শুক্রবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ২০ আশ্বিন ১৪৩১

হিন্দুত্ববাদ যখন রাজনীতির নিয়ন্ত্রক

যাযাদি ডেস্ক
  ১৩ মে ২০২৪, ০০:০০
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি

ভারতের লোকসভা নির্বাচনের কয়েক ধাপের ভোটগ্রহণ শেষ হবে ১ জুন। তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আশায় দিন গুণছেন নরেন্দ্র মোদি। যে কয়টি বিষয়ের ওপর মোদি এবং তার দল ভারতীয় জনতা পার্টি-বিজেপি'র জনপ্রিয়তা ভর করে আছে, তার অন্যতম হিন্দু জাতীয়তাবাদী আদর্শ বা হিন্দুত্ব। এই আদর্শের কট্টর সমর্থকরা একটি হিন্দু ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্র চান, যেখানে হিন্দুদের চাওয়া-পাওয়া অগ্রাধিকার পাবে। সমালোচকরা এই দৃষ্টিভঙ্গিটাকে বৈষম্যমূলক এবং পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশটিতে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য হুমকি বলে মনে করেন।

মোদির শাসনামলে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা এবং আক্রমণ বেড়ে যাওয়ার অভিযোগ করে থাকেন অনেক মুসলমান। যদিও ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা কোনো খারাপ পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন, সেটি স্বীকার করতে নারাজ বিজেপি।

হিন্দুত্ব কী?

ধর্ম ও জাতীয়তাবাদকে এক করে দেখা হয় হিন্দুত্বে। মনে করা হয়, হিন্দু ধর্মীয় পরিচয় এবং ভারতীয় জাতীয় পরিচয় ওতপ্রোতভাবে জড়িত। হিন্দুত্ব শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন ধর্মকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদের অন্যতম প্রবর্তক চন্দ্রনাথ বসু। ১৮৯০ সালের দিকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের সংগ্রামের সময় ধারণাটি আলোচনায় আসে। তবে এটি জনপ্রিয়তা পায় আরও দুই দশক পর, উপনিবেশ-বিরোধী রাজনীতিবিদ বিনায়ক দামোদর সাভারকারের হাত ধরে। সাভারকারকে হিন্দুত্ববাদী আদর্শের জনক হিসেবেও দেখা হয়। ১৯২২ সালে ব্রিটিশ কারাগারে বসে 'এসেনশিয়ালস অফ হিন্দুত্ব' নামে একটি পুস্তিকা লেখেন তিনি। সেখানে সিন্ধু উপত্যকাকে তিনি 'হিন্দু আইডেনটিটি'র জন্মস্থান হিসেবে উলেস্নখ করেন। নিজেকে নাস্তিক দাবি করলেও, তিনি বিশ্বাস করতেন, ওই অঞ্চলের সঙ্গে হিন্দুদের সংযোগটা কেবল ধর্মের নয় বরং এথনিক বা নৃতাত্ত্বিক যার সঙ্গে রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক পরিচয় জড়িয়ে আছে।

ব্রিটিশের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামে লিপ্ত অনেক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের একটি হয়ে ওঠে হিন্দু জাতীয়তাবাদ। এমনকি মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীও তার বক্তব্য সাধারণের কাছে সহজবোধ্য করে তুলতে ধর্মীয় ভাষা ব্যবহার করতেন। লন্ডনের 'স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ'র সাউথ এশিয়ান ইন্সটিউটের ডিরেক্টর অধ্যাপক সুবীর সিনহা। তিনি বলেন, কিন্তু গান্ধী ও সাভারকারের পথ ছিল ভিন্ন। অধ্যাপক সিনহা এবং আরও অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, সাভারকার সেই সময় বিকাশ লাভ করা ফ্যাসিবাদ থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছিলেন। সিনহা বলেন, 'হিন্দুত্ব'র শুরুর দিকের নেতৃত্ব প্রকাশ্যেই মুসোলিনি ও হিটলারের প্রশংসা করতেন। তাদের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি এই আকর্ষণের কারণ, তারা কে জার্মান আর কে জার্মান নন, তার একটা সংজ্ঞা দাঁড় করিয়েছিলেন।

ভারত কি একটি হিন্দু রাষ্ট্র?

২০১১ সালের শুমারি অনুযায়ী, ভারতের জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ হিন্দু এবং ১৪ শতাংশ মুসলমান। এ ছাড়া খ্রিষ্টান, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন এবং অন্যান্য সম্প্রদায় মিলে বাকি জনসংখ্যার বাকি ছয় শতাংশ। সেকু্যলারজিম বা ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা আছে ভারতের সংবিধানে। যার মানে, রাষ্ট্রক্ষমতা কোনো ধর্মের প্রতি আনুগত্য দেখাতে বাধ্য নয় এবং সব ভারতীয় নাগরিকের নিজ নিজ বিশ্বাস অনুযায়ী ধর্ম পালনের অধিকার রয়েছে।

কিন্তু, ধর্মের ভূমিকা ক্রমশই স্পর্শকাতর হয়ে উঠছে। বিরোধীদের অভিযোগ, মোদি ও বিজেপি'র হিন্দু-ফার্স্ট নীতি সেকু্যলারিজমের ভিত্তিটাকেই দুর্বল করে দিচ্ছে। যদিও, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা ও লেখক সরোজ চাধার মতো কোনো কোনো ভারতীয় মনে করেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনগণের প্রতি ওপরের কাঠামোর সমর্থনের নীতি, ধর্মনিরপেক্ষ শাসনের মঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ। তার যুক্তি, প্রাচীন হিন্দু রাজারা হাজার হাজার বছর ধরে ধর্মনিরপেক্ষতা চর্চা করে এসেছেন, হিন্দু ধর্মকে রক্ষায় নিজেদের অঙ্গীকার এবং দায়িত্বশীলতাকে অবিচল রেখেই। তার ভাষায়, এটাই সম্ভবত সেকু্যলারিজমের সবচেয়ে ভালো রূপ।

ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে হিন্দুত্বের সংযোগ

হিন্দু জাতীয়তাবাদ বিজেপি'র মূল নীতিগুলোর অন্যতম। দলটির শেকড় জড়িয়ে আছে ব্রিটিশ শাসনের সময় গড়ে ওঠা রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের (আরএসএস) মতো হিন্দু পুনর্জাগরণের আন্দোলনগুলোতে। আরএসএস কট্টর ডানপন্থি হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠন হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল। এর প্রতিষ্ঠাতা কেশব বলিরাম হেজেওয়ার ব্যাপকভাবে সাভারকারের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়।

স্বাধীনতার পর থেকে তিনবার নিষিদ্ধ করা হয় সংগঠনটিকে। প্রথমবার ১৯৪৮ সালে, সাবেক আরএসএস সদস্য নাথুরাম গডসের হাতে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী নিহত হওয়ার পর। তারপর আবার ১৯৭৫ সালে, যখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা জারি করেন। সে সময় প্রায় সব বিরোধী নেতাকে কারাবরণ করতে হয়েছিল। আরএসএসকে তৃতীয়বারের মতো নিষিদ্ধ করা হয় ১৯৯২ সালে। সে বছর কট্টর হিন্দু সংগঠনগুলো ষোড়শ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত বাবরি মসজিদটি ভাঙে। বর্তমানে আরএসএসকে বিজেপি'র আদর্শিক উৎস হিসেবে দেখা হয়। তৃণমূল পর্যায়ে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক এবং ব্যাপক রাজনৈতিক প্রভাব দুটোই আছে তাদের।

আট বছর বয়স থেকে আরএসএসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তার ক্ষমতায় আরোহণের পর থেকেই, দলটি হিন্দু জাতীয়তাবাদকে জোরেশোরে সামনে নিয়ে আসতে শুরু করে। ওয়াশিংটন ডিসির 'কার্নেগি এনডোমেন্ট'র পরিচালক মিলন বৈষ্ণব ব্যাখ্যা করে বলেন, 'অনেক দিক থেকে তিনি হিন্দু জাতীয়তাবাদের একজন আদর্শ মুখপাত্র। কারণ তিনি সত্যিকারের ধর্মবিশ্বাসী এবং আন্দোলনটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।' তথ্যসূত্র : বিবিসি নিউজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে