গাজা যুদ্ধ
আমেরিকা-ইসরাইল সম্পর্কের শেষ পরীক্ষা
একসময় ইসরাইলকে শুধু একটি দায় হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কারণ স্নায়ুযুদ্ধের সময় ইসরাইলের সোভিয়েত-ঘেঁষা আরব প্রতিবেশীদের সঙ্গে আঞ্চলিক বিরোধ পারমাণবিক পরাশক্তিগুলোর মধ্যে উত্তেজনা বাড়ার ঝুঁকি তৈরি করেছিল। নব্বইয়ের দশক থেকে পেন্টাগন একে একটি কৌশলগত সম্পদ হিসেবে দেখছে...
প্রকাশ | ০৭ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি ডেস্ক
ওয়াশিংটন ডিসিতে ক্ষমতার পালাবদল চলতে থাকলেও ডেমোক্রেটস ও রিপাবলিকানদের সবসময় একটি ইসু্যতে এক থাকতে দেখা গেছে। আর সেটি হচ্ছে- আমেরিকা-ইসরাইল সম্পর্ক। দুই দলের নেতারা সবসময় এই মনোভাব দেখিয়ে এসেছেন, ইসরাইলের জন্য আমেরিকার চেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র নেই এবং ইসরাইলের নিরাপত্তার বিষয়টি সবসময় আলোচনার ঊর্ধ্বে।
কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্সের হিসাব বলছে, ১৯৪৮ সাল থেকে আমেরিকার কাছ থেকে ইসরাইল প্রায় ৩০০ বিলিয়ন ডলার সহায়তা পেয়েছে, যার বেশিরভাগই সামরিক সহায়তা। এই সংখ্যা মার্কিন সহায়তা পাওয়া দেশের তালিকার দ্বিতীয় স্থানে থাকা মিসরের প্রায় দ্বিগুণ। যদিও মিসরের জনসংখ্যা ১১ কোটি ১০ লাখ, আর ইসরাইলের সাড়ে ৯০ লাখ।
ইসরাইলের একজন সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা চাক ফ্রাইলিশ বলেন, 'এটা একটা অবিশ্বাস্য সম্পর্ক'। বর্তমানে তিনি কলম্বিয়া, নিউইয়র্ক ও তেল আবিবের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন। ফ্রাইলিশ বলেন, 'একই মূল্যবোধ,' কৌশলগত স্বার্থ এবং একটি শক্তিশালী লবি যা ইসরাইলকে ওয়াশিংটনের ভালো অনুগ্রহে রাখে, এই সম্পর্কের 'স্তম্ভ'।
ওয়াশিংটনের সবচেয়ে কার্যকর লবি গ্রম্নপগুলোর মধ্যে একটি 'আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি' বা আইপ্যাক। আমেরিকায় যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, আইপ্যাক সবসময় দুই দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতে লবি করে থাকে।
'একটি কৌশলগত সম্পদ'
ইউরোপে ইহুদিদের রক্ষায় পর্যাপ্ত উদ্যোগ না নেওয়ায় আমেরিকা সমালোচনার শিকার হয়েছিল। তাই ১৯৪৮ সালে ইসরাইল 'স্বাধীনতা' ঘোষণার পর আমেরিকা দ্রম্নতই তাদের স্বীকৃতি দিয়েছিল।
ফ্রাইলিশ বলেন, 'একসময় ইসরাইলকে শুধু একটি দায় হিসেবে বিবেচনা করা হতো'। কারণ স্নায়ুযুদ্ধের সময় ইসরাইলের সোভিয়েত-ঘেঁষা আরব প্রতিবেশীদের সঙ্গে আঞ্চলিক বিরোধ পারমাণবিক পরাশক্তিগুলোর মধ্যে উত্তেজনা বাড়ার ঝুঁকি তৈরি করেছিল। তবে নব্বইয়ের দশক থেকে পেন্টাগন একে একটি কৌশলগত সম্পদ হিসেবে দেখছে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ইসরাইল আমেরিকার জন্য ইরান ও তার প্রক্সিদের মতো কম শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে নিয়ন্ত্রণে রাখার একটি উপায় হয়ে উঠেছে। এই দায়িত্ব 'আমেরিকা-ইসরাইল ইতিহাসে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ কৌশলগত সহযোগিতার' সূত্রপাত করেছে বলে মনে করেন ফ্রাইলিশ।
গত ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামাসের হামলার পর ইসরাইলে অস্ত্র পাঠিয়েছে আমেরিকা, নিরাপত্তা পরিষদে শুরুর দিকে বেশ কয়েকবার যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে। ফ্রাইলিশ বলেন, 'ইসরাইলের দিক থেকে বিবেচনা করলে বাইডেন দারুণভাবে এগিয়ে এসেছেন বলে আমার মনে হয়।'
ইসরাইলকে রক্ষায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে মতবিরোধকে একপাশে সরিয়ে রেখেছেন। ছয় মাসের বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধে গাজায় এখন পর্যন্ত ৩৩ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছেন। ফলে বিশ্বজুড়ে এর নিন্দা জানানো হচ্ছে।
পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও ইসরাইল বিশেষজ্ঞ ইয়ান লাস্টিক মনে করছেন, ইসরাইলকে থামাতে আমেরিকা খুব ধীরে এগোচ্ছে। ফলে নির্বাচনী বছরে বাইডেনের ওপর এর প্রভাব পড়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে বলে জানান তিনি।
ইসরাইল সম্পর্কে আমেরিকায় জনমতের বিকাশ শেষ পর্যন্ত দুই দেশের সম্পর্কের গতিপথ সংশোধন করতে বাধ্য করতে পারে। বিভিন্ন জরিপে বয়স্ক ও তরুণ ভোটারদের জনমতে পার্থক্য দেখা গেছে। বয়স্ক বলতে তারা, যারা ১৯৯৩ সালে স্বাক্ষরিত অসলো চুক্তি দেখেছেন। এই চুক্তির পর অনেকেই দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন। আর তরুণ বলতে তারা, যারা ইসরাইল বলতে সেই দেশকে চেনেন, যারা শুধু ফিলিস্তিনের সঙ্গে রাজনৈতিক মীমাংসা এড়াতে তাদের সামরিক সুবিধাকে ব্যবহার করেন।
এই তরুণদের মধ্যে আমেরিকার ইহুদিরাও আছেন, যারা নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ ও উদারপন্থি হিসেবে দেখেন। সে কারণে তারা সেই ইসরাইল থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন মনে করেন যে, ইসরাইল অন্য পথে যাচ্ছে বলে তারা মনে করেন।
লাস্টিক বলেন, 'দীর্ঘমেয়াদে, তরুণ প্রজন্ম যে মূল্যবোধগুলো গ্রহণ করবে, তা আমেরিকায় দিন দিন আরও শক্তিশালী হবে। তখন মার্কিন রাজনীতিবিদরা মনে করবেন, 'এক মিনিট অপেক্ষা করুন, যদিও ২৫ বছর আগে এটি কাজ করত, আমরা আসলে আইপ্যাকের কথা শোনার চেষ্টা করলে এখন আরও বেশি সমস্যায় পড়ব।' তথ্যসূত্র : ডিডাবিস্নউ নিউজ