকির সম্মুখীন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক রবীন্দ্র রেশমে বলেন, মোদির খুব কট্টর কিছু ভক্ত রয়েছে। আবার খুব কড়া সমালোচকও রয়েছে। হয় আপনি তাকে পছন্দ করবেন অথবা আপনি তাকে অপছন্দ করবেন।

বারানসির পাশের মুসলমান অধু্যষিত এলাকা লোহতা। এই এলাকার নর্দমা ব্যবস্থাপনা খুবই নাজুক। অবকাঠামোগত উন্নয়নও হয়নি তেমন। এই এলাকায় বসবাসকারী তাঁতী নবাব খান বলেন, গত ১০ বছরে তার মতো তাঁতিরা আরও দরিদ্র হয়েছে। তিনি বলেন, ভালো থাকার একমাত্র উপায় হলো বিজেপির সমর্থক হওয়া। না হলে আপনাকে সংগ্রাম করতে হবে। তার মতে, যারা শাড়ি কেনেন, তারা আরও ধনী হয়েছেন, আর যারা এগুলো তৈরি করেন, বিশেষ করে তার মতো মুসলিম তাঁতিরা আরও দরিদ্র হয়েছেন।

বিজেপির দিলীপ প্যাটেল অবশ্য এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় কল্যাণমূলক প্রকল্পগুলো ন্যায্যভাবে বিতরণ করা হয়েছে। তার মতে, মুসলমানদের মধ্যে বিজেপির আস্থা দিন দিন বাড়ছে।

কিন্তু আসল চিত্র হলো- গত ১০ বছরে মোদির রক্ষণশীল ও হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ-আরএসএস মুসলমানদের ওপর অসংখ্যবার আক্রমণ চালিয়েছে। এর মধ্যে অনেকগুলো প্রাণঘাতী। মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষমূলক বক্তব্যও বেড়েছে।

বারানসিতে মোদির বিরুদ্ধে যিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, সেই আতহার জামাল লরি বলেন, 'ভারত ও পাকিস্তান যখন বিভক্ত হয়েছিল, তখন আমাদের পূর্বপুরুষরা পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলি জিন্নাহর আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তারা এ দেশেই থেকে গিয়েছিলেন। এই দেশকে গড়ে তুলতে আমরাও আমাদের রক্ত দিয়েছি। তবুও আমাদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।'

দেখা গেছে, সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে বিজেপির মুসলমান-বিরোধী প্রচারণা আরও বেড়েছে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজেই বিভিন্ন জনসভায় কংগ্রেসকে কটাক্ষ করতে গিয়ে মুসলমানদের আক্রমণ করছেন।

প্রধানমন্ত্রীর সারা দেশের সব নাগরিকের সেবক হওয়ার কথা থাকলেও মোদি প্রকাশ্যেই ভারতের ২০ কোটি মুসলমান নাগরিককে অবজ্ঞা করেছেন। এরপরও বিষয়টি ভারতের ৮০ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে অবাক করছে না। কারণ, সবাই জানে, ধর্মের ভিত্তিতে ভোটারদের ভাগ করে ফেলার চেষ্টা বিজেপির একটি পরীক্ষিত কৌশল। ভারতের মোট ১৪৭ কোটি নাগরিকের মধ্যে ১১৫ কোটিই হিন্দু।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক নীলাঞ্জন সরকার বলেছেন, বিজেপি বিহার, উত্তরপ্রদেশ ও রাজস্থানের মতো রাজ্যগুলোতে তার সমর্থকদের তীরে তোলার চেষ্টা করছে। কারণ, এসব রাজ্যে অতীতে হিন্দু-মুসলমান মেরুকরণের ফল পাওয়া গেছে। এটি তার তরুণ সংগঠকদের পুনরুজ্জীবিত করার জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, যারা বেকারত্বের মতো সমস্যায় প্রভাবিত হতে পারে।

২০১৪ সালের নির্বাচনে কংগ্রেসের দুর্নীতিকে লক্ষ্য করে প্রচারণা চালিয়েছিল বিজেপি। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের ব্যাপক ক্ষোভ ছিল। পরপর দুইবার ক্ষমতায় থাকা কংগ্রেসকে দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে দেখানো হয়েছিল। ২০১৯ সালের নির্বাচনে জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি বিজেপির প্রচারণার মূল বিষয় হয়ে ওঠে। কারণ, সে সময় ভারতীয় সেনাদের ওপর মারাত্মক আক্রমণের পর পাকিস্তানের ভূখন্ডে কথিত জঙ্গি লক্ষ্যবস্তুগুলোর বিরুদ্ধে বিমান হামলা চালায় ভারত।

নীলাঞ্জন সরকার আরও বলেছেন, 'আপনি দলের নেতার ওপর কতটা আস্থা রাখেন বা দলকে কতটা বিশ্বাস করেন, এর ওপর নির্ভর করে এই নির্বাচনটা হতে পারত। কিন্তু দেশব্যাপী নির্বাচনী জোয়ার না থাকায়, ভোটটা হয়ে গেছে অনেক বেশি আঞ্চলিক। বিভিন্ন অঞ্চলের সমস্যাভিত্তিক।' শুধু তাই নয়, মোদিকে জাতীয়ভাবে চ্যালেঞ্জ করতে শক্তিশালী, সুসংগঠিত বিরোধী দলও নেই ভারতে, যারা বিজেপির দুর্বলতাকে মূলধন করতে পারে। কংগ্রেসের রাহুল গান্ধীকে অনেকেই ভালোবাসেন, কিন্তু নির্ভর করতে পারেন না। নির্বাচনী জোয়ার আনতে, নিজেকে হিন্দুত্ব জাতীয়তাবাদী ভারতে আরও জনপ্রিয় করতে সংখ্যালঘু বিদ্বেষ ছাড়া আর কীই বা রয়েছে মোদির হাতে। তথ্যসূত্র: বিবিসি, ট্রিবিউন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে