টার্গেট মুসলমান

আর ইশারা নয়, সরাসরি আক্রমণে মোদি

রাম মন্দিরের উদ্বোধনের সময় যদি বিজেপি নির্বাচন করিয়ে নিতে পারত, তা হলে ভালো ফল হতো। এখন কিন্তু আঞ্চলিক পর্যায়ে প্রতিরোধ বাড়ছে। লোকসভা নির্বাচনে ৪০০ আসন পার করার বিষয়টা যেভাবে ভাসিয়ে দিতে পেরেছিল, বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে সেটা কঠিন হচ্ছে...

প্রকাশ | ০৪ মে ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
নির্বাচনী প্রচারণায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি
আর আকারে-ইঙ্গিতে নয়, তার বিরুদ্ধে তোলা ধর্মীয় মেরুকরণ এবং নির্বাচনের আদর্শ আচরণবিধি মেনে না চলার অভিযোগের মাঝেই লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে এবার সরাসরি মুসলমানদের নিশানা করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। গত মঙ্গলবার তেলেঙ্গানায় এক জনসভায় তিনি জানিয়েছেন, কংগ্রেস যদি তফশিলি জাতি ও জনজাতি, দলিত, ওবিসির সংরক্ষণ কেড়ে নিয়ে মুসলমানদের দিতে চায়, তাহলে প্রধানমন্ত্রী কিছুতেই তা হতে দেবেন না। গত কয়েকদিনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নানা বক্তব্যকে ঘিরে সমালোচনায় সরব হয়েছেন বিরোধীরা। মোদির বিরুদ্ধে ধর্মীয় মেরুকরণ, ঘৃণা-সূচক বক্তব্যসহ একাধিক অভিযোগ তুলেছেন তারা। অভিযোগ উঠেছে নির্বাচনের আবহে আদর্শ আচরণবিধি ভঙ্গেরও। নির্বাচন কমিশনের তরফে তার দলের কাছে এ বিষয়ে ব্যাখ্যাও চাওয়া হয়েছে। কিন্তু তারই মধ্যে আরও একবার মোদির গলায় একই সুর শোনা গেল। তবে অন্যবারের মতো আকারে-ইঙ্গিতে নয়, বরং সরাসরি। তেলেঙ্গানার জাহিরাবাদের নির্বাচনী প্রচারসভা থেকে নরেন্দ্র মোদি বলেন, 'যতদিন আমি বেঁচে আছি, দলিত জনজাতিদের সংরক্ষণকে ধর্মের ভিত্তিতে মুসলমানদের হাতে তুলে দেব না, দেব না, দেব না! কংগ্রেস এবং তাদের যত সহযোগী রয়েছে, তারা কান খুলে এই কথাটা শুনে নাও।' এত বিতর্কের পরও কেন একই পথে হাঁটছেন মোদি, সে নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কংগ্রেস সভাপতি মলিস্নকার্জুন খাড়্‌গে নরেন্দ্র মোদির সমালোচনা করে বলেছেন, কংগ্রেস সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পথে রয়েছে এবং সেই কারণে 'মঙ্গলসূত্র' আর 'মুসলমানদের' প্রসঙ্গ বারবার সামনে নিয়ে আসছেন প্রধানমন্ত্রী। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদেরও অনেকে মনে করেন, বিজেপি সাম্প্রদায়িক ইসু্যকেই সামনে এনে ভোটে জিততে মরিয়া। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির গবেষক ও লেখক স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য বলেন, 'সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্নটাই যাতে না থাকে, তার চেষ্টা করছে বিজেপি। ওরা চায় অন্য ইসু্য নয়, সাম্প্রদায়িকতার ইসু্যটা সামনে রেখে ভোট হোক।' দুই দফা ভোটের পর নিজেদের অবস্থা সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে পড়েছে বিজেপি, তেমনটাও মনে করছেন অনেকে। অন্যদিকে, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. বিশ্বনাথ চক্রবর্তী নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তার বক্তব্য, 'ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতি যারা করছেন, তাদের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশন কেন পদক্ষেপ নিচ্ছে না?' 'মুসলমানকে রাতারাতি ওবিসি বানিয়ে দিচ্ছে' সরাসরি উলেস্নখ না করলেও সাম্প্রতিক নির্বাচনী প্রচারসভা থেকে মোদির বক্তব্যে যে কয়টি বিষয় ঘুরে ফিরে এসেছে, তার মধ্যে রয়েছে- বিরোধীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ, কৃষকদের প্রতি বিজেপির সমর্থন, অবিজেপি শাসিত রাজ্যে নারীদের বেহাল দশা, উন্নয়নের খতিয়ান এবং আরও অনেক প্রসঙ্গ। উঠে এসেছে রামমন্দিরের প্রসঙ্গ, অথবা কীভাবে পশ্চিমবঙ্গের মতো কয়েকটি রাজ্যে রাম নবমী বা দুর্গাপূজা করতে দেওয়া হয় না। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন চালু করা, জম্মু-কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার, তিন তালাক বাতিলের ফলে মুসলমান নারীরা কতটা লাভবান হয়েছেন কিংবা ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের মতো বিভিন্ন বিষয়ও এসেছে। গত ২১ এপ্রিল রাজস্থানের জনসভায় নরেন্দ্র মোদি সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ১৮ বছরের পুরনো একটি মন্তব্য টেনে এনেছিলেন। রাজস্থানে প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেন, 'কংগ্রেস পার্টি কীভাবে বাবা সাহেব আম্বেডকরের সংবিধান নিয়ে খেলা করার চেষ্টা করছে দেখুন। এদেশে সংবিধান তৈরির সময় ধর্মের ভিত্তিতে সংরক্ষণের তীব্র বিরোধিতা হয়েছিল, যাতে আমাদের এসসি, এসটি, ওবিসি সম্প্রদায় সুরক্ষা পেতে পারে। কিন্তু মনমোহন সিং একটি ভাষণ দিয়েছিলেন এবং আমি সেই সভায় উপস্থিত ছিলাম মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে। মনমোহন সিং বলেছিলেন, দেশের সম্পদের ওপর মুসলমানদের প্রথম অধিকার রয়েছে। এটা মনমোহনজির বক্তব্য। এটা কাকতালীয় ছিল না, বা শুধু একটা বিবৃতি ছিল না। কারণ কংগ্রেস পার্টির চিন্তাভাবনা সবসময়ই তুষ্টির, ভোটব্যাংকের।' এ ছাড়া রাজস্থানের বানসওয়ারায় নরেন্দ্র মোদির বক্তৃতায় সরাসরি 'মুসলিম' শব্দের উলেস্নখ ছিল না, কিন্তু ইঙ্গিত ছিল স্পষ্ট। সেখানে 'অনুপ্রবেশকারী', 'যাদের বেশি সন্তান থাকে' এসব বলে মোদি বোঝাতে চেয়েছিলেন তার বক্তব্যের নিশানা কারা ছিল। সে সময় পরপর তিনটি সভায় তার বক্তব্যকে ঘিরে ধর্মীয় মেরুকরণের অভিযোগ উঠেছিল। এরপর বিরোধীদের তো বটেই, নাগরিক সমাজ, এমন কি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও কড়া সমালোচনার শিকার হতে হয়েছিল মোদিকে। নির্বাচন কমিশনে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন মানুষ ও সংগঠন মিলিয়ে ২০ হাজার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল। আদর্শ আচরণবিধি না মানার অভিযোগ তুলে নির্বাচন কমিশনের দ্বারস্থ হয়েছিল কংগ্রেসও। এরপর গত ২৫ এপ্রিল কমিশনের তরফে বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতির কাছে ব্যাখ্যাও চাওয়া হয়েছে ১৪ দিনের মধ্যে। এই বিতর্কের মাঝেই বারবার প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে উঠে এসেছে প্রায় একই ধরনের বক্তব্য। মহারাষ্ট্রের সাতারার সভায় যেমন কংগ্রেসকে নিশানায় রেখে তিনি বলেছেন, 'ভারতীয় সংবিধান জাতপাতের ভিত্তিতে সংরক্ষণ মানে না। কিন্তু ওরা কী করেছে? কর্ণাটকে রাতারাতি সব মুসলমানকে ওবিসি ঘোষণা করে ২৭ শতাংশ ওবিসি সংরক্ষণ করে দিয়েছে ওরা।' তিনি কংগ্রেসকে আক্রমণ করে বলেন, ওই দলটি পুরো দেশে একই ফর্মুলা প্রয়োগ করতে চায় এবং সংবিধান পরিবর্তন করতে চায়। তবে তিনি তা হতে দেবেন না। তেলেঙ্গানার জনসভাতেও প্রায় একই অভিযোগ তোলেন তিনি। মোদি অভিযোগ করেন, যারা কংগ্রেসের 'ভোটব্যাংক নয়' তাদের বিন্দুমাত্র দাম নেই ওই দলের কাছে। বলেন, হায়দরাবাদে রামনবমীর শোভাযাত্রা আটকে দিয়েছে কংগ্রেস, যাতে তাদের 'ভোটব্যাংক' তুষ্ট হয়। তার কথায়, 'এখানে লিঙ্গায়েত এবং মারাঠিদের ২৬টি জাতি রয়েছে, যারা ওবিসি-ভুক্ত হতে চায়। কিন্তু তাদের ওবিসি বানাতে আগ্রহী নয় কংগ্রেস, অথচ মুসলমানকে রাতারাতি তারা ওবিসি বানিয়ে দিচ্ছে।' বিরোধীরা অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর তীব্র সমালোচনা করছেন যথারীতি। ছত্তিশগড়ের একটি জনসভায় গত মঙ্গলবার মলিস্নকার্জুন খাড়্‌গে বলেন, 'আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে চলেছি এবং এ কারণে তিনি (মোদি) সবসময় মঙ্গলসূত্র এবং মুসলমানদের কথা বলছেন।' তিনি আরও বলেন, 'আমরা আপনার সম্পদ চুরি করে যাদের আরও সন্তান আছে, তাদের দেব। দরিদ্র মানুষের সবসময়ই বেশি সন্তান থাকে... শুধু মুসলমানদেরই কি সন্তান থাকে? আমার পাঁচজন সন্তান রয়েছে।' ধর্মের রাজনীতি? হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির গবেষক ও লেখক স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য অবশ্য জানিয়েছেন, বিজেপির কাছে 'ধর্মের রাজনীতি' নতুন কিছু নয়। তার কথায়, 'বিজেপি বরাবরই এটা করে এসেছে। ২০২১ সালে আসাম নির্বাচনকে তারা সরাইঘাটের যুদ্ধ বলে ঘোষণা করেছিল, যে যুদ্ধ মুঘলদের সঙ্গে হয়েছিল। বিজেপি কিন্তু বরাবরই মুসলমানদের মুঘল, বহিরাগত, অনুপ্রবেশকারী- এসব বলে এসেছে।' মোদির সাম্প্রতিক বক্তব্যে ধর্মীয় মেরুকরণের বিষয়টা আরও তীব্র হবে, এ কথাও মেনে নিয়েছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার সময় থেকেই এই একই রাজনীতি করে এসেছেন। স্নিগ্ধেন্দু বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর মুসলমান শব্দটা ব্যবহার না করে ইঙ্গিতে বোঝাতেন। তাই তার রাজনীতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। গত ১০ দিনে এর উগ্রতা বেড়েছে মাত্র। এখন আর ইঙ্গিতের ভরসায় আর থাকছেন না। ইশারায় বললে যদি না বোঝে!' তবে ধর্মকে প্রচারের অস্ত্র করার পেছনে অন্য কারণের উলেস্নখও করেছেন স্নিগ্ধেন্দু। তার কথায়, 'যে ধনসম্পদ পুনর্বণ্টনের কথা বলছে কংগ্রেস, সেটা সব পিছিয়ে থাকা মানুষের মধ্যে সম্পদের ন্যায়সঙ্গত পুনর্বণ্টন। সেখানে সমাজের পিছিয়ে থাকা বর্গের মধ্যে সংখ্যালঘুরাও আছে। আর বিরোধীরা কিন্তু এটা লক্ষ্য করেছে যে, মোদির শাসনকালে দেশে অর্থনৈতিক বৈসাম্য বাড়ছে। নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসলে এই অসমতা আরও বাড়বে।' সেই সব প্রশ্ন এড়াতেই বিজেপি ধর্মকে হাতিয়ার করছে বলে তিনি মনে করেন। স্নিগ্ধেন্দু বলেন, 'সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্ন বিরোধীরা তুলে ধরেছেন বলে উনি আতঙ্কিত। সেই কারণে এত তীব্র মুসলমান বিদ্বেষ নিয়ে বিজেপি মাঠে নামছে।' অন্যদিকে, রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী বলছেন, বিজেপির মতোই অন্যান্য রাজনৈতিক দলও একইভাবে ধর্মের রাজনীতির পথে হেঁটেছে। ড. বিশ্বনাথের কথায়, 'শুধু নরেন্দ্র মোদিই নন, অন্যান্য রাজনৈতিক দলও নিজেদের সুবিধামতো ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতি করছে। কিন্তু এই অপব্যবহার রুখতে নির্বাচন কমিশন ব্যর্থ হয়েছে। অথচ এটা একটা স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। সেখানে অভিযোগ জানানো সত্ত্বেও কেন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি? দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, নির্বাচন কমিশন তাদের নিজেদের তৈরি আচরণবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে। শুধু নরেন্দ্র মোদির ক্ষেত্রেই নয়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রেও তো একই ঘটনা ঘটেছে।' লোকসভা নির্বাচনের সময় বহাল থাকা আচরণবিধি অনুযায়ী ভোটের প্রচারের সময় কোনো ধর্মীয় প্রতীক ব্যবহার করা যাবে না এবং ধর্ম, সম্প্রদায় বা বর্ণের ভিত্তিতে ভোট দেওয়ার আবেদন করা যাবে না। ধর্মীয় বা জাতিগত সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য বা স্স্নোগান দেওয়াও নিষিদ্ধ। তা সত্ত্বেও বারবার রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে ওই নীতি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। বিজেপির '৪০০ পার'? এদিকে, নির্বাচনে আশানুরূপ ফল হবে না বলে বিজেপি আতঙ্কিত বলেও মন্তব্য করেছে বিরোধীরা। সমাজবাদী পার্টির প্রেসিডেন্ট অখিলেশ যাদব বলেছেন, 'বিজেপি জানে ওরা হেরে যাবে, তাই এসব মন্তব্য করছে।' এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে অধ্যাপক চক্রবর্তী বলেন, 'রাম মন্দিরের উদ্বোধনের সময় যদি বিজেপি নির্বাচন করিয়ে নিতে পারত, তা হলে ভালো ফল হতো। এখন কিন্তু আঞ্চলিক পর্যায়ে প্রতিরোধ বাড়ছে। লোকসভা নির্বাচনে ৪০০ আসন পার করার বিষয়টা যেভাবে ভাসিয়ে দিতে পেরেছিল, বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে সেটা কঠিন হচ্ছে।' তথ্যসূত্র : বিবিসি নিউজ