শুক্রবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ১৯ আশ্বিন ১৪৩১
সোনিয়ার আসনে রাহুল

রায়বেরিলিতে উত্তরাধিকার অভিষেক

রায়বেরিলিতে গান্ধী পরিবার নিয়ে কোনো ক্ষোভ দেখা যাচ্ছে না। ইউপিএ সরকারের আমলে সোনিয়া গান্ধী এমপি থাকাকালে রায়বেরিলি রেল কোচ ফ্যাক্টরি, এইমস এবং এনআইএফটির মতো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রতিষ্ঠান পেয়েছে। কিন্তু ইউপিএ সরকার ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার পর থেকে সোনিয়া গান্ধীর রায়বেরিলিতে আসা কমিয়ে দেন। কেন্দ্রে সরকার না থাকায় রায়বেরিলির মানুষকে দেওয়ার জন্য এমপি ফান্ডের প্রকল্পগুলোর সুবিধা ছাড়া সোনিয়া গান্ধীর আর কিছুই দেওয়ার ছিল না...
যাযাদি ডেস্ক
  ১২ মে ২০২৪, ০০:০০
রায়বেরিলিতে মনোনয়নপত্র জমা দেন রাহুল

গত ৩ মে সকাল পর্যন্ত কারও ধারণাই ছিল না, কংগ্রেস এমন একটা চমকপ্রদ সিদ্ধান্ত নেবে। বৃহস্পতিবার গভীর রাত পর্যন্ত মনে করা হচ্ছিল, রাহুল গান্ধী আমেথি থেকে ভোটে লড়বেন এবং রায়বেরিলি নিয়ে কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছে দল। কিন্তু বৃহস্পতিবারের গভীর রাতের বৈঠকে কী হয়েছে, সে সম্পর্কে কারও কোনো ধারণা ছিল না।

রাহুল গান্ধী ও আমেথি নিয়ে গত ১৫ দিন ধরে যে আলোচনা চলছিল, তার অবসান ঘটিয়ে তাকে রায়বেরিলি থেকে এবং সোনিয়া গান্ধীর প্রতিনিধি হিসেবে কিশোরী লাল শর্মাকে আমেথি থেকে প্রার্থী করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কংগ্রেস।

রায়বেরিলি থেকে রাহুল গান্ধীর ভোটে লড়া নিয়ে শুধু সেখানকার কংগ্রেস নেতাদের মধ্যেই নয়, ওই আসনটির সাধারণ মানুষের মধ্যেও ব্যাপক উৎসাহ দেখা যাচ্ছে।

রায়বেরিলিতে কংগ্রেস কর্মীদের মধ্যে উচ্ছ্বাস

রাহুল গান্ধী রায়বেরিলি থেকে লোকসভা ভোটে দাঁড়ানোয় কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে উচ্ছ্বাস দেখা যাচ্ছে। প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সদস্য রাহুল বাজপেয়ি বলেন, 'রাহুলজি যুব ও কৃষকদের কথা বলছেন এবং তিনি দেশের দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারের বিরুদ্ধে লড়ছেন। তিনি যে রায়বেরিলি থেকে লড়ছেন, এটা আমাদের জন্য সৌভাগ্যের ব্যাপার।' ঘটনাচক্রে, সোনিয়া গান্ধীর প্রতিনিধি কিশোরী লাল শর্মা ১ মে রায়বেরিলি আর আমেথিতে দলীয় কর্মী ও নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন এবং সেই বৈঠকেও তিনি বলতে পারেননি যে, এই দুটি আসনে কংগ্রেস প্রার্থী কারা হবেন। কিন্তু সকালে রায়বেরিলি থেকে রাহুল গান্ধীর দাঁড়ানোর খবর আসতেই জেলা কার্যালয়ে দলীয় কর্মীদের ভিড় জমতে শুরু করে। সোনিয়া গান্ধী, প্রিয়াঙ্কা গান্ধী এবং কংগ্রেস সভাপতি মলিস্নকার্জুন খাড়্‌গেকে সঙ্গে নিয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন রাহুল গান্ধী। তার মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময় সমাজবাদী পার্টির কর্মীরাও ভিড় করেছিলেন। রাহুল গান্ধী রায়বেরিলিতে আসার পর স্থানীয় নেতারা মনে করছেন, রায়বেরিলি থেকে 'ইনডিয়া' জোটের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থীকে বেছে নিচ্ছেন তারা।

