শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

উত্তেজনার আপাতত অবসান!

যাযাদি ডেস্ক
  ২২ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
উত্তেজনার আপাতত অবসান!

মধ্যপ্রাচ্যে গত কয়েক দিন ধরে ইরান-ইসরাইল উত্তেজনা চলছে। সবচেয়ে বিপজ্জনক এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার আপাতত অবসান হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। গত শুক্রবার (১৯ এপ্রিল) ইরানের ইসফাহান শহরে ড্রোন হামলার মধ্য দিয়ে এমনটি ধারনা করা হচ্ছে। যদিও ইসরাইল এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে এই হামলায় দায় স্বীকার করেনি। অন্যদিকে, ইরানের সামরিক ও রাজনৈতিক নেতারা বিষয়টিকে গুরুত্বহীন, এমনকি এনিয়ে হাস্যরস পর্যন্ত করেছেন।

তবে শুক্রবার সকালে কী ধরনের অস্ত্র মোতায়েন করা হয়েছিল এবং তাতে কতটা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা নিয়ে এখনো অসম্পূর্ণ ও পরস্পরবিরোধী তথ্য আসছে। মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছেন, ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কথা। কিন্তু ইরানের কর্মকর্তারা বলছেন মধ্যাঞ্চলীয় ইসফাহান প্রদেশের এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় তাবরিজে কয়েকটি ছোট ড্রোন বিস্ফোরিত হয়েছে। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবদুলস্নাহিয়ান 'তাসনিম নিউজ এজেন্সি'কে বলেছেন, 'ভূপাতিত করা মাইক্রো এয়ার ভেহিক্যালের কারণে কোনো ক্ষতি বা হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।'

কিন্তু এসব সাধারণ কোয়াডকপ্টার হলো ইসরাইলের এক ধরনের কলিং কার্ড, যা তারা ইরানের অভ্যন্তরে গোপন কার্যক্রম চালাতে কয়েক বছর ধরে ব্যবহার করছিল। এবার তাদের প্রধান লক্ষ্যবস্তু ছিল ইসফাহান, যেখানে দেশটির চমৎকার ইসলামি ঐতিহ্য রয়েছে। তবে এই প্রদেশের বিশেষ পরিচিতি হলো নাতাঞ্জ পারমাণবিক কর্মসূচির জন্য। 'দি ইসফাহান নিউক্লিয়ার টেকনোলজি সেন্টার' এবং একটি বড় ধরনের বিমানঘাঁটি সেখানে আছে, যা গত ১৪ এপ্রিল ইসরাইলে হামলায় ব্যবহৃত হয়েছে। এছাড়া এটি ড্রোন ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির কারখানারও একটি কেন্দ্র। সেখান থেকেই শত শত ক্ষেপণাস্ত্র উড়ে গেছে ইসরাইলের দিকে।

সীমিত হলেও এটি ইরানের দিকে শক্ত বার্তা নিয়ে গেছে যে, ইরানের প্রাণকেন্দ্রে আঘাত করার মতো গোয়েন্দা সামর্থ্য ও সক্ষমতা ইসরাইলের আছে। ইসরাইলের জন্য এই বার্তা দেওয়াটাই জরুরি ছিল এবং তারা সেটিই নিশ্চিত করতে চেয়েছে।

মার্কিন কর্মকর্তারাও ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, নাতাঞ্জকে সুরক্ষা দেওয়া ইরানের 'এয়ার ডিফেন্স রেডার সিস্টেম'র মতো কিছু নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তু ছিল ইসরাইলের। তবে এটা কতটা সফল হয়েছে, তার কোনো নিশ্চয়তা এখনো পাওয়া যায়নি। হতে পারে এই হামলা ছিল একেবারেই সিরিজের প্রথম পর্বের মতো বিষয়। তবে উদ্দেশ্যমূলক না হলেও এটা ছিল ওই সময়ে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুলস্নাহ আলি খামেনির ৮৫তম জন্মদিনের উপহার।

ইসরাইলের কর্মকর্তাদের নীরবতা ইরানকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য একটি রাজনৈতিক সুযোগ দিয়েছে। আবার যখনই শত্রম্ন আক্রমণ চালাবে, তখনই সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি সঙ্গে নিয়েই ইরান পাল্টা শক্ত জবাব দেবে, এই নীতির দিকেও যায়নি ইরান। তারা বরং নিজেদের শক্তির প্রদর্শনকে উপভোগ করেছে।

ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি তার শুক্রবারের বক্তৃতায় এসব সাম্প্রতিক ঘটনার উলেস্নখ করেননি। রোববার গভীর রাতে ইসরাইলে নজিরবিহীন হামলার মাধ্যমে তারা অঙ্গীকার অনুযায়ী অভিযান চালিয়েছে। তিনি তার দেশের ইস্পাত কঠিন অঙ্গীকারের প্রশংসা করেছেন। বিশেষ করে তাৎক্ষণিক প্রতিশোধ বা সরাসরি উত্তেজনার বদলে দীর্ঘমেয়াদী খেলার কৌশলগত ধৈর্যের জন্য ইরান গর্ব করেছে।

এখন তারা 'কৌশলগত প্রতিরোধ'র কথা বলছে। নতুন এই নীতি তারা নিয়েছে দামেস্কে গত ১ এপ্রিল সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের কূটনৈতিক কম্পাউন্ডে হামলার পর। ওই হামলায় কনসু্যলার ভবন ধ্বংস হয়েছে এবং ওই অঞ্চলের একজন সিনিয়র কমান্ডারসহ রেভলিউশনারি গার্ডের সাত জন নিহত হয়েছেন। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা চাপের মুখে ছিলেন। কারণ গাজা যুদ্ধে ইসরাইল গত ছয় মাসে তাদের লক্ষ্য আরও জোরদার করেছিল।

অস্ত্র রাখার গোপন জায়গাগুলো, ভবন, ঘাঁটির মতো তেহরানের নানা স্থাপনা এবং সিরিয়া ও লেবাননের যুদ্ধক্ষেত্রগুলোর সাপস্নাই রুটগুলোতেই হামলা নয়, ইসরাইল ইরানের পদস্থ কয়েকজন কর্মকর্তাকেও হত্যা করেছে। কয়েক দশকব্যাপী শত্রম্নতা, যার জের ধরে আগে দুই দেশের মধ্যে ছায়াযুদ্ধ ও গোপন অভিযান হতো, সেটিই এখন প্রকাশ্য সংঘাতে রূপ নিয়েছে। ইরান ও ইসরায়েলের পারস্পরিক হামলার বিষয়টি তাদের দীর্ঘদিনের ছায়াযুদ্ধ থেকে বের করে এনেছে ও অভ্যন্তরীণ উদ্বেগ বাড়িয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের মিত্ররা বলছে, গাজায় যতদিন ইসরাইল হামলা বন্ধ না করবে, ততদিন তারা পিছু হটবে না। ইরাক, লেবানন, সিরিয়া ও ইয়েমেনে এ লড়াই দীর্ঘতর হবে। ইরান ও ইসরাইলের সাম্প্রতিক এ হামলার অনেকগুলো দিক আছে। কিন্তু এটা পরিষ্কার যে, আঞ্চলিক এ লড়াইয়ে পূর্ণ শক্তি দিয়ে দুই পক্ষই পরস্পরকে আঘাত শুরু করলে তারা অনেক কিছুই হারাবে।

সে কারণেই সবশেষ আঘাত ও পাল্টা আঘাত যে প্রকৃতিরই হোক না কেন, উভয়পক্ষের জন্য আরও কিছু মৌলিক অগ্রাধিকার রয়েছে। যেমন, প্রতিরোধ। একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য যাতে নিজের মাটিতে আর হামলা না হয়। যদি হয়, তাহলে মূল্য দিতে হবে এবং এটা হবে ক্ষতিকর। সে কারণেই আপাতত ওই অঞ্চলে এবং কাছে ও দূরের রাজধানীগুলোতে একটি স্বস্তির নিঃশ্বাস বইছে।

এর আগে গত সপ্তাহে আমেরিকার পক্ষ থেকে জানানো হয়, ইরানে ইসরাইলের পক্ষ থেকে হামলা করা হলে তাতে অংশ নেবে না তারা। এ থেকেই সম্ভাব্য উত্তেজনা অনেকটাই স্তিমিত হয়ে যায়। এর আগে ইসরাইলের দিকে ধেয়ে আসা ৭০টি ড্র্রোন ভূপাতিত করেছিল আমেরিকা। আক্রমণে অংশ না নিলেও ইসরায়েলকে রক্ষার প্রতিশ্রম্নতি দিয়ে আসছে আমেরিকা। শুক্রবারের হামলায় অংশ নিলে তা আমেরিকার জন্য বড় ধরনের পদক্ষেপ হতো। এ অঞ্চলে তাদের মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্কে নববড়ে হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও ছিল।

তেহরান সংযম দেখানোর ক্ষেত্রে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার দিকটিকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। আমেরিকার মিত্র সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক করা ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির পররাষ্ট্রনীতির মূলে রয়েছে। গত বছর চীনের মধ্যস্থতায় তেহরান ও ইরানের মধ্যে দীর্ঘদিন পর সম্পর্কের শীতল বরফ গলতে শুরু করে। আঞ্চলিক অশান্তি তৈরি হলে এই সম্পর্কের ওপর প্রভাব পড়ার ঝুঁকি তৈরি হতো।

তবে এসব বিপদ ইরান ও ইসরাইলের কট্টর ডানপন্থিদের চাপে হারিয়ে যেতে পারে। তারা পরস্পরের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত হামলার বিষয়ে বেশি উৎসাহী। ইসরাইলের ডানপন্থী জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন গাভির গত শুক্রবারের হামলাকে দুর্বল বলে মন্তব্য করেছেন। গত সপ্তাহে তিনি ইসরাইলে যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভায় ইরানের বিরুদ্ধে ব্যাপক হামলার আহ্বান জানান।

তারপরও ইসরাইলের সবশেষ পদক্ষেপ, নিজেদের সহযোগীদের দিক থেকে সীমিত প্রতিশোধের আহ্বান, এখনকার জন্য উত্তেজনা কমিয়ে এনেছে। সবাই সর্বাত্মক যুদ্ধ বন্ধ চায়। কিন্তু এই শান্তি যে স্থায়ী হবে না, এমনটি মনে করছেন তেমন কেউ নেই। কারণ অঞ্চলটিতে এখনো আগুন জ্বলছে। গাজায় যুদ্ধ এখনো চলছে। অসংখ্য ফিলিস্তিনি হতাহতের শিকার হয়েছে। ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের চাপের মুখে ইসরাইল বড় আকারে মানবিক সহায়তার সুযোগ দিতে রাজি হয়েছে। কিন্তু তারপরও বিপর্যস্ত ওই ভূখন্ডটি এখন দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে।

হামাসের হাতে জিম্মিরা এখনো ফিরে আসেননি এবং যুদ্ধবিরতি আলোচনাতেও অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। ইসরাইল হামাসের শক্ত ঘাঁটি রাফাহতে ঢোকার হুমকি দিচ্ছে- যা ত্রাণ সংস্থার প্রধান ও বিশ্ব নেতারা বলছেন আরেকটি মানবিক বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যেতে পারে।

পুরো অঞ্চলে ইরানের 'প্রক্সি নেটওয়ার্ক' আছে যাকে বলা হয় 'এক্সিস অফ রেসিসট্যান্স'। লেবাননের হিজবুলস্নাহ থেকে শুরু করে ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেনের হুতি- সবাই প্রস্তুত। প্রতিদিনই হামলা করছে। গত কয়েক সপ্তাহে অঞ্চলটির গভীর অন্ধকার বিপজ্জনক সময়েও কোনো পরিবর্তন হয়নি। তথ্যসূত্র : বিবিসি নিউজ, সিএনএন

ইরান-ইসরাইল সংঘাত

ইসরাইলের কর্মকর্তাদের নীরবতা ইরানকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য একটি রাজনৈতিক সুযোগ দিয়েছে। আবার যখনই শত্রম্ন আক্রমণ চালাবে, তখনই সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি সঙ্গে নিয়েই ইরান পাল্টা শক্ত জবাব দেবে, এই নীতির দিকেও যায়নি ইরান। তারা বরং নিজেদের শক্তির প্রদর্শনকে উপভোগ করেছে...

ইসরাইলের সবশেষ পদক্ষেপ, নিজেদের সহযোগীদের দিক থেকে সীমিত প্রতিশোধের আহ্বান, এখনকার জন্য উত্তেজনা কমিয়ে এনেছে। সবাই সর্বাত্মক যুদ্ধ বন্ধ চায়। কিন্তু এই শান্তি যে স্থায়ী হবে না, এমনটি মনে করছেন তেমন কেউ নেই। কারণ অঞ্চলটিতে এখনো আগুন জ্বলছে। গাজায় যুদ্ধ এখনো চলছে। অসংখ্য ফিলিস্তিনি হতাহতের শিকার হয়েছে...

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে