ইসরাইলের গাজা আগ্রাসন
আমেরিকায় বিক্ষোভের ছয় দিক
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষোভ সমাবেশ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তা হলো- বিক্ষোভ সমাবেশে জড়িত ছাত্ররা গড় আমেরিকার মধ্যবিত্তের প্রতিনিধি নয়। এসব ছাত্রের বেশিরভাগই আমেরিকার সিনেটর, ধনী ব্যক্তি এবং উচ্চ-সমাজ পরিবারের সন্তান। আমেরিকার শক্তিশালী ইহুদিবাদী লবির সঙ্গে তাদের ভালো যোগাযোগ রয়েছে এবং মার্কিন রাজনীতিতে প্রভাব বজায় রাখার জন্য এসব এলিট শ্রেণির কাছ থেকে সমর্থন পাওয়াটা বেশিরভাগ রাজনীতিবিদদের জন্য জরুরি...
প্রকাশ | ০৫ মে ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি ডেস্ক
বর্তমানে আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের শাসকগোষ্ঠীর গণহত্যার বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছেন। ছাত্রদের ক্লাস করার ওপর স্থগিতাদেশ, গ্রেপ্তার এবং চাকরির সুযোগ হারানোর মতো নানা ধরনের হুমকি সত্ত্বেও আমেরিকার শিক্ষার্থীরা এই বিক্ষোভ অব্যাহত রেখেছেন। রোববার এই বিক্ষোভ দ্বিতীয় সপ্তাহে গড়িয়েছে।
ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে মার্কিন শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ নিউইয়র্ক শহরের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু হয়েছিল এবং এখন তা আমেরিকার আরও ৩২টি বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। আমেরিকার শিক্ষার্থীরা, যারা মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে জায়নবাদীদের সঙ্গে আর্থিক ও নৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি জানাচ্ছেন। তারা আরও ঘোষণা দিয়েছেন, ফিলিস্তিনিদের পক্ষে এই প্রতিবাদ আন্দোলনের জন্য নিজেদের গর্বিত মনে করছেন। সবচেয়ে ইতিবাচক যে বিষয়টি বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, তা হলো- ফিলিস্তিনের গাজায় গত সাত মাস ধরে চলতে থাকা ইসরাইলি আগ্রাসনের প্রতিবাদে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। বার্লিনে পার্লামেন্ট ভবনের বাইরে শিবির স্থাপন করেছেন যুদ্ধবিরোধী কর্মীরা। প্যারিসের নামকরা 'সায়েন্সেস পো ইউনিভার্সিটি'তে মূল ভবনের বাইরে বিক্ষোভের কারণে কর্তৃপক্ষ অনলাইনে ক্লাস নিতে বাধ্য হয়। সুইডেনেও গত শনিবার অনুষ্ঠিত হয়েছে গাজা যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ। বিক্ষোভে জনতা 'ফিলিস্তিন মুক্ত করো' এবং 'ইসরাইলকে বয়কট করো' স্স্নোগান দেন। এ ছাড়া শনিবার বিকালে লন্ডনের কেন্দ্রস্থলে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করতে শত শত লোক জড়ো হন।
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষোভ সমাবেশ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তা হলো- বিক্ষোভ সমাবেশে জড়িত ছাত্ররা গড় আমেরিকার মধ্যবিত্তের প্রতিনিধি নয়। এসব ছাত্রের বেশিরভাগই আমেরিকার সিনেটর, ধনী ব্যক্তি এবং উচ্চ-সমাজ পরিবারের সন্তান। আমেরিকার শক্তিশালী ইহুদিবাদী লবির সঙ্গে তাদের ভালো যোগাযোগ রয়েছে এবং মার্কিন রাজনীতিতে প্রভাব বজায় রাখার জন্য এসব এলিট শ্রেণির কাছ থেকে সমর্থন পাওয়াটা বেশিরভাগ রাজনীতিবিদদের জন্য জরুরি।
আমেরিকার ছাত্ররা কী বলছেন?
ইসরাইলের শাসকগোষ্ঠীর নানা অপরাধযজ্ঞ এবং তাদের প্রতি মার্কিন সরকারের সমর্থন নিয়ে আন্দোলনরত ছাত্রদের দাবিগুলো একেক বিশ্ববিদ্যালয়ে একেক রকম। শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রধান দাবিগুলোকে সংক্ষিপ্ত করা যেতে পারে-
'সামরিক অস্ত্র প্রস্তুতকারকদের সঙ্গে ব্যবসা করা বন্ধ করুন, যারা ইসরাইলকে অস্ত্র সরবরাহ করে। শাসকগোষ্ঠীর সামরিক প্রচেষ্টাকে সহায়তা করে- এমন প্রকল্পের জন্য তাদের কাছ থেকে গবেষণার অর্থ গ্রহণ করা বন্ধ করুন।'
জায়নবাদী কোম্পানি বা ঠিকাদারদের কাছ থেকে লাভবান পরিচালকদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের এনডাউমেন্টে বিনিয়োগ করা এড়িয়ে চলুন। 'ইহুদিবাদীদের কাছ থেকে কী অর্থ পাওয়া যায় এবং এগুলো কী কাজে ব্যবহার করা হয়, সে সম্পর্কে আরও স্বচ্ছ হন।'
আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফিলিস্তিন সমর্থকদের বিক্ষোভ নিয়ে ছয়টি বিষয় আলোচনা করা হলো-
তরুণ আমেরিকান শ্রেণির মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি
বয়স্ক আমেরিকানদের তুলনায় তরুণ আমেরিকানরা বৈশ্বিক সংকট এবং সমস্যা সম্পর্কে অনেক বেশি সচেতন। 'জেনারেশন জেড' শিক্ষার্থীরা যারা বস্ন্যাক লাইভস ম্যাটার, জলবায়ু পরিবর্তন ও বন্দুকের নিরাপত্তার মতো যৌথ কর্মকান্ডের যুগে বড় হয়েছেন, তারা এখন ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার সমর্থনে বিস্তৃত জোট গঠন করছেন, যা আমেরিকার রাষ্ট্রনায়কদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে ছাত্রদের দমন করার লক্ষ্যে তারা নতুন নতুন আইন পাস করছে এবং তাদের গ্রেপ্তার করছে।
ছাত্রদের ওপর দমনপীড়ন
যুগ যুগ ধরে ইসরাইল কোনো যুক্তি ছাড়াই ফিলিস্তিনিদের গণহত্যা করে আসছে। গাজা যুদ্ধ তাদের নজিরবিহীন বর্বরতা বিশ্বের সামনে উন্মুক্ত হয়েছে। খাদ্য সহায়তা পাওয়ার অপেক্ষায় থাকা ছোট ছোট শিশুরা ইসরাইলি সেনাদের বন্দুকের গুলিতে নিহত হওয়া, কান্নারত মা এবং ক্ষুধার্ত মানুষের পোড়া লাশের ছবি বিশ্বজুড়ে বিবেকবান মানুষের আবেগকে আলোড়িত করেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একাত্মতা ঘোষণা
মনে হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের বহিষ্কার বা তাদের ছাত্রত্ব স্থগিত করার সিদ্ধান্তটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে বিপরীত প্রভাব ফেলেছে। কারণ, আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের শত শত ফ্যাকাল্টির সদস্য শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলেছেন, 'আমরা ছাত্রদের সাসপেন্ড করব না'। গত সপ্তাহে, 'আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অফ ইউনিভার্সিটি প্রফেসরস' ছাত্রদের শিক্ষা স্থগিতাদেশ ও তাদের গ্রেপ্তারের নিন্দা জানিয়ে একটি বিবৃতি জারি করেছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, 'আমরা প্রেসিডেন্ট ও সরকারের প্রতি আস্থা হারিয়েছি এবং আমরা তাদের বিশ্ববিদ্যালয় ফিরিয়ে নিতে প্রতিশ্রম্নতিবদ্ধ।'
মার্কিন রাজনীতিবিদরা ইসরাইলের পক্ষ নিয়েছেন
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং অন্য আমেরিকান কর্মকর্তারা ইসরাইল তথা ইহুদিবাদীদের (জায়নিস্ট) গোঁড়া সমর্থক। জো বাইডেন নিজেকে প্রকাশ্যে একজন কট্টর ইহুদিবাদী সমর্থক হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে নৃশংস ইহুদিবাদী যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ার জন্য সমালোচনার মুখে পড়া বাইডেন ইহুদিবাদী বিরোধিতা উত্থানের বিষয়ে সতর্ক করে একটি বিবৃতি দিয়েছেন।
আমেরিকায় ইহুদিবাদী তদবির অব্যাহত
যদিও ফিলিস্তিনপন্থি শত শত বিক্ষোভকারী কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আইনি পদক্ষেপ এবং হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। জানা গেছে, অল্পসংখ্যক ইহুদিবাদী বিক্ষোভকারী ইসরাইলি সেনাবাহিনীর একটি ইউনিটের পতাকা 'কেফির' বহন করে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে স্স্নোগান দিয়েছে যে, 'ইসরাইলের জয় হয়েছে'।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দাবি
যদিও মার্কিন কর্মকর্তারা প্রতিবাদী ছাত্রদের সুনির্দিষ্ট এবং সুস্পষ্ট লক্ষ্য ছাড়াই বিক্ষুব্ধ তরুণদের একটি দল হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা করছেন। বাস্তবতা হলো- আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভকারীরা আন্দোলনে তাদের দাবিগুলো স্পষ্টভাবে বলেছেন। শিক্ষার্থীরা তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসকদের কাছ থেকে জবাবদিহিতা চাইছেন, যাদের তারা ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত বলে মনে করে। কারণ, এই প্রশাসকরা যুদ্ধে সহায়তাকারী কোম্পানিগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিনিয়োগ বন্ধ করেনি। আমেরিকার বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাড়তি তহবিল তাদের অর্থ ইহুদিবাদী কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগ করেছে, যেগুলো জাতিসংঘের মতে, গাজা যুদ্ধে জড়িত। তথ্যসূত্র : পার্স টুডে