কংগ্রেস কর্মী মোহাম্মদ আক্রাম বলেন, 'গান্ধী পরিবার সবসময় এখান থেকে জিতেছে আর এবার রাহুল গান্ধী এখান থেকে প্রথমবার লড়াই করছেন। তিনি ইনডিয়া জোটের মুখ এবং এখন এখান থেকে কমপক্ষে ছয় লাখ ভোটে জিতবেন।'

কংগ্রেসের ঐতিহ্যবাহী আসন রায়বেরিলি

রায়বেরিলি আসনটিকে মনে করা হয় গান্ধী পরিবারের ঐতিহ্যবাহী আসন। তবে কয়েকবার এমনও হয়েছে, যখন এখান থেকে পরিবার-ঘনিষ্ঠ কাউকে ভোটে দাঁড় করানো হয়েছে। সোনিয়া গান্ধীর আগে ক্যাপ্টেন সতীশ শর্মা রাজীব গান্ধীর বন্ধু হিসেবে এখান থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন, তবে ২০০৪ সাল থেকে সোনিয়া গান্ধী ধারাবাহিকভাবে রায়বেরিলির এমপি থেকেছেন।

চলতি বছরের লোকসভা নির্বাচন শুরু হওয়ার আগে রায়বেরিলির এমপি সোনিয়া গান্ধী রাজস্থান থেকে রাজ্যসভার সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। তারপর থেকেই রায়বেরিলির মানুষের কৌতূহল বাড়তে শুরু করে যে, এবার এই আসন থেকে তাহলে ভোটে কে লড়বেন?

প্রায় ২০ বছর ধরে রায়বেরিলির এমপি থাকার পর সোনিয়া গান্ধী রাজ্যসভায় নির্বাচিত হয়ে এখানকার মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে একটি চিঠি প্রকাশ করেন। সোনিয়া গান্ধী তার আবেগঘন বার্তা শেষ করেন এই বলে যে, 'আমি জানি আপনারাও আমাকে এবং আমার পরিবারকে প্রতিটি অসুবিধায় সামলাবেন, যেমনটি এতদিন সামলিয়েছেন।'

এর আগে আলোচনা হয়েছিল যে, রাহুল গান্ধী আমেথি থেকে এবং প্রিয়াঙ্কা গান্ধী রায়বেরিলি থেকে ভোটে দাঁড়াবেন। রায়বেরিলি থেকে রাহুল গান্ধীর লড়াইয়ের পেছনে যে কৌশল কাজ করেছে, তা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে রায়বেরিলির প্রবীণ সাংবাদিক মহেশ ত্রিবেদি ব্যাখ্যা করেছিলেন, 'রাহুল গান্ধী তার মায়ের উত্তরাধিকার নিতে আসছেন। এটা কংগ্রেসের জন্য ইতিবাচক বার্তা। কিশোরী লাল শর্মা গান্ধী পরিবারের ঘনিষ্ঠ, তাই আমেথিতে ভোটের ময়দানেও তিনি শক্ত লড়াই দেবেন।'

কী বলছেন কংগ্রেস কর্মীরা?

কংগ্রেস কর্মী শকুন্তলা মৌর্য বলেন, রায়বেরিলি বরাবরই কংগ্রেসের সঙ্গে ছিল আর থাকবে। তার কথায়, 'এই সরকারের আমলে কৃষকদের অবস্থা এতটাই খারাপ হয়েছে যে, ফসলের দিকে তাকালে তাদের চোখে জল চলে আসে। এমন সরকার থাকা উচিত? কৃষিজমি ও কৃষকদের উন্নতি তো কংগ্রেস করেছে, সেচ-খাল বানিয়েছে। আজ ওইসব খাল না থাকলে কৃষক চাষ করতেই উৎসাহী হতো না। মৌর্য বলেন, 'স্কুল, হাসপাতাল- এসবও কংগ্রেসের উপহার। আপনি যদি মোদিজির তৈরি হাসপাতাল দেখাতে পারেন, তাহলে আমরাও খুশি হবো, আমাদের তো ফল দরকার। মোদিজির প্রতি আমাদের অ্যালার্জি নেই।'

