জাতিসংঘের গাজা প্রস্তাব
মানা-না মানা নিয়ে এবার বিতর্ক
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলারও সাংবাদিকদের বলেন, 'এটি একটি বাধ্যতামূলক প্রস্তাব নয়।' কিন্তু জাতিসংঘের অন্য কর্মকর্তারা বলছেন উল্টো কথা। জাতিসংঘে চীনের রাষ্ট্রদূত ঝাং জুন বলেন, নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব মানা বাধ্যতামূলক...
প্রকাশ | ৩০ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি ডেস্ক
গত ৭ অক্টোবর ইসরাইলের দক্ষিণাঞ্চলে হামাসের চালানো হামলার পর থেকে গাজায় যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে, তারপর প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ (ইউএনএসসি) উভয় পক্ষের মধ্যে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে সফলভাবে একটি প্রস্তাব পাস করেছে। গত ২৫ মার্চ পাস হওয়া প্রস্তাবটিতে বলা হয়েছে, ইসরাইল ও ফিলিস্তিনি ইসলামপন্থি গোষ্ঠীর মধ্যে যুদ্ধবিরতি 'অবিলম্বে বলবৎ' করা উচিত এবং 'একটা স্থায়ী যুদ্ধবিরতি কার্যকর করে রমজান মাসের প্রতি সব পক্ষেরই শ্রদ্ধা দেখানো উচিত'। এখন এই প্রস্তাবনা মেনে চলা বাধ্যতামূলক কি-না, তা নিয়ে বিভিন্ন দেশের সরকারের মাঝে বিতর্ক রয়েছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ২৭২৮ নং প্রস্তাবে সব জিম্মিকে অবিলম্বে ও নিঃশর্ত মুক্তি এবং গাজায় মানবিক সহায়তা প্রবেশ নিশ্চিত করারও দাবি জানানো হয়েছে।
প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছিল কারা?
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ১৪টি রাষ্ট্র প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে। কেউই প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়নি, শুধু আমেরিকা এবার ভোটদান থেকে বিরত ছিল। যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে আমেরিকা কিন্তু ভেটো দেয়নি, বরং ইসরাইলের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা করেছে। এর আগে নিরাপত্তা পরিষদের তিনটি খসড়া প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছিল আমেরিকা এবং মোট দুইবার ভেটো দেওয়া থেকে বিরত ছিল।
আগে তারা বলেছিল, ওই প্রস্তাবগুলো জিম্মিদের মুক্তির বিষয়টি সুনিশ্চিত করবে না অথবা প্রস্তাবগুলোতে ইসরাইলের দক্ষিণাঞ্চলে হামাসের ৭ অক্টোবরের হামলার বিষয়ে যথাযথ নিন্দা জানানো হয়নি। সর্বশেষ প্রস্তাবটি নিরাপত্তা পরিষদের ১০ অস্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রের পক্ষে মোজাম্বিক উপস্থাপন করে। জাতিসংঘে নিযুক্ত ইসরাইলের দূত গিলাদ এরদান অবশ্য এই প্রস্তাবকে 'লজ্জাজনক' বলে অভিহিত করেছেন।
আমেরিকার অনুপস্থিতিতে ইসরাইলের প্রতিক্রিয়া কী?
গাজায় আগ্রাসনের ব্যাপারে আমেরিকার এমন পদক্ষেপ তাদের ও মিত্র দেশ ইসরাইলের মধ্যে তীব্র উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে। জাতিসংঘে নিযুক্ত ইসরাইলের রাষ্ট্রদূত গিলাদ এরদান বলেন, 'দুঃখজনকভাবে আজও এই পরিষদ ৭ অক্টোবরের গণহত্যার নিন্দা জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, এটি লজ্জার।' তবে তিনি এটি উলেস্নখ করেছেন, প্রস্তাবটি হামাসের দ্বারা ইসরাইলিদের অপহরণের বিষয়টি বিশেষভাবে তুলে ধরেছে।
নিরপরাধ বেসামরিক নাগরিকদের জিম্মি করাকে 'যুদ্ধাপরাধ' বলে উলেস্নখ করে তিনি বলেন, 'এই প্রস্তাবে জিম্মি করার জন্য নিন্দা জানানো হয়েছে, স্মরণ করা হয়েছে যে, এটি আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। জিম্মিদের দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে নিরাপত্তা পরিষদকে শুধু কথা বললে চলবে না, বরং পদক্ষেপ নিতে হবে, সত্যিকারের পদক্ষেপ নিতে হবে।'
এদিকে, ইসরাইলের দুইজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার ওয়াশিংটনে পূর্বনির্ধারিত যে সফর করার কথা ছিল, সেটি বাতিল করে দিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এর আগে আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের মুখপাত্র জন কারবি বলেছিলেন, ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ত ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেক সালিভানের মধ্যে পূর্বনির্ধারিত ওই বৈঠকটি হবে। পরবর্তী সময়ে অবশ্য মঙ্গলবার ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি বিস্নংকেনের সঙ্গে ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্তের বৈঠক হয়।
গত সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে কারবি বলেন, 'আমরা ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে এটা স্পষ্ট করে দিতে চাইব যে, হামাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমেরিকা ইসরাইলের পাশে থাকবে।' তিনি বলেন, প্রস্তাবে আমেরিকার ভেটো না দেওয়ার সিদ্ধান্তের অর্থ এই নয় যে, 'আমাদের (আমেরিকা) নীতিতে পরিবর্তন হয়েছে।' সেই সঙ্গে, তিনি আরও বলেছেন, তার দেশ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়নি, কারণ প্রস্তাবে হামাসের যথাযথ নিন্দা করা হয়নি। 'আমাদের নীতিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। কিছুই না।'
তবে নেতানিয়াহুর কার্যালয় থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, জিম্মি মুক্তির বিনিময়ে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করার যে অবস্থান ছিল আমেরিকার, তারা সেটি পরিত্যাগ করেছে। দুঃখজনকভাবে, যুক্তরাষ্ট্র নতুন প্রস্তাবে ভেটো দেয়নি।
কেন কিছু দেশ আগে ভেটো দিয়েছিল?
গত অক্টোবর মাসে ও সবশেষ গত শুক্রবার আমেরিকার দেওয়া দুটি প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছিল রাশিয়া ও চীন। গত ২২ মার্চ জাতিসংঘে নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত ভ্যাসিলি নেবেনজিয়া বলেন, আমেরিকার আনা প্রস্তাবটিতে 'চরম রাজনীতিকরণ' করা হয়েছে। তিনি বলেন, 'প্রস্তাবটিতে গাজা উপত্যকার দক্ষিণ প্রান্তের রাফাহ শহরে সামরিক অভিযান চালানোর ব্যাপারে ইসরাইলের প্রতি এক প্রকার কার্যকর সম্মতি ছিল। অথচ সেখানকার ২৩ লাখ বাসিন্দার অর্ধেকের বেশি অস্থায়ী তাঁবুতে আশ্রয় নিয়েছে। এটি ইসরাইলকে যা খুশি করার অধিকার দেবে এবং এর ফলে পুরো গাজা ও তার জনগণকে ধ্বংস ও নির্বাসনের মুখোমুখি হতে হবে।'
জাতিসংঘে চীনের রাষ্ট্রদূত ঝাং জুন বলেছিলেন, রাফাহতে ইসরাইলের পরিকল্পিত সামরিক অভিযানের বিরোধিতা করতে ব্যর্থ হয়েছে আমেরিকা। তিনি বলেন, চীন একটি বিকল্প প্রস্তাবকে সমর্থন করে। কিন্তু মার্কিন রাষ্ট্রদূত লিন্ডা টমাস-গ্রিনফিল্ড বলেন, চীন-রাশিয়ার তৈরি খসড়া পরিস্থিতির দাবি মেটাতে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি বলেন, 'বর্তমানে এটি যেভাবে আছে, তা ওই অঞ্চলে সংবেদনশীল কূটনীতিকে সমর্থন করতে ব্যর্থ হয়েছে। আরও খারাপ যেটা... এটি আসলে হামাসকে আলোচনার টেবিলে থাকা চুক্তি থেকে সরে আসার অজুহাত দিতে পারে।'
এই প্রস্তাব মানা বাধ্যতামূলক?
জাতিসংঘ সনদের ২৫ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা বর্তমান সনদ অনুযায়ী নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সম্মত।' জাতিসংঘের ওয়েবসাইটে বলা আছে, 'জাতিসংঘে পাস হওয়া প্রস্তাবগুলোর মধ্যে যেগুলো নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন পেয়ে থাকে, সেগুলো মেনে চলার আইনি বাধ্যবাধ্যকতা রয়েছে।' তবে আমেরিকা ২৭২৮ নম্বর প্রস্তাবকে বাধ্যতামূলক নয় বলে বর্ণনা করেছে। তাদের যুক্তি, ওই প্রস্তাবে 'যুদ্ধবিরতির প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে' কথাগুলোর পরিবর্তে বরং 'যুদ্ধবিরতির অনুরোধ করা হয়েছে' অভিব্যক্তিটি ব্যবহার করা হয়েছে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলারও সাংবাদিকদের বলেন, 'এটি একটি বাধ্যতামূলক প্রস্তাব নয়।' কিন্তু জাতিসংঘের অন্য কর্মকর্তারা বলছেন উল্টো কথা। জাতিসংঘে চীনের রাষ্ট্রদূত ঝাং জুন বলেন, নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব মানা বাধ্যতামূলক।
২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘে যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করা মার্ক লায়াল-গ্রান্ট বিবিসি'র 'ফোর পিএম' প্রোগ্রামে বলেন, 'এই প্রস্তাবনা পাসের অর্থ ইসরাইল এখন মূলত পরবর্তী ১৫ দিনের জন্য সামরিক অভিযান বন্ধ রাখতে একটি বাধ্যবাধকতার অধীন থাকবে।' তিনি যোগ করেছেন, এই প্রস্তাবনাটি আইনত ইসরাইলের জন্য বাধ্যতামূলক, কিন্তু হামাসের জন্য নয়। কারণ ফিলিস্তিনি গ্রম্নপটি একটি রাষ্ট্র নয়।
জাতিসংঘের উপ-মুখপাত্র ফারহান হক বলেন, নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবনাগুলো আন্তর্জাতিক আইন, সুতরাং, এগুলো আন্তর্জাতিক আইনের মতোই বাধ্যতামূলক। জাতিসংঘ সনদের সপ্তম অধ্যায়ের অধীন প্রস্তাবনাটিকে বাধ্যতামূলক করা সম্ভব? সদস্য দেশগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে প্রস্তাব মানতে বাধ্য করার অন্যতম শক্তিশালী হাতিয়ার জাতিসংঘ সনদের সপ্তম অধ্যায়।
২০২৩ সালের অক্টোবরে হাইতিতে আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য বহুজাতিক পুলিশ বাহিনী পাঠাতে এটি ব্যবহার করা হয়েছিল। লেবাননের জন্য বিশেষ ট্রাইবু্যনাল (এসটিএল) গঠনেও অধ্যায় সাতকে ব্যবহার করা হয়েছিল। ২০০৫ সালে লেবাননের সাবেক প্রধানমন্ত্রী রফিক হারিরির হত্যাকান্ড এবং ২০ জনের বেশি লোকের মৃতু্যর জন্য দায়ীদের তদন্ত ও বিচারের সময় এটির ব্যবহার হয়েছিল। ২০০৬ সালে এই সপ্তম অধ্যায়ের অধীনেই ইরানকে অন্য দেশে অস্ত্র সরবরাহ করা থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল এবং এ বিষয়ে দেশটির ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল।
প্যাট্রিক জোহানসনের 'নর্ডিক জার্নাল অফ ইন্টারন্যাশনাল ল'তে প্রকাশিত লেখা অনুযায়ী, নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবনা 'একটি সপ্তম অধ্যায় প্রস্তাবনা' হিসেবে বিবেচিত হতে পারে, যদি 'বিবেচনাধীন পরিস্থিতি মানুষের শান্তির জন্য হুমকি, শান্তি লঙ্ঘন বা আগ্রাসনের মতো ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।'
জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের স্থায়ী পর্যবেক্ষক রিয়াদ মনসুর এই অধ্যায়টি ব্যবহার করানোর জন্য চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেন, 'আমরা নিরাপত্তা পরিষদে এসেছি। এখন তারা বলছেন, এটি বাধ্যতামূলক নয়। সেটা আমরা মানছি না ... নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব বাধ্যতামূলক।' মনসুর বলেন, 'ইসরাইল যদি তা বাস্তবায়ন করতে না পারে, তাহলে নিরাপত্তা পরিষদের দায়িত্ব হচ্ছে অধ্যায় সাতকে ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের পরিষদের প্রস্তাব মেনে চলতে বাধ্য করা ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা।'
ব্রাসেলস-ভিত্তিক থিংকট্যাংক 'ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রম্নপ'র মায়া উঙ্গার বলেন, আমেরিকা এমন একটি আইনি কাঠামোর ওপর নির্ভর করে ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করছে যা হয়তো কেউ কেউ মেনে নিতে পারে। তিনি 'সিএনএন'কে বলেন, আমেরিকা বিশ্বাস করে 'সিদ্ধান্ত' বা সপ্তম অধ্যায়ের 'আহ্বান' শব্দটি ব্যবহার না করলে প্রস্তাবনাটি বাধ্যতামূলক হবে না।
দোহা আলোচনায় প্রভাব ফেলবে প্রস্তাবনা?
গত মঙ্গলবার কাতার বলেছে, দোহায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে চলমান আলোচনায় এই প্রস্তাবের তাৎক্ষণিক কোনো প্রভাব পড়বে না। উপসাগরীয় দেশটি সম্ভাব্য যুদ্ধবিরতি নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে মধ্যস্থতা আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাজেদ আল-আনসারি জানিয়েছেন, 'আমরা আলোচনায় তাৎক্ষণিক কোনো প্রভাব দেখতে পাইনি। জাতিসংঘের এই সিদ্ধান্তের আগে আলোচনা যেভাবে চলছিল, এখনো সেভাবেই চলছে।' যুদ্ধবিরতির দাবিতে জাতিসংঘের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে ইসরাইল কাতার থেকে তাদের আলোচনাকারী দলকে প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর কাতার এই বিবৃতি দিয়েছে। এর আগে ইসরাইলি গণমাধ্যম জানিয়েছিল, সম্ভাব্য যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি মুক্তির বিষয়ে সর্বশেষ প্রস্তাবটি হামাস প্রত্যাখ্যান করায় ইসরাইলের যে প্রতিনিধি দল কাতারে আট দিন ধরে আলোচনা করছিল, তারা দোহা ছেড়েছে। তথ্যসূত্র : বিবিসি নিউজ