নেতানিয়াহু-বিরোধী বিক্ষোভ

ইসরাইলে রাজনৈতিক বিভাজন তুঙ্গে

অনেক ইসরাইলি বিশ্বাস করেন, বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি তার দেশকে নিরাপদ রাখতে পারেন। নেতানিয়াহু ফিলিস্তিনিদের পরিচালনা করতে পারেন, একটি রাষ্ট্রের জন্য ইহুদিদের দখলকৃত জমিতে বসতি স্থাপন করতে পারেন এবং ছাড় না দিয়ে শান্তিচুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় ত্যাগও স্বীকার না করে... হামাসকে ধ্বংস করার ব্যাপারে ইসরাইলিরা বিভক্ত নয়। সেই যুদ্ধের লক্ষ্যে তাদের সমর্থনও রয়েছে। তবে যেভাবে যুদ্ধ পরিচালনা হচ্ছে এবং জিম্মিদের মুক্ত করতে ব্যর্থতা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে বেশ চাপে ফেলেছে...

প্রকাশ | ০৬ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
নেতানিয়াহুর পদতাগের দাবিতে ইসরাইলে বিক্ষোভ
ইসরাইলে গভীর রাজনৈতিক বিভাজন আবারও প্রকাশ্যে রূপ নিয়েছে। গত ৭ অক্টোবর হামাসের সঙ্গে যুদ্ধ শুরুর পর এই বিরোধ কিছু সময়ের জন্য বন্ধ থাকলেও এখন ইসরাইলের রাস্তায় হাজার হাজার বিক্ষোভকারী নেমে এসেছে। ইসরাইলের দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে ক্ষমতাচু্যত করতে বিক্ষোভকারীরা এক ধরনের অনড় অবস্থান নিয়েছে। জেরুজালেমের রাস্তায় বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে দিতে পুলিশকে জল কামান থেকে গুলি ও স্প্রে করতে দেখা গেছে। এ সময় বিক্ষোভকারীরা সরকারবিরোধী বিভিন্ন ধরনের সেস্নাগান দিচ্ছিল। গাজায় বন্দি ১৩৪ জন ফিলিস্তিনিকে মুক্ত করতে চুক্তির করার জন্যও তারা আহ্বান জানায়। যদিও তাদের মধ্যে অজ্ঞাত সংখ্যক এরই মধ্যে মারা গেছে। তাদের বন্ধু ও পরিবারগুলোর আশঙ্কা হচ্ছে, চুক্তি ছাড়া এই যুদ্ধ যত দীর্ঘ হবে, বন্দিরা তত বেশি মারা যাবে। গত রোববার সন্ধ্যায় ইসরাইলি পার্লামেন্টের চারপাশে হাজার হাজার মানুষকে বিক্ষোভ করতে দেখা যায়। যার মধ্যে একজন ছিলেন কাতিয়া অ্যামোরজা। যার ছেলে ইসরাইলি সেনাবাহিনীতে কর্মরত আছেন, এখন যিনি গাজায় 'দায়িত্ব' পালন করছেন। এই বিক্ষোভের সময় তিনি হ্যান্ড মাইক রাখলেন এই বলে, 'আজ সকাল ৮টার পর থেকে আমি এখানে রয়েছি। আমি নেতানিয়াহুকে বলতে চাই, দেশ ছাড়ার জন্য আমি তোমাকে একটি প্রথম শ্রেণির টিকিট দিতে পারলে খুশি হব। তুমি চলে যাও, আর এ দেশে ফিরো না এবং আমি তাকে এটিও বলছি যে, সেই সব লোককে সঙ্গে নিয়ে যান, যাদেরকে আপনি সরকারে বসিয়েছেন। তারা আমাদের সমাজের সবচেয়ে খারাপ মানুষ।' কাতিয়া যখন মাইকে কথাগুলো বলছিলেন, তখন তার পাশ থেকে ইয়েহুদাহ গিস্নক নামের একজন ইসরাইলি ধর্মযাজক যাচ্ছিলেন। যিনি ইসরাইলি টেম্পল মাউন্টে ধর্ম প্রচার করে থাকেন। জেরুজালেমের এই টেম্পল মাউন্টকে মুসলমানদের কাছে পরিচিত আল-আকসা নামে। যেটি ইসলাম ধর্মের তৃতীয় পবিত্র স্থান। ধর্মযাজক তখন বলেন, 'আমি মনে করি, নেতানিয়াহু খুব জনপ্রিয়। এটিই মনে হয় বিক্ষোভকারীদের সবচেয়ে বড় ভয়। আমি মনে করি, এই বিক্ষোভকারীরা এতদিন তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে আসছে, হয়তো নেতানিয়াহু এতদিন ধরে ক্ষমতায় আছে এই সত্যটা তারা মানতে চান না।' বিক্ষোভকারীরা এবং অন্য দেশের যারা নেতানিয়াহুর সমালোচক, তারা মনে করেন, গণতন্ত্রের শত্রম্নরা নেতানিয়াহুর সরকারেই আছে। এর মধ্যে অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিকের ধর্মীয় জায়োনিজম পার্টিও রয়েছে। তাদের দলের একজন এমপি ওহাদ তাল বলেন, 'হামাসের ওপর সামরিক চাপ ছাড়া তারা কখনো বন্দিদের মুক্তি দেবে না। আপনি মনে করেন না যে, হামাস একটি চুক্তিতে এত সহজে জিম্মিদের ফিরিয়ে দেবে, সবাইকে মুক্তি দেবে এটা এত সহজ নয়।' তিনি বলেন, 'আপনার হাতে যদি একটি বোতাম থাকত এবং এটি আপনি টিপ দিলেই সব জিম্মিকে ফিরিয়ে আনা যেত, তাহলে ইসরাইল সেই বোতামই টিপত। জিম্মিদের ফিরিয়ে আনা যত সহজ ভাবা হচ্ছে তত সহজ নয়।' অনেক ইসরাইলি বিশ্বাস করেন, বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি তার দেশকে নিরাপদ রাখতে পারেন। তিনি বলেছিলেন যে, নেতানিয়াহু ফিলিস্তিনিদের পরিচালনা করতে পারেন, একটি রাষ্ট্রের জন্য ইহুদিদের দখলকৃত জমিতে বসতি স্থাপন করতে পারেন এবং ছাড় না দিয়ে এবং শান্তিচুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় ত্যাগও স্বীকার না করে। গত বছরের ৭ অক্টোবরের সীমান্ত থেকে হামাস আক্রমণ করে তখন সব কিছু পরিবর্তন হয়ে যায়। তার নিরাপত্তা প্রধান এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, বিক্ষোভকারীরা ভুল করেছে, নেতানিয়াহু কখনোই কোনো দায় এড়াননি। এই বিজ্ঞপ্তিটি তখন জারি করা হয় যখন, জেরুজালেমের রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভ প্রদর্শন করছিল। ইসরাইলিদের অবশ্যই ৪০ বছর আগের কথা মনে করতে হবে, যখন ইসরাইলি রাজনীতিতে নেতানিয়াহু প্রভাবশালী কেউ ছিলেন না। জাতিসংঘে ইসরাইলের একজন বাকপটু মুখপাত্র হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার মেয়াদ শুরু হয় ১৯৯৬ সালে অসলো শান্তি প্রক্রিয়ার বিরোধিতাকারী পস্ন্যাটফর্মে একটি ছোট বিজয়ের মধ্য দিয়ে। অসলো চুক্তি এই ধারণা তৈরি করেছিল যে, ইসরাইলের পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অনুমতি প্রদান করা হবে। ভূখন্ডের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আরব এবং ইহুদিদের মধ্যে দীর্ঘ বিরোধ নিরসনের একমাত্র আশা ছিল এই চুক্তি। ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বরাবরই বিরোধী ছিলেন নেতানিয়াহু। তিনি মধ্যপ্রাচ্যের পুনর্র্নির্মাণের জন্য একটি 'বড় দর কষাকষির' অংশ হিসেবে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকে সমর্থনের জন্য মার্কিন কৌশলকে অবজ্ঞার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এখন তার সমালোচকরা বলেছেন যে, যুদ্ধের পর গাজায় শাসনের জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের পরিকল্পনার কঠোর প্রত্যাখ্যান ইসরাইলের চরম ডানপন্থিদের অব্যাহত সমর্থন নিশ্চিত করার একটি হাতিয়ার। নেসেটের বাইরে বিক্ষোভকারীদের মধ্যে একজন ছিলেন ইসরাইলি সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডেভিড অ্যাগমন। নেতানিয়াহু যখন প্রথম নির্বাচিত হন, তখন তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক ছিলেন। তিনি বলেন, 'এটি ১৯৪৮ সালের পর একটি বড় সংকট। আমি ১৯৯৬ সালে যখন নেতানিয়াহুর প্রথম চিফ অফ স্টাফ ছিলাম, তখন থেকেই আমি তাকে চিনি। সেখানে তিন মাস পরে আমি চাকরি ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কারণ আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, এই নেতা ইসরাইলের জন্য বিপদ।' বিক্ষোভকারীরা যখন রাস্তায়, তখনো নেতানিয়াহু আগাম নির্বাচনের দাবি প্রত্যাখ্যান করেন। একই সময় তিনি রাফাহতে হামাসের বিরুদ্ধে নতুন করে হামলা চালানোর পরিকল্পনায় ব্যস্ত ছিলেন। হামাসকে ধ্বংস করার ব্যাপারে ইসরাইলিরা বিভক্ত নয়। সেই যুদ্ধের লক্ষ্যে তাদের সমর্থনও রয়েছে। তবে যেভাবে যুদ্ধ পরিচালনা হচ্ছে এবং জিম্মিদের মুক্ত করতে ব্যর্থতা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে বেশ চাপে ফেলেছে। তথ্যসূত্র : বিবিসি নিউজ