জেলার আরেক সাংবাদিক চাঁদ খান ব্যাখ্যা করছিলেন, 'রায়বেরিলি থেকে রাহুল গান্ধীকে প্রার্থী করে কংগ্রেস মাস্টারস্ট্রোক খেলেছে। রায়বেরিলি তার মায়ের আসন এবং রাহুল গান্ধীকে দেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। রাহুল ওয়ানাড় থেকে লড়ছেন, তাই তিনি যদি রায়বেরিলি আসন ছেড়ে দেন, তবে উপনির্বাচন হবে, তখন সম্ভবত প্রিয়াঙ্কা গান্ধী রায়বেরিলি থেকে প্রার্থী হবেন।'

রায়বেরিলি গান্ধী পরিবারের শক্ত ঘাঁটি। রায়বেরিলির এমপি থাকাকালে ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু ১৯৭৭ সালে জরুরি অবস্থার পর ইন্দিরা গান্ধী জনতা পার্টির প্রার্থী রাজ নারায়ণের কাছে নির্বাচনে হেরে যান। সেই পরাজয়ের সাড়ে তিন বছরের মধ্যে ১৯৮০ সালে রায়বেরিলির মানুষ ইন্দিরা গান্ধীকে নির্বাচিত করেছিলেন। তবে তিনি এই আসনটি ছেড়ে দিয়ে অন্ধ্রপ্রদেশের মেডক আসনটি ধরে রাখেন।

আমেথি থেকে কিশোরী লাল শর্মাকে নির্বাচনে দাঁড় করানোর ব্যাপারে সাংবাদিক চাঁদ খান বলেন, 'আমেথি আসনটি কংগ্রেসের কাছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো। আবার কিশোরী লাল শর্মাকে অনেকটা গান্ধী পরিবারের সদস্যের মতোই দেখা হয়। তাই তাকে আমেথি থেকে প্রার্থী করা হয়েছে।'

রাহুল গান্ধী মনোনয়নের জন্য রায়বেরেলিতে পৌঁছলে বিজেপি সমর্থকরা 'রাহুল গান্ধী গো ব্যাক' বলে স্স্নোগান দিয়ে বিক্ষোভ দেখান। ব্যবসায়ী এবং বিজেপি সমর্থক অনুপ ত্রিপাঠি বলেন, 'রাহুল গান্ধী যখন রায়বেরিলিতে মনোনয়ন জমা করতে আসেন, তখন তার বিরোধিতা এ কারণে করা হয়েছিল যে, সোনিয়াজি গত পাঁচ বছর এখান থেকে এম থাকলেও রায়বেরিলিতে আসেননি। তাই এখানকার মানুষের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে, কংগ্রেসের পক্ষে নির্বাচনে জেতা মোটেই সহজ হবে না।'

বিজেপির প্রার্থী দীনেশ সিং

অন্যদিকে, আবারও বিজেপির প্রার্থী হয়েছেন দীনেশ সিং। তিনিও ৩ মে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। তার মনোনয়নের সময়ও বিজেপি কর্মীদের ভিড় দেখা গিয়েছিল, তবে রাহুল গান্ধীর মনোনয়নের তুলনায় কম মানুষ ছিলেন সেখানে। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর রাহুল গান্ধীকে নিশানা করে তিনি বলেন, 'আজ কংগ্রেস রাহুল গান্ধীর পরাজয়ের ভয়ে ভীত, তাই সবাই তার মনোনয়নের সময় এসেছে। সোনিয়াজি যখন কংগ্রেসের সভানেত্রী ছিলেন না, রায়বেরিলির এমপি ছিলেন, তখন দলের সভাপতি কেন রায়বেরিলিতে আসেননি? কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সভাপতি তো এই প্রথম রায়বেরিলিতে এলেন। যিনি বলছেন 'ভয় পেয়ো না', তিনি নিজেই কতটা ভয় পেয়েছেন যে, সোনিয়া, খাড়্‌গে, প্রিয়াঙ্কা তার সঙ্গে এসেছেন। কিন্তু রায়বেরিলির লোকেরা আমার সঙ্গে এসেছেন।' সিংয়ের মনোনয়নের সময়ে উপস্থিত ছিলেন উপমুখ্যমন্ত্রী ব্রজেশ পাঠক।

বিজেপি নেতা শশীকান্ত শুক্লা বলেন, 'কংগ্রেস রাহুল গান্ধীকে রায়বেরিলি থেকে প্রার্থী করেছে। তিনি আমেথি থেকে ওয়ানাড়ে গিয়েছেন এবং ওয়ানাড় থেকে রায়বেরিলিতে এসেছেন। এরপর রায়বেরিলি থেকে ইতালি যাবেন। এই প্রচারই আমরা এবার নির্বাচনে করব আর বিজেপি প্রার্থীকে বিপুল ভোটে জেতাব।'

গান্ধী পরিবার নিয়ে কী বলছেন মানুষ?

রায়বেরিলিতে গান্ধী পরিবার নিয়ে কোনো ক্ষোভ দেখা যাচ্ছে না। ইউপিএ সরকারের আমলে সোনিয়া গান্ধী এমপি থাকাকালে রায়বেরিলি রেল কোচ ফ্যাক্টরি, এইমস এবং এনআইএফটির মতো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রতিষ্ঠান পেয়েছে। কিন্তু ইউপিএ সরকার ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার পর থেকে সোনিয়া গান্ধীর রায়বেরিলিতে আসা কমিয়ে দেন। কেন্দ্রে সরকার না থাকায় রায়বেরিলির মানুষকে দেওয়ার জন্য এমপি ফান্ডের প্রকল্পগুলোর সুবিধা ছাড়া সোনিয়া গান্ধীর আর কিছুই দেওয়ার ছিল না।

এমপি হিসেবে সোনিয়া গান্ধী রায়বেরিলিতে আসেন না বলে বিজেপি নেতারা বহুবার অভিযোগ তুলেছেন। কিন্তু রায়বেরিলির সাধারণ যুবকদের ওপর এর তেমন প্রভাব পড়েছে বলে মনে হয় না। রায়বেরিলির যুবক সঞ্জয় যাদব বলেন, 'রায়বেরিলি থেকে রাহুল গান্ধীর জয় ১০০ শতাংশ নিশ্চিত। এখানে যা আছে সবই কংগ্রেসের দান। বিজেপি গত ১০ বছরে রায়বেরিলিতে কোনো কাজ করেনি।' অশ্বিনীও এর সঙ্গে একমত। তার কথায়, 'রায়বেরিলিতে যা কিছু হয়েছে, তা কংগ্রেস করেছে। বিজেপি গত ১০ বছরে কিছুই করেনি। রাহুল গান্ধী বিপুল ভোটে জিততে চলেছেন।

সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন, এমন এক যুবতী পূজা প্যাটেল বলছিলেন, 'আমরা চেয়েছিলাম রাহুল গান্ধী রায়বেরিলি থেকে ভোটে লড়াই করুন আর বিপুল ভোটে জয়ী হোন। তার দল যুবসমাজের কথা বলে। সবচেয়ে বেশি ভুগছি তো আমরাই। চাকরি তৈরি হচ্ছে, অথচ প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। রাহুল গান্ধীর কাছ থেকে আমাদের আশা আছে, কারণ তিনি ছাত্রসমাজের ব্যাপারেও সরব। তিনি সহজেই জিতবেন।'

রায়বেরিলির সিনিয়র সাংবাদিক সঞ্জয় মৌর্য বলেন, 'দীর্ঘ অপেক্ষা এবং জল্পনা ছিল যে, গান্ধী পরিবার থেকে একজন প্রার্থী আসবেন। রাহুলজি আসায় উৎসাহ বেড়েছে। দীনেশ প্রতাপ গতবার ভালো লড়াই করে তিন লাখ ৬৮ হাজার ভোট পেয়েছিলেন। কিন্তু গতবার মোদির নামে ওয়েভ (ঢেউ) ছিল। এই মুহূর্তে দীনেশ প্রতাপ সিং রাজ্য সরকারের মন্ত্রী হলেও কোনো ওয়েভ নেই। তাই নির্বাচন আকর্ষণীয় হবে।' তথ্যসূত্র : বিবিসি নিউজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে