রামমন্দিরের প্রভাব কম
পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে এবার হচ্ছে জাতের অংকে ভোট
প্রায় ১৪০ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভারত বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ। এ রকম একটা দেশের নির্বাচন সংক্রান্ত সংখ্যাগুলোর দিকে তাকালে মাথা ঘুরে যেতে পারে। লোকসভার ৫৪৩ জন সদস্যকে নির্বাচন করতে ছয় সপ্তাহ ধরে সাত দফায় ভোট নেওয়া হচ্ছে। নির্বাচনের ফল প্রকাশিত হবে ৪ জুন। এ নির্বাচনে ভোটারের সংখ্যা ৯৬ কোটি ৯০ লাখ...
প্রকাশ | ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি ডেস্ক
নতুন পিচ ঢালাই করা রাস্তায় একের পর এক আখবোঝাই লরি ছুটে যাচ্ছে। গন্তব্য খাটোলির চিনিকল। মাঠে এখনো কিছু জমিতে আখ রয়েছে কাটার অপেক্ষায়। তার সঙ্গে আছে গম। পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের অত্যন্ত উর্বর জমিতে এই দুই ফসলই কৃষকের ঘরে অর্থ নিয়ে আসে। তাই চলমান ভারতের লোকসভা ভোটের আগে রাজ্য সরকার আখের সংগ্রহমূল্য এক ধাক্কায় ৩০ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে। তারপরও মানুষের মন পাওয়া যাচ্ছে কি?
ভারতের উত্তরপ্রদেশের বা বলা ভালো পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের গ্রামের একটা চরিত্র আছে। প্রায় সব বাড়ি পাকা। গ্রামগুলো জাত-প্রধান। অর্থাৎ কোনো গ্রাম জাঠবহুল, কোথাও অন্য অনগ্রসরদের সংখ্যাধিক্য, কোথাও দলিত বা কোনো গ্রামে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ।
সেভাবেই গ্রামের পরিচয় দেন তারা। আর উত্তরপ্রদেশের আরেক বৈশিষ্ট্য হলো- মানুষ খোলাখুলিভাবে জানান, তারা কাকে ভোট দিয়েছেন। কোনো লুকোছাপা করেন না। গতবার কাকে ভোট দিয়েছিলেন, সেটাও জানিয়ে দেন।
গ্রামের অন্দরে
গত ১৯ এপ্রিল। দুপুরের রোদে পুড়ছে মুজফফরনগর। গরম হাওয়া বইছে। তার মধ্যে চলছিল সাত দফার প্রথম ভোটগ্রহণ পর্ব। গ্রামের ভেতরে একটি স্কুলে ভোটগ্রহণ চলছিল। ভেতরে কয়েকজন পুলিশ বসে। গ্রামবাসী আসছে-যাচ্ছে। বিকালের দিকে ভোটদাতার সংখ্যা বাড়ল।
ঠিক ওই ভোটকেন্দ্রের উল্টোদিকে রবিন্দরের বাড়ি। একটা দড়ির খাটিয়ায় বসে আছেন। মানুষজন ভোট দিয়ে আসা-যাওয়ার পথে সেখানে আসছেন। অনেককে রবিন্দরই ডেকে আনছেন। কাকে ভোট দিলেন? প্রশ্নটা করতেই সঙ্গে সঙ্গে জবাব এলো, 'হাতিতে'। হাতি হলো- বহুজন সমাজ পার্টি বা বসপার প্রতীক। অনগ্রসর রবিন্দর সেখানেই এবার ভোট দিয়েছেন। গতবার কাকে দিয়েছিলেন? জবাব এলো, 'বিজেপি-কে।' তাহলে এবার দলবদল করলেন? এবারও জবাব আসতে দেরি হলো না। তিনি বলেন, 'কী করব, এমপি হওয়ার পর সঞ্জীব বালিয়ান তো অনগ্রসরদের জন্য কিছু করেননি। তাই এবার তাকে ভোট দেইনি। বসপা প্রার্থী ভালো। তাই তাকেই ভোট দিয়েছি।'
পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন রামপাল। তিনি বললেন, 'দাঁড়ান, ভোটটা দিয়েই আসছি।' কাকে ভোট দেবেন? এবারও জবাব এলো- 'বিএসপি-কে'। কারণ, প্রার্থী দারা সিং প্রজাপতি হলেন কুমার। আর রামপালও কুমার। তাই দারা সিং-কে বাদ দিয়ে আর কাউকে ভোট দেওয়ার কথা ভাবতে পারছেন না। গতবার তিনিও বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলেন।
গ্রামপ্রধান হরদীপ অবশ্য জানালেন, তিনি তো বটেই, ওই গ্রামের প্রচুর মানুষ বিজেপিকেই ভোট দিচ্ছেন। কারণ অন্য কিছু নয়, তারা মোদিকেই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চান। সেজন্য বিজেপিতে ভোট পড়ছে।
দলিতপ্রধান গ্রামে
এবার যাত্রা একটা দলিতপ্রধান গ্রামে। একই রকম নিস্তরঙ্গ একটা স্কুলে ভোট চলছে। কোথাও কোনা অশান্তি নেই। গোলমাল নেই। ছাপ্পা ভোট নেই। শান্তিতে ভোট পড়ছে। সে রকম লাইনও নেই। সেখানেই দেখা রবিদাসের সঙ্গে। ভোট দিয়ে বেরিয়েছেন। তিনি বললেন, হাতিতে ভোট দিয়েছেন। এখানকার দলিত ভোট পড়ছে হাতিতে।
এবার উত্তরপ্রদেশে সবচেয়ে কম প্রচার করেছে বিএসপি। গত কয়েক বছরে মায়াবতীকে সে রকমভাবে সক্রিয় হতে দেখা যায়নি। তিনি মাঝেমধ্যে বিবৃতি দিয়েছেন মাত্র। তারপরও বিএসপিকে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের মানুষ ত্যাগ করেননি। দলিত ও কিছু অনগ্রসর হাতিতেই ভোট দিচ্ছেন।
রবিদাসের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মধ্যবয়সি জাঠ বললেন, তাদের ভোট বিজেপিতেই পড়ছে। তবে ভোট বিশেষজ্ঞ কপিলের দাবি, 'গতবার সঞ্জীব বালিয়ান মুজফফরনগরে হারিয়ে দিয়েছিলেন রাষ্ট্রীয় লোকদল নেতা অজিত চৌধুরীকে। তাই জাঠদের একাংশের বক্তব্য, তাদের নেতা অজিত সিংকে যিনি হারিয়েছিলেন, সেই সঞ্জীব বালিয়ানকে তারা ভোট দেবেন না।'
মুসলিম গ্রামের ছবি
গ্রামের ভেতরে মসজিদে নামাজ পড়া শেষ করে বের হওয়ার পর সাজিদ ও তার সঙ্গীরা জানালেন, তাদের ভোট সাইকেলে, অর্থাৎ সমাজবাদী পার্টিতেই পড়েছে। মুজাফফরনগরে মুসলিম ভোটদাতার সংখ্যা পাঁচ লাখ। অনগ্রসর ভোটদাতা আছেন সাড়ে পাঁচ লাখ। ফলে সংখ্যার হিসেবে মুসলিমরা এখানে দ্বিতীয় স্থানে। জাঠ ভোটদাতার সংখ্যা দেড় লাখ। আর বিজেপি ও সমাজবাদী পার্টি দুই দলের প্রার্থীই জাঠ।
আবেগের বিষয় নেই
