রোববার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৩ আশ্বিন ১৪৩১
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন

'জেনোসাইড জো' : হুমকিতে বাইডেন

ম এক সমীক্ষা থেকে জানা যায়, ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৩০ বছরের কম বয়সিদের মধ্যে ৪৫ শতাংশ বাইডেনকে সমর্থন করেছিল, যেখানে ট্রাম্প পেয়েছিলেন ৩৭ শতাংশ। এসব পরিসংখ্যান তখন বাইডেনের অনুকূলে থাকলেও এখন তার অবস্থান ২০২০ সালের তুলনায় উলেস্নখযোগ্যভাবে নিচে নেমে এসেছে। তখন এই পর্যায়ে, বাইডেনের পেছনে ৬০ শতাংশ তরুণের সমর্থন ছিল এবং ট্রাম্পের ছিল মাত্র ৩০ শতাংশ। জরিপ অনুসারে, ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্টের জনপ্রিয়তা কমার পেছনে একটি কারণ হলো গাজার যুদ্ধ। যেহেতু তরুণদের একটি বড় অংশ মনে করে, ইসরাইলের পদক্ষেপগুলো ন্যায়সঙ্গত নয়...
যাযাদি ডেস্ক
  ১৮ মে ২০২৪, ০০:০০
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন

'জেনোসাইড জো, গাজায় কত শিশু হত্যা করেছ?' আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ভার্জিনিয়া রাজ্যে নির্বাচনী প্রচারণা অনুষ্ঠানে ভাষণ দেওয়ার সময় ফিলিস্তিনপন্থি এক বিক্ষোভকারী চিৎকার তার ভাষণকে ব্যাহত করেন। মাত্র কয়েক সেকেন্ড এমনটা হতে দেখা যায়, কারণ সঙ্গে সঙ্গেই দলীয় কর্মীরা প্রেসিডেন্টকে মঞ্চে নিয়ে যাওয়ার সময় 'আরও চার বছর, আরও চার বছর' সেস্নাগান দিতে শুরু করেন। এতে বিক্ষোভকারীর সেস্নাগান চাপা পড়ে যায়।

এটি ছিল ২৩ জানুয়ারির ঘটনা। যখন বাইডেন, নভেম্বরে আমেরিকার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য ডেমোক্রেটিক পার্টির সম্ভাব্য প্রার্থী হয়েছেন, কিন্তু প্রাইমারি নির্বাচনে তখনো প্রয়োজনীয় সংখ্যক ডেলিগেট পাননি। তবে ততদিনে, জো বাইডেনের পুনরায় প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হওয়ার পথে গাজায় ইসরাইল ও হামাসের যুদ্ধ মোকাবিলা করা একটি কঠিন সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়।

আমেরিকাজুড়ে শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যুদ্ধ-বিরোধী বিক্ষোভের জোয়ারে, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বাইডেন আগের চেয়ে আরও বেশি বাধার মুখে পড়ছেন বলে মনে হচ্ছে। এই বিক্ষোভে দুই হাজারের বেশি বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাস ইসরাইলে সশস্ত্র হামলা চালানোর পরপরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে 'জেনোসাইড জো' স্স্নোগানটি ছড়িয়ে পড়ে। হামাসের এই হামলায় প্রায় ১ হাজার ২০০ মানুষ নিহত হয় এবং আরও প্রায় আড়াইশ' জনকে জিম্মি করে নিয়ে যায় তারা, যার ফলে এখন যুদ্ধ চলছে।

২৮ অক্টোবর মধ্যে ডেট্রয়েটে ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভে যারা অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে এটি বহুল উচ্চারিত একটি স্স্নোগান হয়ে দাঁড়ায়। যুদ্ধের প্রথম মাসগুলোয়, বাইডেন যখন ইসরাইল সরকারের প্রতি দৃঢ় সমর্থন দেওয়ার কথা জানান, আমেরিকার আরব-মুসলিম জনগোষ্ঠী এবং বাম-গণতান্ত্রিক ভোটারদের মধ্যে অসন্তোষ ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তখন এটি স্পষ্ট ছিল না যে, গাজায় যুদ্ধ এত দীর্ঘ মাস ধরে চলবে এবং অনেক মানুষ হতাহত হবে। গাজার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের মতে, এ পর্যন্ত ইসরাইলি হামলায় ৩৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি মারা গেছেন। যা তরুণ শিক্ষার্থীদের মাঝে অসন্তোষের ঝড় বইয়ে দিয়েছে, যারা গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করছেন।

এই তরুণরা এবং তাদের কাছাকাছি দৃষ্টিভঙ্গির অন্যান্য সংখ্যালঘু, যেমন- ল্যাতিনো, এশিয়ান, আফ্রিকান-আমেরিকান, এলজিবিটি সম্প্রদায়ের সদস্যরা মূলত ডেমোক্রেট পার্টির ভোটার হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকেন। এদের সমর্থন বড় ধরনের পার্থক্য তৈরি করতে সক্ষম, যা পেলে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলতে পারবেন বাইডেন।

'বাইডেনের যুদ্ধ'

গত বছরের ৭ অক্টোবরের হামলার পর বাইডেন হামাসের আক্রমণের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে ইসরাইলের প্রেসিডেন্ট বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানান। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ব্যক্তিগতভাবে ইসরাইল ভ্রমণ করেন এবং ইরান, লেবাননের হিজবুলস্নাহ মিলিশিয়াসহ ওই অঞ্চলে হামাসের অন্যান্য মিত্ররা যেন সংঘাত বাড়াতে না পারে, তার সতর্কতা হিসেবে ভূমধ্যসাগরে মার্কিন বিমানবাহী রণতরী মোতায়েন করেন।

ইসরাইলি সামরিক অভিযানের ধ্বংসযজ্ঞ এবং বিপুল সংখ্যক বেসামরিক মানুষ হতাহত যে হয়েছে তা নয়, বরং নেতানিয়াহু সরকারের কঠোরতার কারণে গাজায় খাদ্য ও মানবিক সাহায্যের প্রবেশও কমে যায়। এর ফলে জাতিসংঘ, এনজিও এবং বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সরকার কঠোর সমালোচনা করলেও বাইডেন তখন থেকেই ইসরাইলের প্রতি তার সমর্থনে অবিচল আছেন- অন্তত জনসম্মুখে।

ফিলিস্তিনিপন্থি গোষ্ঠীগুলো একটি সুনির্দিষ্ট যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানালেও বাইডেন সরকার সাময়িক বিরতির সমর্থন করেন, যা ২০২৩ সালের নভেম্বরে হয়েছিল। ওই যুদ্ধবিরতির কারণে গাজায় বড় আকারে সহায়তা প্রবেশ করতে শুরু করে। সেইসঙ্গে ১০০ ইসরাইলি জিম্মি এবং সেখানে বন্দি প্রায় ২৪০ জন ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দেওয়া হয়। একই সময়ে, গাজায় আরও মানবিক সহায়তা প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার জন্য ইসরাইলের কাছে বাইডেন প্রশাসন বারবার অনুরোধ জানায়। কিন্তু ইসরাইলের কাছ থেকে কোনো অনুকূল বা বাস্তবসম্মত সাড়া পাওয়া যায়নি। এমন পরিস্থিতিতে আমেরিকা বিমান থেকে ত্রাণ সহায়তা দেওয়ার অভিযান শুরু করে। উপত্যকার ওপর দিয়ে সরাসরি সাহায্য সরবরাহের জন্য উপকূলে একটি ভাসমান ডক তৈরি করা শুরু হয়।

