ভারতে লোকসভা নির্বাচন

কেজরিকে গ্রেপ্তার বুমেরাং হয়েছে শঙ্কার মেঘ 'পদ্মকাননে'

আম আদমি পার্টিসহ ভারতের অন্যান্য বিরোধী দল সাধারণ মানুষকে যেটা বোঝাতে চেয়েছিল, তা প্রায় পুরোপুরি বিশ্বাস করে নিয়েছে দিলিস্নর এক বড় অংশের মানুষ। তারা মনে করছে, সত্যি সত্যিই রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে বেছে বেছে বিরোধী দলের নেতাদের বিভিন্ন এজেন্সির মাধ্যমে ভয় দেখাচ্ছে বিজেপি। তাতে লাভ না হলে চালান করে দেওয়া হচ্ছে হাজতে... অরবিন্দ কেজরিওয়ালের গ্রেপ্তারের ঘটনায় লোকসভা নির্বাচনের আগে যথেষ্ট চাপে বিজেপি। গতবারের যা ফল, তার থেকে ভালো করার আর কোনো রাস্তা নেই বিজেপির। পাঁচ বছর আগে সাতের সাতটি আসনেই ফুটেছিল পদ্ম। পাটিগণিতের নিয়মেই তাই এর থেকে উন্নততর ফল করা বিজেপির পক্ষে সম্ভব নয়। উল্টো যদি এক-আধটি আসনও হাতছাড়া হয়, সেক্ষেত্রে নৈতিক জয় হবে দিলিস্নর আপ-কংগ্রেস জোটের। ধাক্কা খাবে বিজেপি...

প্রকাশ | ০৩ মে ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
দিলিস্নর মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল -ফাইল ছবি
'কেসটা ফুল বুমেরাং হয়ে যাচ্ছে।' ক্রিকেটার গৌতম গম্ভীরের ছেড়ে আসা পূর্ব দিলিস্ন লোকসভা আসনের বিজেপি প্রার্থী হর্ষ মালহোত্রার এক নির্বাচনী কার্যালয়ে বসে কথা হচ্ছিল স্থানীয় কর্মীদের সঙ্গে। সেই সময়ই কানে এলো এই স্বগতোক্তি। না, শুধু এই একটি জায়গায় নয়। ভারতের রাজধানী দিলিস্ন জুড়ে বিজেপির যে কোনো পার্টি অফিস, নির্বাচনী কার্যালয়ে গেলেই শুনতে পাওয়া যাবে এই ধরনের কথাবার্তা। হয়তো প্রকাশ্যে নয়। আড়ালে-আবডালে। আসলে, বিজেপি ভেবেছিল লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে দিলিস্নর মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে গ্রেপ্তার করিয়ে কোমর ভেঙে দেওয়া যাবে আম আদমি পার্টির (আপ)। সাবেক উপমুখ্যমন্ত্রীসহ দলের একাধিক সিনিয়র হেভিওয়েট নেতাদের গ্রেপ্তার এক, আর খোদ দলের প্রধানকে গারদের পেছনে পাঠিয়ে দেওয়া আরেক। এই চালেই কেলস্নাফতে করার পরিকল্পনা ছিল 'পদ্ম শিবিরে'। কিন্তু ফুটবলে যেমন অফসাইড ট্র্যাপ করতে গিয়ে অনেক সময় ভুল করে ফেলেন বিশ্বের তাবড় ডিফেন্ডাররা, ভুল চালে গোল করে চলে যান প্রতিপক্ষের কোনো ধূর্ত স্ট্রাইকার, অনেকটা তেমনই হয়ে গেছে কেজরিওয়ালের ক্ষেত্রে। কেজরির গ্রেপ্তারির চালে ভুল হয়ে যাওয়ায় একসঙ্গে অনেকগুলো ক্ষতি হয়ে গেছে বিজেপির। প্রথমত, আম আদমি পার্টির দ্বিতীয় সারির নেতারা ভয় পেয়ে কাবু হয়ে যাওয়ার বদলে আরও বেশি করে 'ইনকিলাবি' হয়ে উঠেছেন। আইপিএল আবহে অতীশি, সৌরভ ভরদ্বাজরা প্রায় রোজই ব্যাট করতে নামছেন টি-২০ মেজাজে। হাঁটু কাঁপা তো দূর, উল্টো এখন পর্যন্ত খোলা আকাশের নিচে থাকা বাকি নেতাদের একজোট করে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নির্বাচনী প্রচার চালানোর পাশাপাশি সংবাদ সম্মেলন ডেকে আক্রমণ করে যাচ্ছেন বিজেপি ও তাদের নীতিকে। উপরি পাওনা হিসেবে তারা পেয়ে যাচ্ছেন সাধারণ মানুষের সমর্থন। নির্বাচনের বাজারে যার থেকে বড় 'তোফা' আর কিছুই হতে পারে না। দ্বিতীয়ত, আম আদমি পার্টিসহ ভারতের অন্যান্য বিরোধী দল সাধারণ মানুষকে যেটা বোঝাতে চেয়েছিল, তা প্রায় পুরোপুরি বিশ্বাস করে নিয়েছে দিলিস্নর এক বড় অংশের মানুষ। তারা মনে করছে, সত্যি সত্যিই রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে বেছে বেছে বিরোধী দলের নেতাদের বিভিন্ন এজেন্সির মাধ্যমে ভয় দেখাচ্ছে বিজেপি। তাতে লাভ না হলে চালান করে দেওয়া হচ্ছে হাজতে। অন্য দলগুলোর তুলনায় আম আদমি পার্টিকে যে বিষয়টি বেশি সাহায্য করছে, তা হলো- এখন পর্যন্ত আবগারি দুর্নীতির তদন্তে অর্থ তছরুপের সামান্যতম হদিস না মেলা সত্ত্বেও কেজরিওয়াল, মণীশ সিসোদিয়াদের গ্রেপ্তার করে রাখা হয়েছে। 'ফ্লোটিং ভোটার' হিসেবে যারা পরিচিত, ঘরোয়া আলোচনায় তাদের অনেকেই আপ নেতাদের সুরে প্রশ্ন করছেন, কোটি কোটি টাকার যে কথা বলা হচ্ছে, সেগুলোর কানাকড়িও উদ্ধার হলো না কেন? যদি নাই হলো, তাহলে কোন যুক্তিতে হাজতবাস করতে হচ্ছে মুখ্যমন্ত্রী ও সাবেক উপ-মুখ্যমন্ত্রীকে? কেন এই প্রশ্ন করছে দিলিস্নবাসী? এর চিন্তা করলেই মিলবে বিজেপির বিরুদ্ধে চলা চোরাস্রোতের তৃতীয় কারণ। স্বাধীন ভারতে কেজরিওয়ালই প্রথম মুখ্যমন্ত্রী, যাকে হাজতবাস করতে হয়েছে। এর আগে জেলে যাওয়া বাকিদের মতো, তিনি পদত্যাগ করেননি। ভারতীয় সংবিধানে তেমন কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকায়, গারদের ওপার থেকেই তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন প্রশাসনিক কাজ। যার জেরে দিলিস্ন সরকারের দৈনন্দিন কাজে ব্যাপক ব্যাঘাত ঘটছে। সমস্যায় পড়তে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। এই কারণেই ক্ষোভ বাড়ছে সাধারণ মানুষের মনে। আম আদমি পার্টির এক মুখপাত্রের 'বেসরকারি' বক্তব্য অনুযায়ী তারা এখন অপেক্ষা করছেন বিজেপির পরবর্তী চালের জন্য। আপাতত যা খবর, তাতে হাজার চাপ এলেও মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে কেজরির পদত্যাগের সম্ভাবনা বেশ কম। এই পরিস্থিতিতে যদি দিলিস্নতে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করে দেয় কেন্দ্রীয় সরকার, তাহলে 'পোয়াবারো' হবে আম আদমি পার্টির। সেই নেতার বক্তব্য অনুযায়ী, সেক্ষেত্রে তারা দিলিস্নবাসীদের দরবারে এই বার্তা নিয়ে যাবেন, কীভাবে ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে দেশের রাজধানীতে গণতন্ত্রের গলা টিপে হত্যা করছে কেন্দ্রের শাসক। উল্টোদিকে বিজেপিও মোটামুটি আপ-এর এই চালের গন্ধ পেয়ে গেছে। তাই পরবর্তী পদক্ষেপ কী হওয়া উচিত, তা নিয়েই চলছে পদ্মকাননের 'চায়ে পে চর্চা'। কেজরিওয়ালের গ্রেপ্তারিতে চতুর্থ যে ধাক্কাটি খেয়েছে বিজেপি, তা হলো 'ইনডিয়া'র আরও কাছাকাছি চলে আসা। বিভিন্ন কারণে, সমীকরণে মাঝের সময়ে বিজেপিবিরোধী দলগুলোর বাঁধন একটু আলগা হয়েছিল। যা আরও কষে বসেছে দিলিস্ন মুখ্যমন্ত্রীর গ্রেপ্তারের পর। গত মাসের শেষদিনে দিলিস্নর রামলীলা ময়দানে হয়েছে মেগার্ যালি। যেখানে উপস্থিত ছিলেন 'ইনডিয়া'র বিভিন্ন শীর্ষ নেতা। যে দিলিস্ন রাজ্য কংগ্রেসের সঙ্গে ক'দিন আগেও 'আদায়-কাঁচকলায়' ছিল আম আদমি পার্টির সম্পর্ক, সেই অজয় মাকেনদের গলাতেও এখন সহানুভূতির সুর। সবমিলিয়ে বলা যেতেই পারে, অরবিন্দ কেজরিওয়ালের গ্রেপ্তারের ঘটনায় লোকসভা নির্বাচনের আগে যথেষ্ট চাপে বিজেপি। গতবারের যা ফল, তার থেকে ভালো করার আর কোনো রাস্তা নেই বিজেপির। পাঁচ বছর আগে সাতের সাতটি আসনেই ফুটেছিল পদ্ম। পাটিগণিতের নিয়মেই তাই এর থেকে উন্নততর ফল করা বিজেপির পক্ষে সম্ভব নয়। উল্টো যদি এক-আধটি আসনও হাতছাড়া হয়, সেক্ষেত্রে নৈতিক জয় হবে দিলিস্নর আপ-কংগ্রেস জোটের। ধাক্কা খাবে বিজেপি। আপাতত যা পরিস্থিতি, তাতে ৪ জুন হয়তো এই ছবিই দেখতে হতে পারে ভারতের রাজধানী শহরকে। এমনটাই বিশ্বাস রাজধানীর রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের। সেক্ষেত্রে কেজরির গ্রেপ্তারির পর হয়তো দিলিস্ন বিজেপির নেতাদের কানে ভাসছে সাড়ে ছয় দশক আগে কিশোর কুমার-মধুবালার 'চলতি কা নাম গাড়ি' ছবির সুপারহিট গানের এক লাইন। 'যাতে থে জাপান, পহোচ গয়ে চিন সমঝ গয়ে না...।' তথ্যসূত্র : ইনডিয়া টাইমস