ভারত-শাসিত কাশ্মীরের শ্রীনগরের ঐতিহাসিক লালচক এখন গমগম করছে। ক্লক টাওয়ারের সামনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বসার জায়গাগুলোও ভরা। ফুটপাথে ভিড়। মাঝেমধ্যেই কানে আসছে বাংলায় কথাবার্তা। শালের দাম বা খাবার নিয়ে তুমুল আলোচনা করছেন বাঙালি পর্যটকরা। স্কুল থেকে শিক্ষার্থীরা ফিরছে। রাস্তা দিয়ে চলছে গাড়ির স্রোত।
এই উপভোগ্য শীতে শ্রীনগরসহ কাশ্মীর ভরে আছে ভারতের নানা রাজ্যের পর্যটকে। বাঙালি, দক্ষিণ ভারতীয়, পাঞ্জাবি, হিন্দি ভাষীতে ঠাসা। হোটেলের ঘর ভাড়া দ্বিগুণ হয়ে গেছে। তাও শ্রীনগরের অধিকাংশ হোটেলে জায়গা নেই, সব ভর্তি, রেস্তোরাঁও ভর্তি। শ্রীনগরের চারপাশে পাহাড়ের মাথায় বরফ। ডাল লেক একই রকম সুন্দর। সোনমার্গ, পাহেলগাঁম, গুলমার্গ ছুটছেন পর্যটকরা।
কাশ্মিরে এই হামলে পড়া পর্যটকই সরকারের কাছে সাফল্যের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন। বিজেপির সাফল্যের দাবি ঘুরপাক খাচ্ছে এই ছবিটা দেখিয়েই। সহিংসতা যেখানে ছিল ডাল-ভাত, সেখানে এই শান্তি আনার সাফল্যই তারা প্রতিনিয়ত করে যাচ্ছে।
বিজেপির মুখপাত্র আলতাফ ঠাকুর বলেছেন, 'যে কাশ্মীরে পাথর ছোড়া ছিল নিত্যদিনের ঘটনা, যে কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদ, গুলি, হত্যা ছিল প্রতিদিনের জীবনের অঙ্গ, সেই কাশ্মীরের ছবিই বদলে গেছে। সহিংসতা নেই। পর্যটক ভর্তি। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের স্বর আর শোনা যায় না।' তার দাবি, 'বদলে যাওয়া কাশ্মীরে উপত্যকায় এবার পদ্ম ফুটবেই।'
কাশ্মীর আগের তুলনায় শান্ত এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কাশ্মীরে গত বছর দুই কোটির বেশি পর্যটক গেছেন। চলতি বছর সেই রেকর্ডও ভেঙে যাবে, সেই সম্ভাবনাও ষোলোআনা সত্যি। সেইসঙ্গে এটাও সত্যি, শ্রীনগরের গলিতে গলিতে কিছুটা দূরে দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে সশস্ত্র কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরা।
একটু পরে পরেই সাইরেনের তীক্ষ্ন শব্দ তুলে রাস্তা দিয়ে চলে যাচ্ছে পুলিশ বা কেন্দ্রীয় বাহিনীর গাড়ি। কিছুটা দূরে রাখা আছে সিআরপিএফের সাঁজোয়া যান, যার ছোট ছোট গর্ত থেকে বেরিয়ে থাকে বন্দুকের নল।
ভারতের উত্তর-পূর্বঞ্চলীয় অশান্ত মণিপুরে এ রকম গাড়ি কয়েকটা দেখা গিয়েছিল। কাশ্মীরের রাস্তায় একের পর এক এরকম সাঁজোয়া যান ঘুরছে। বাড়ির ছাদে, রাস্তায় একটু পর পর দাঁড়িয়ে আছে বন্দুক হাতে আধাসামরিক বাহিনীর জওয়ানরা। কিছুক্ষণ পরপরই রাস্তার সব গাড়ি থামিয়ে পার করানো হচ্ছে দুই তিনটি বা অনেকগুলো সিআরপিএফের গাড়ি।
সরকারি এক কর্মকর্তা জানান, পুলওয়ামার পর আর কোনো ঝুঁকি নেওয়া হয় না। কোনো গাড়ি যাতে এসে সিআরপিএফের কনভয়ে বা সাঁজোয়া যানে ধাক্কা না মারতে পারে, বিস্ফোরণ ঘটাতে না পারে, তার জন্য এই ব্যবস্থা। জওয়ানরা মাঝেমধ্যে মোটর সাইকেল বা গাড়ি থামিয়ে তলস্নাশি করছে।
এই অতি-সক্রিয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার ফলে শ্রীনগর ও তার আশপাশের কিছু এলাকায় সহিংসতা এখন প্রায় নেই বললেই চলে। ছোটখাট কিছু ঘটনা ঘটলেও তার সংখ্যা আগের তুলনায় নগন্য। কয়েকটি উত্তেজনাপ্রবণ এলাকা আছে। বিশেষ করে যেগুলো পাকিস্তান সীমান্তের কাছে জঙ্গলঘেরা এলাকা। তবে সেখানকার পরিস্থিতিও আগের চেয়ে ভালো। তাই সিপিএমের সাবেক এমপি ও বিধায়ক ইউসুফ তারিগামি, পিডিপির মোহিত বান, ন্যাশনাল কনফারেন্সের ইমরান নবি ডররা স্বীকার করেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের থেকে অনেকটা ভালো হয়েছে। তবে তারা মনে করেন, এর মানে যে শান্তি এসেছে, তা নয়। তারিগামির মতে, 'আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো হয়েছে। কিন্তু শান্তি এসেছে তা বলা যাবে না।'
কাশ্মীরি পন্ডিত সংঘর্ষ সমিতির সভাপতি সঞ্জয় টিক্কুর বাড়ির দেওয়ালে শোভা পাচ্ছে রামকৃষ্ণের ছবি। রাম-সীতার সঙ্গে মহাদেবের ছবিও শোভমান। সাধারণভাবে কাশ্মীরি পন্ডিত বলতে আমবাঙালি তথা ভারতীয়দের ধারণা হলো, তারা হলেন বিজেপির আদি অকৃত্রিম সমর্থক।
কিন্তু অনেক ঝড়ঝাপটা সহ্য করে শ্রীনগরে থেকে যাওয়া টিক্কু বলেন, 'পরিস্থিতি যদি এতটাই ভালো, তাহলে জওয়ানদের সংখ্যা কমিয়ে দেওয়া হোক। তারপর দেখুন অবস্থাটা। অবস্থা যদি এতটাই ভালো হয়, তাহলে পুলিশ কেন আমাদের বলে, ভয়ের কারণ আছে। কয়েকদিন বাড়ি থেকে বেরোবেন না।'
এক সরকারি কর্মকর্তার বক্তব্য, 'সন্ত্রাসবাদ প্রায় শূন্যে নেমে এসেছে। কিন্তু তা একেবারে নির্মূল হয়নি। মাঝেমধ্যে কিছু ঘটনা ঘটছে। অস্ত্র উদ্ধার হচ্ছে। সন্ত্রাসবাদের কাশ্মীর, পাথর ছোড়ার কাশ্মীর আর এখনকার কাশ্মীরের মধ্যে তুলনা চলে না। সেজন্যই এ রকমভাবে পর্যটকরা আসতে পারছেন, নির্ভয়ে ঘুরতে পারছেন।'
আসলে এই বৈপরিত্য নিয়েই কাশ্মীর তার নিজের জায়গায় আছে। এটা নিয়ে লোকসভা ভোটে যাচ্ছে কাশ্মীর। ৩৭০ ধারা বাতিল করার পর প্রথমবার লোকসভা ভোট। ফলে সেই ভোট ঘিরে নানা প্রশ্ন, আশা, আশঙ্কা সবই আছে।
পুলওয়ামায় যেখানে পাঁচ বছর আগে বিস্ফোরণে ৪০ জন সিআরপিএফ জওয়ান মারা গিয়েছিল, তার খুব কাছেই ড্রাই ফ্রুটসের দোকানের মালিক বলেন, 'গত পাঁচ বছরে কাশ্মীরের মানুষ পাঁচ লাখ টাকার বিমার সুযোগ পাচ্ছে। গরিবরা বিনা পয়সায় রেশন পাচ্ছে। কৃষকরা চার মাস পরপর দুই হাজার টাকা করে পান। বয়স্ক পেনশন-সহ তারা সব প্রকল্পের সুবিধা পাচ্ছেন।'
তারপরও তার শুধু একটাই আক্ষেপ, ৩৭০ ধারা বিলোপের পর কাশ্মীরের মানুষের আলাদা পরিচয়টা যেন চলে গেছে। তাই এত কেন্দ্রীয় প্রকল্পের সুবিধা পাওয়ার পর একটা আক্ষেপ তার থেকেই যাচ্ছে। এরপরও প্রতিটি দল, প্রশাসন, সাধারণ মানুষ মনে করছেন এবার প্রচুর ভোট পড়বে। কাশ্মীরের মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। তবে এখনো সাধারণ মানুষ ভোট নিয়ে কথা বলতে চান না। রাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন এলেই তারা চুপ করে যাচ্ছেন। তবে তারা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করেই মত জানাতে চান। তারপরই বোঝা যাবে কে কোথায় দাঁড়িয়ে। তথ্যসূত্র : ডিডাবিস্নউ নিউজ