ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি আগ্রাসন অবসানের দাবিতে আমেরিকাজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ব্যাপক বিক্ষোভ আরও ছড়িয়ে পড়েছে। গত কয়েকদিন ধরে চলা এই বিক্ষোভ ক্রমেই সহিংস হয়ে উঠছে। শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ঠেকাতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মোতায়েন করা হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য। বৃহস্পতিবার বিক্ষোভে অংশ নেওয়া শত শত শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করেছে মার্কিন পুলিশ। তথ্যসূত্র : বিবিসি, আল-জাজিরা
গাজা যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ইসরাইল-বিরোধী ব্যাপক বিক্ষোভের জেরে লস অ্যাঞ্জেলেসের 'দ্য ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া' (ইউএসসি) তার প্রধান স্নাতক অনুষ্ঠান বাতিল করেছে। নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে বাতিল করা হয়েছে অনুষ্ঠানটি। আগামী ১০ মে এটি হওয়ার কথা ছিল। গাজায় ইসরাইলের যুদ্ধ নিয়ে ইউএসসি ছাড়া দেশটির কয়েক ডজন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এখন বিক্ষোভে উত্তাল। এসব বিক্ষোভে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন অনেক শিক্ষকও। ওয়াশিংটনে বিক্ষোভকারীরা অবস্থান নিয়েছেন হোয়াইট হাউসের অদূরে।
এদিকে, লস অ্যাঞ্জেলেসের ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া (ইউএসসি) শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ দমনে 'নতুন নিরাপত্তা ব্যবস্থা' নেওয়ার কথা জানিয়েছে। দেশটির কয়েক ডজন ক্যাম্পাস থেকে শত শত শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় বসবাসরত ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে আমেরিকায় শিক্ষার্থীদের এই বিক্ষোভ মার্কিন প্রশাসনের ওপর চাপ তৈরি করছে। শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ থেকে চলে যেতে বাধ্য করতে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। তবে কিছু ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কর্তৃপক্ষের আলোচনা চলছে। কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ বলেছে, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনায় অগ্রগতি হয়েছে। এই আলোচনা অব্যাহত থাকবে।
গত সপ্তাহে নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে প্রথম গাজায় ইসরাইলের যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। পরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বৃহস্পতিবার রাতের মধ্যে শিক্ষার্থীদের অবস্থান কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেওয়ার আহ্বান জানায়। কিন্তু শিক্ষার্থীরা প্রশাসনের নির্দেশনা উপেক্ষা করে সেখানে বিক্ষোভ করেন।
ক্যাম্পাস ত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানানোয় বৃহস্পতিবার আটলান্টার ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২৮ শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ইমোরি পুলিশ বিভাগ বলেছে, বৃহস্পতিবার সকালের দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষোভ স্থানে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যদের প্রথমে ধাওয়া দিয়েছে শিক্ষার্থীরা। পরে সেখান থেকে ২৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাসায়নিকের ব্যবহার করেছে বলে জানিয়েছে। তবে তারা বলেছে, পুলিশ কর্মকর্তাদের লক্ষ্য করে বিভিন্ন ধরনের বস্তু ছোড়ার জবাবে রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়েছে।
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তারা বিক্ষোভে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভস্থল থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য পুলিশকে ডাকার পর সেখানে নতুন করে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির শতাধিক শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তারের পর নতুন করে বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে ক্যাম্পাস।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা 'গণহত্যা থেকে দূরে সরে যাওয়ার' এবং গাজায় ইসরাইলের যুদ্ধের সমর্থনে অস্ত্র উৎপাদনে এবং অন্যান্য শিল্পের সঙ্গে জড়িত সংস্থাগুলোতে বৃহৎ অর্থ বিনিয়োগ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে আসছেন।
আমেরিকার কানেকটিকাটের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষার্থী ও বিক্ষোভের নেতৃত্বদানকারী চিসাতো মিমুরা বলেন, গাজায় গণহত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্র-সরঞ্জাম সরবরাহ ও ইসরাইলে অর্থায়নের ঘটনায় আন্দোলনকারীরা প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও তাদের প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের ওপর ক্ষুব্ধ। তিনি বলেন, 'তারা যা করছে তা সম্পূর্ণরূপে এই গণহত্যার জন্য দায়ী। তারা যে ধরনের সুপরিচিত ভূমিকা পালন করছে, আমরা সেই বিষয়ে অবগত।'
তবে আমেরিকাজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের যে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে, সেগুলোর কিছুতে ইহুদিবিরোধী বিক্ষোভ চলছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ইহুদি শিক্ষার্থী বলেছেন, তারা কলাম্বিয়া ও অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনিরাপদ বোধ করছেন। যদিও গাজায় ইসরাইলের যুদ্ধের বিরুদ্ধে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শুরু হওয়া বিক্ষোভে অনেক ইহুদি শিক্ষার্থীও অংশ নিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার সকালের দিকে মিনিসোটার ডেমোক্রেট দলীয় কংগ্রেসউইমেন ইলহান ওমর ক্যাম্পাস পরিদর্শন করেছেন। এর আগে, গত সপ্তাহে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভে যোগ দেওয়া ইলহান ওমরের মেয়ে ইসরা হিরসিকে ক্যাম্পাস থেকে তাড়িয়ে দেয় পুলিশ। ইলহান ওমর বলেছেন, এই বিক্ষোভ মাত্র ৭০ জন শিক্ষার্থীর মাধ্যমে শুরু হয়েছে। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ দমনের সিদ্ধান্ত নেয়। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের প্রথম অধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে। যে কারণে বিক্ষোভ এখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।'
প্রতিবাদের ঢেউ ইতালিতেও
এদিকে, শুধু আমেরিকা নয়, প্রতিবাদের ঢেউ এখন ইতালিতেও। দেশটির ভিসেঞ্জা শহরের জনগণ ফিলিস্তিনি জনগণের সমর্থনে তাদের শহরের রাস্তার নাম পরিবর্তন করে দিয়েছে। ফিলিস্তিনি জনগণের সংগ্রাম থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এই নামকরণ করা হয়। ইতালির ভিসেঞ্জা শহরে আমেরিকার সামরিক বাহিনীর অন্যতম সদর দপ্তর অবস্থিত। সে কারণে ভিসেঞ্জা শহরের রাস্তাগুলো সাম্প্রতিক দিনগুলোতে ফিলিস্তিনি জনগণের সমর্থনে এবং গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি অপরাধযজ্ঞের নিন্দা জানানোর প্রতীকে পরিণত হয়েছে।
'প্যালেস্টাইন অকুপেশন স্ট্রিট' (ফিলিস্তিন দখল করা বন্ধ করুন), 'ফিলিস্তিনি সেটলার স্ট্রিট' (জায়নবাদী বসতি স্থাপনকারীদের অবশ্যই ফিলিস্তিন ছেড়ে যেতে হবে), 'ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সড়ক', 'ফিলিস্তিনি বর্ণবাদ স্ট্রিট' (ফিলিস্তিনকে বর্ণবাদমুক্ত করতে হবে)- 'অ্যারন বুশনেল সড়ক' (ফিলিস্তিনে আগ্রাসনের প্রতিবাদে আমেরিকার যে পাইলট আত্মহত্যা করেছেন) ইত্যাদি নামে ভিসেঞ্জার শহরের লোকজন তাদের রাস্তার নামকরণ করেছেন।