সারাদিন ধরে মুজাফফরনগর ও তার আশপাশে ঘুরে একটা কথা স্পষ্ট, মানুষ কোনো আবেগের বিষয়কে সামনে রেখে ভোট দিচ্ছেন না। তারা ফিরে গেছেন তাদের জাতিগত পছন্দে। উত্তরপ্রদেশের পুরনো রাজনীতির অংক তাই আবার ফিরে এসেছে। কোন জাতের ভোট কার দিকে যাচ্ছে? তার ওপরই নির্ভর করছে কে জিতবেন।
কপিল বলছিলেন, 'এখানে রামমন্দিরের প্রভাব ভোটে পড়ছে না। সেটা পূর্ব উত্তরপ্রদেশে পড়তে পারে। কিন্তু পশ্চিমে এবার ভোট হচ্ছে পুরনো ধাঁচে। তাই লড়াইটাও জমজমাট হচ্ছে। বিজেপি হেসে-খেলে জিতবে এমন নয়।' কপিলের বক্তব্য, 'এবার বিজেপির চিরাচরিত সমর্থক রাজপুতরাও মুজাফফরনগরে ক্ষুব্ধ। কারণ রাজপুত নেতা সঙ্গীত সোম ও জেবারেল ভি কে সিংকে প্রার্থী করা হয়নি। ফলে রাজপুতদের প্রতিনিধি নেই বলে অনেকে এবার সাইকেলে ভোট দিচ্ছেন।' সে কারণেই গতবার বিজেপিতে পড়া ভোট এবার চলে যাচ্ছে বিএসপি বা সমাজবাদী পার্টিতে।
ভোটের অনিশ্চয়তা
ভারতে ভোটের বিষয়টাই এ রকম। সেখানে সবসময় একটা অনিশ্চয়তা কাজ করে। কোন বিষয় কাদের প্রভাবিত করবে, কখন করবে, তা বলা কঠিন। যেটা হয়েছে মুাজফফরনগরে। এক সময় ভয়ংকর দাঙ্গার পর এখানে ভোটের চিত্রটা ছিল আলাদা। এবার মেরুকরণ না থাকায় লড়াইটা অন্য মাত্রা পেয়েছে।
উলেস্নখ্য, প্রায় ১৪০ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভারত বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ। এ রকম একটা দেশের নির্বাচন সংক্রান্ত সংখ্যাগুলোর দিকে তাকালে মাথা ঘুরে যেতে পারে। লোকসভার ৫৪৩ জন সদস্যকে নির্বাচন করতে ছয় সপ্তাহ ধরে সাত দফায় ভোট নেওয়া হচ্ছে। নির্বাচনের ফল প্রকাশিত হবে ৪ জুন। এই নির্বাচনে ভোটারের সংখ্যা ৯৬ কোটি ৯০ লাখ।
একটা ধারণা দেওয়ার জন্য বলা যেতে পারে, আমেরিকা, রাশিয়া, জাপান, যুক্তরাজ্য, ব্রাজিল আর ফ্রান্সের জনসংখ্যার প্রায় সমসংখ্যক মানুষ ভারতের নির্বাচনের ভোটার তালিকায় রয়েছেন। ওইসব দেশগুলোর মিলিত জনসংখ্যা ভারতের ভোটারের সংখ্যার থেকে সামান্য কম, তাই ওই দেশগুলোর সঙ্গে বেলজিয়ামের জনসংখ্যাও জুড়ে দেওয়া যেতে পারে।
এবারের ভোটারদের মধ্যে ৪৯ কোটি ৭০ লাখ পুরুষ এবং ৪৭ কোটি ১০ লাখ নারী। তৃতীয় লিঙ্গ বা ট্রান্সজেন্ডার ভোটারের সংখ্যা প্রায় ৪৮ হাজার। আর প্রথমবার ভোট দেবেন, অর্থাৎ যাদের বয়স ১৮-১৯ বছর, এমন ভোটার এক কোটি ৮০ লাখ। প্রবীণ ভোটার, যাদের বয়স ৮৫ থেকে ৯৯ বছর, এ রকম ৮২ লাখ মানুষের নাম আছে ভোটার তালিকায়। এবার ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১০ লাখ। এই নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার হচ্ছে ৫৫ লাখ। তথ্যসূত্র : ডিডাবিস্নউ নিউজ, বিবিসি