এপ্রিলের শুরুতে, প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে আসে যে, বাইডেন নেতানিয়াহুকে বলেছেন, 'মানবিক পরিস্থিতি অগ্রহণযোগ্য' এবং বেসামরিকদের ক্ষয়ক্ষতি ও মানবিক দুর্ভোগ মোকাবিলা করতে সেইসঙ্গে গাজায় নিয়োজিত দাতব্য কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আমেরিকা তাদের গাজা সম্পর্কিত মার্কিন নীতিতে সুনির্দিষ্ট, বাস্তবসম্মত এবং পরিমাপযোগ্য পদক্ষেপ নির্ধারণ করতে যাচ্ছে। তবে একই সময়ে হোয়াইট হাউস ইসরাইলে অস্ত্রের চালান বজায় রেখেছে এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে তার ভেটো ক্ষমতা ব্যবহার করেছে, যাতে ইসরাইলকে তাদের বিরুদ্ধে আসা প্রস্তাবগুলো থেকে রক্ষা করা যায়। এই পদক্ষেপগুলো ফিলিস্তিনপন্থি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের তীব্র আপত্তির মুখে পড়ে।

জেরেমি কোনিন্ডিক, যিনি বাইডেন এবং বারাক ওবামা সরকারের হয়ে কাজ করেছেন; এখন এনজিও 'রিফিউজিস ইন্টারন্যাশনাল'র সভাপতিত্ব করছেন, তার ধারণা- বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট এই যুদ্ধকে নিজের করে তুলেছেন। তিনি বলেন, তারা এমন সব সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে, যাতে যুদ্ধ টিকে আছে। এই যুদ্ধ টিকিয়ে রাখতে তারা রাজনৈতিক সমর্থন দিয়েছে। তারা জাতিসংঘে কূটনৈতিকভাবে ইসরাইলের পাশে থেকেছে যা যুদ্ধকে টিকিয়ে রেখেছে। তিনি আরও বলেন, বাইডেন কি এই যুদ্ধ চাইবেন? না। কিন্তু বাইডেন কি এই যুদ্ধ বস্তুগতভাবে সমর্থন করছেন? হঁ্যা। এবং তাই সেই অর্থে, এটি তারই যুদ্ধ।

নির্বাচনী প্রভাব

বাইডেনের গাজা নীতি তার পুনর্র্নির্বাচনের সম্ভাবনাকে প্রভাবিত করবে, এমন আশঙ্কা ওই অঞ্চলে সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকেই রয়েছে। ২০২৩ সালের নভেম্বরে, মিশিগান ডেমোক্রেটিক কংগ্রেসওম্যান রাশিদা তালাইব এক ভিডিও প্রকাশ করেছিলেন, যাতে তিনি প্রকাশ্যে বাইডেনকে 'ফিলিস্তিনিদের গণহত্যা' সমর্থন করার জন্য অভিযুক্ত করেছিলেন। মার্কিন কংগ্রেসে ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত একমাত্র প্রতিনিধি তালাইব ভিডিওটিতে বলেছেন, 'প্রেসিডেন্ট, আমেরিকার জনগণ এই বিষয়ে আপনার সঙ্গে নেই। আমরা ২০২৪ সালে সেটা মনে রাখব।' তার বার্তার পরে, স্ক্রিনটি কালো হয়ে যায় এবং একটি বার্তা সামনে আসে যাতে বলা হয়- 'জো বাইডেন ফিলিস্তিনি জনগণের গণহত্যাকে সমর্থন করেছিলেন। আমেরিকার মানুষ ভুলবে না। বাইডেন, এখন একটি যুদ্ধবিরতি সমর্থন করুন। অথবা ২০২৪ সালে আমাদের ওপর নির্ভর করবেন না।'

এই অস্থিরতা প্রথম রাজনৈতিকভাবে প্রকাশ পায় প্রাইমারির সময় যখন যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠেছিল। ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী নির্বাচনে একটি প্রতিনিধিদের অনেকে বাইডেনকে ভোট দেওয়ার প্রতিশ্রম্নতি দেননি। এ ধরনের 'আনকমিটেড' আন্দোলন মিশিগানে দেখা গিয়েছিল, যেখানে তারা এক লাখের বেশি ভোট পেয়েছে (১৩ শতাংশের মতো)। এটি মিনেসোটায় (প্রায় ১৯ শতাংশ), হাওয়াইয়ে (২৯ শতাংশ) এবং ওয়াশিংটনে (প্রায় ১০ শতাংশ) উলেস্নখযোগ্য ফল অর্জন করে। যে অঙ্গরাজ্যগুলোয় 'আনকমিটেড' অপশন ছিল, সেখানে মার্চের মাঝামাঝি নাগাদ, গড়ে ১০ শতাংশ ভোটারা 'আনকমিটেড' অপশনের পক্ষে ভোট দিয়েছে। যে রাজ্যগুলোয় আনকমিটেড অপশন ছিল না, সেখানকার ১২ শতাংশ ভোট বাইডেন ছাড়া অন্য প্রার্থীদের পক্ষে পড়েছিল।

'আনকমিটেড' মুভমেন্টের তথ্যমতে, তাদের এই আন্দোলনের পক্ষে অন্তত পাঁচ লাখ ভোট পড়েছে। এই ফলগুলো হেলাফেলা করার মতো নয়, কেননা বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্টের ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পেছনে বড় কারণ ছিল- তিনি অ্যারিজোনা, জর্জিয়া, মিশিগান, নেভাডা, পেনসিলভানিয়া এবং উইসকনসিনের মতো অতি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক রাজ্যগুলোয় ভোট পেয়েছিলেন। এসব রাজ্যের অনেকগুলোয় তিনি খুব অল্প ব্যবধানে জয়ী হয়েছিলেন এবং তার জয়ী হওয়ার পেছনে মূল ভূমিকা রেখেছে তরুণদের মতো নির্দিষ্ট কিছু গ্রম্নপের ভোট।

সাম্প্রতিক জরিপগুলো ইঙ্গিত দিচ্ছে, প্রেসিডেন্ট বাইডেন ভোটারদের এই গ্রম্নপের মধ্যে তার জায়গা হারাচ্ছেন। এপ্রিলের মাঝামাঝি 'ইউএসএ টুডে' পত্রিকায় প্রকাশিত এক সমীক্ষা থেকে জানা যায়, ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৩০ বছরের কম বয়সিদের মধ্যে ৪৫ শতাংশ বাইডেনকে সমর্থন করেছিল, যেখানে ট্রাম্প পেয়েছিলেন ৩৭ শতাংশ। এসব পরিসংখ্যান তখন বাইডেনের অনুকূলে থাকলেও এখন তার অবস্থান ২০২০ সালের তুলনায় উলেস্নখযোগ্যভাবে নিচে নেমে এসেছে। তখন, এই পর্যায়ে, বাইডেনের পেছনে ৬০ শতাংশ তরুণের সমর্থন ছিল এবং ট্রাম্পের ছিল মাত্র ৩০ শতাংশ। জরিপ অনুসারে, ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্টের জনপ্রিয়তা কমার পেছনে একটি কারণ হলো গাজার যুদ্ধ। যেহেতু তরুণদের একটি বড় অংশ মনে করে, ইসরাইলের পদক্ষেপগুলো ন্যায়সঙ্গত নয়।

সিএনএন প্রকাশিত আরেকটি সমীক্ষা থেকে ধারণা করা যায়, বাইডেন যে ইসু্যতে সবচেয়ে খারাপ রেটিং পেয়েছিলেন, তা হলো- ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধ পরিচালনায় আমেরিকার ভূমিকা। মাত্র ২৮ শতাংশ মানুষ এর অনুমোদন দিয়েছিল এবং ৭১ শতাংশ অসম্মতি জানিয়েছিল এবং অসম্মতির পক্ষে তরুণদের অবস্থান, অর্থাৎ যাদের বয়স ৩৫ বছরের কম তাদের অবস্থান বাড়তে বাড়তে ৮১ শতাংশে ঠেকেছে। গাজার যুদ্ধ নিয়ে তরুণদের মধ্যে এই অস্থিরতা বাইডেনের পুনর্র্নির্বাচিত হওয়াকে প্রশ্নের মুখে ফেলতে পারে। তথ্যসূত্র : বিবিসি নিউজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে