ইসরাইলের হামলার খবর প্রকাশ হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর ইরানের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেছেন, ইসরাইলের বিরুদ্ধে অবিলম্বে প্রতিশোধ নেওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই। অর্থাৎ, এখনই তারা কোনো প্রতিশোধে যাচ্ছে না। দুই মার্কিন কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেছেন, ইরানের ওপর এই হামলা ইসরাইলের পক্ষ থেকে করা হয়েছে। যদিও ইসরাইল এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে এই হামলার দায় স্বীকার করেনি। তথ্যসূত্র : এএফপি, বিবিসি, আল-জাজিরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই ইরানি কর্মকর্তা বলেন, এই ঘটনাটি যে বিদেশি কোনো উৎস থেকে হয়েছে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। আমরা বাইরে থেকে কোনো আক্রমণের সম্মুখীন হইনি এবং চলমান আলোচনা হামলার চেয়ে অনুপ্রবেশের দিকেই বেশি ঝুঁকছে।' এদিকে, মাত্র এক ঘণ্টা আগে একজন ইরানি বিশ্লেষক দেশটির রাষ্ট্রীয় টিভিকে বলেন, ইসফাহানে বিমান প্রতিরক্ষা দিয়ে যে মিনি ড্রোনগুলোকে গুলি করা হয়েছিল, সেগুলো ইরানের ভেতর থেকেই ওড়ানো হয়েছে। অপরদিকে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা নিশ্চিত করেছে যে, ইরানের পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্র বা স্থাপনাগুলোতে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। জাতিসংঘের এই সংস্থাটির মহাপরিচালক রাফায়েল মারিয়ানো গ্রসি শুক্রবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম 'এক্সে' জোর দিয়ে বলেছেন, পারমাণবিক স্থাপনাগুলো সামরিক সংঘাতের লক্ষ্য হওয়া উচিত নয় এবং তিনি সবাইকে সর্বোচ্চ ধৈর্য ধারণ করার আহ্বান জানিয়েছেন। এর আগে ইরানের আধা-সরকারি বার্তা সংস্থা 'তাসনিম নিউজ'র বরাত দিয়ে তিনি বলেন, ইসফাহানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো 'সম্পূর্ণ নিরাপদ'। ইসরাইলে হামলার ঘটনাকে বেশ ছোট করেই দেখাতে চাইছে ইরান সরকার। যেন এর বিশেষ তাৎপর্য নেই। তারা বলছে, কোনো হামলা হয়নি। ক্ষুদ্রাকৃতি ড্রোনের রম্য ছবি প্রচার করছে রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম। পশ্চিমা দেশগুলো বলছে, ওই অঞ্চলের ভালোর জন্য ইরান এবং ইসরাইলের পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপের ইতি টানা উচিত। এই পাল্টাপাল্টি আক্রমণের শুরুটা হয় দামেস্কে ইরানি কূটনৈতিক স্থাপনায় ইসরাইলের হামলার মধ্য দিয়ে। এমনকি এই পর্যায়ে এসেও যদি ঘটনাপ্রবাহ থেমে যায়, তারপরেও কিন্তু নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েই গেল। ইরান সরাসরি ইসরাইলি ভূখন্ডে হামলা চালিয়েছে, যার জবাবে ইসরাইলও হামলা চালালো। এমন ঘটনা আগে দেখা যায়নি। ওই অঞ্চলে ইরান এবং ইসরাইলের মধ্যে দীর্ঘদিনের সংঘাতে দুই দেশের অভ্যন্তরে সরাসরি হামলা না চালানোটাই যেন 'রুলস অব দ্য গেম' (খেলার নিয়ম) ছিল এতদিন। ফলে দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের ছদ্মবেশী সেই ছায়াযুদ্ধ এখন প্রকাশ্যে চলে এসেছে। হামলার পর ইসরাইলকে হুমকি ইরানের এদিকে, শুক্রবার ড্রোন হামলার পর ইসরাইলকে হুমকি দিয়ে ইরানের সামরিক বাহিনীর এলিট শাখা ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) বলেছে, যদি দেশটির পরমাণু স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্য করে কোনো হামলা চালানো হয় তাহলে তার পরিণতি ভয়াবহ হবে। পারমাণবিক স্থাপনা রক্ষণাবেক্ষণে দায়িত্বপ্রাপ্ত আইআরজিসি টিমের প্রধান জেনারেল আহমেদ হাকতালাব এক বার্তায় বলেন, 'যদি জায়নবাদী শাসকগোষ্ঠী আমাদের পরমাণু স্থাপনা ও কেন্দ্রগুলোতে কোনো প্রকার ক্ষতি সাধনের পদক্ষেপ নেয়, তাহলে নিশ্চিতভাবেই আমরা তার প্রতিক্রিয়া জানাব এবং সেই প্রতিক্রিয়া হবে ভয়াবহ।' ইসরাইল যদি সত্যিই পরমাণু স্থাপনায় হামলা করে, তাহলে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে বলেও ইঙ্গিত দিয়েছেন জেনারেল হাকতালাব। তিনি বলেছেন, 'ইসরাইলের ভুয়া জায়নবাদী গোষ্ঠী যদি ইরানের ওপর চাপ প্রয়োগের জন্য পারমাণবিক স্থাপনা ও প্রকল্প কার্যালয়ে হামলা করে তাহলে ইরানও তার পারমাণবিক ডকট্রিন ও নীতি সংশোধন করবে এবং পূর্বঘোষিত বিবেচনা বিষয়গুলো থেকে সরে আসবে।' উলেস্নখ্য, গত ১ এপ্রিল সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানি দূতাবাসে বোমা হামলা চালিয়েছিল ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)। এতে নিহত হন ১৩ জন। নিহতদের মধ্যে ইরানের সামরিক বাহিনীর এলিট শাখা ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) দুই জ্যেষ্ঠ কমান্ডার মোহাম্মদ রেজা জাহেদি এবং মোহাম্মদ হাদি হাজি রাহিমিও ছিলেন। হামলার দায় এখন পর্যন্ত ইসরাইল স্বীকার করেনি। তবে সাক্ষ্য-প্রমাণ যা পাওয়া গেছে, তাতে হামলাটি যে আইডিএফ করেছিল তা পরিষ্কার। গত সপ্তাহে ইরানের সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক নেতা আয়াতুলস্নাহ আলি খামেনি বলেছিলেন, এই হামলার জন্য ইসরাইলকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। তারপর শনিবার রাত ও রোববার ইসরাইলকে লক্ষ্য করে তিন শতাধিক ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে ইরানের সামরিক বাহিনী। হামলায় হতাহতের কোনো সংবাদ পাওয়া যায়নি। আমেরিকা জর্ডান ও আঞ্চলিক মিত্রদের সহায়তায় বেশিরভাগ ড্রোন-ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানার আগেই ধ্বংস করেছে ইসরাইলি বাহিনী। তবে ইসরাইলের ৯টি স্থাপনায় ইরানি ড্রোন আঘাত হানতে সফল হয়েছে ইরান। আকস্মিক এই হামলার পর ইরানকে পাল্টা জবাব দেওয় হবে বলে ঘোষণা করেছিল ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুও দ্ব্যর্থহীনভাবে আইডিএফের এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানিয়েছেন। তারপর শুক্রবার গ্রিনিচ মান সময় দুপুর সাড়ে ১২টার (বাংলাদেশের স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ৬টা) দিকে ইরানের তৃতীয় বৃহত্তম নগরী ইসফাহানে ড্রোন হামলা চালায় আইডিএফ। তবে হামলায় ব্যবহৃত তিনটি ড্রোনই ধ্বংস করে দিয়েছে ইরানের আকাশ সুরক্ষা ব্যবস্থা। রাজধানী তেহরান থেকে ৩৪০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত ইসফাহানে ইরানি সেনাবাহিনীর বেশ বড় একটি বিমানঘাঁটি ও বেশ কয়েকটি পরমাণু স্থাপনা রয়েছে।