মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
সমুদ্র-নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা

সোমালি জলদসু্যরা বেপরোয়া

সাধারণত ছোট স্পিডবোটে করে এসে দড়ি আর মই দিয়ে জাহাজে উঠে জাহাজের নাবিকদের জিম্মি করে ফেলে সোমালি জলদসু্যরা। আর কোনো উপকূলরক্ষী বা পুলিশের শক্তিশালী উপস্থিতি না থাকায় প্রায় বিনাবাধায় সশস্ত্র এই জলদসু্যরা জিম্মি করা জাহাজ সোমালিয়া উপকূলে নোঙর করতে পারে...
যাযাদি ডেস্ক
  ২৪ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
সোমালি জলদসু্যরা বেপরোয়া

প্রায় ছয় বছর পর আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে সোমালিয়ার জলদসু্যরা। এর আগেও অঞ্চলটিতে একের পর এক জাহাজে হামলা করে নাবিকদের জিম্মি ও মুক্তিপণ আদায়ের একাধিক ঘটনা ঘটেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে একজোট হয়ে জলদসু্য-বিরোধী অভিযান চালিয়েছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পক্ষ। ফলে উলেস্নখযোগ্য পরিমাণে কমে যায় জলদসু্যদের আক্রমণ। কিন্তু গত কয়েক মাসে অন্তত ১৪টি জাহাজ ছিনতাইয়ের ঘটনায় 'হর্ন অফ আফ্রিকা' অঞ্চলের সমুদ্র-নিরাপত্তা নিয়ে আবারও শঙ্কা তৈরি হয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, কেন কোনোভাবেই সোমালিয়ার জলদসু্যদের থামানো যাচ্ছে না?

'হর্ন অফ আফ্রিকা'

পূর্ব আফ্রিকার একটি অংশের নাম 'হর্ন অফ আফ্রিকা'। ত্রিকোণাকৃতির ভৌগোলিক মানচিত্রের কারণেই অঞ্চলটিকে এই নামে ডাকা হয়। একে 'সোমালি উপদ্বীপ'ও বলা হয়। সমুদ্রপথে বৈশ্বিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা এটি। আর 'হর্ন অফ আফ্রিকা'র বড় একটি অংশজুড়েই আছে সোমালিয়া। দীর্ঘসময় ধরে চলা দেশটির যুদ্ধবিগ্রহ এবং অর্থনৈতিক দুর্দশা ও সমুদ্র উপকূল রক্ষায় প্রশাসনের শক্তিশালী উপস্থিতি না থাকায় অঞ্চলটিতে নাশকতা বাড়তে থাকে। বিশেষ করে দীর্ঘসময় ধরে জলসীমার নিরাপত্তায় সরকারি বাহিনীর অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে সেখানে বাড়ে বিদেশি মাছ ধরা নৌযানের উপস্থিতি। ফলে ক্ষতির মুখে পড়েন স্থানীয় জেলেরা। সোমালিয়ার সমুদ্র এলাকায় বিদেশিদের এই শোষণ বন্ধে স্থানীয় জেলেরা সশস্ত্র দলে বিভক্ত হয়ে ওই অঞ্চলে বিদেশি জাহাজের প্রবেশ বন্ধের চেষ্টা করেন। কিন্তু বিদেশি জাহাজ জিম্মি করে পাওয়া মুক্তিপণের অর্থ পেয়ে দসু্যবৃত্তির দিকে ঝুঁকে পড়ে অনেক সোমালিয়ান তরুণ।

বেড়েছে আক্রমণের ঘটনা

সোমালিয়া থেকে ইয়েমেন পর্যন্ত এডেন উপসাগরের পথ ধরে বছরে প্রায় ২০ হাজার বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল করে। সুয়েজ খালের এই পথটি এশিয়া থেকে ইউরোপ ও আমেরিকায় যাওয়ার সবচেয়ে দ্রম্নততম পথ। ফলে স্বাভাবিকভাবেই জাহাজ মালিকরা পণ্য পরিবহণে এই পথটিকেই বেছে নেন। কিন্তু তাতে সমস্যা বাঁধায় সোমালি জলদসু্যরা।

'রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউটের' (আরইউএসআই) তথ্যমতে, গত ছয় বছরের যে কোনো সময়ের তুলনায় শেষ তিন মাসে 'হর্ন অফ আফ্রিকা'য় জাহাজ ও নাবিক জিম্মি করে উচ্চ মুক্তিপণ চাওয়ার ঘটনা বেড়েছে। একদিকে সোমালিয়ার দারিদ্র্য, অরাজকতা, আইনের শাসনের অভাব, অন্যদিকে গৃহযুদ্ধের ফলে সৃষ্ট অস্থিতিশীলতা ও সহিংসতার কারণে দেশটির অনেক তরুণই জলদসু্যতার দিকে ঝুঁকে পড়ছে। আর এর সঙ্গে সোমালিয়ার স্থানীয় অভিজাতদের জড়িত থাকারও অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে অন্য গোষ্ঠী বা ইসলামি মিলিশিয়াদের বিরুদ্ধে আঞ্চলিক প্রতিরক্ষা বা আঞ্চলিক নির্বাচনী প্রচারণার জন্য অর্থের প্রয়োজনে তারা এই কাজে উৎসাহ দিয়ে থাকে।

এ ছাড়া পূর্ব আফ্রিকান জলসীমার দেশগুলো নিয়ে গঠিত আঞ্চলিক সংস্থা 'ইন্ডিয়ান ওশান কমিশনের' (আইওসি) মতে, সোমালিয়ায় মাছ ধরার নতুন নীতির কারণে বিদেশি মাছ ধরার জাহাজের প্রবেশ বেড়েছে। আর এর ফলে উপকূলীয় সোমালিরা আবারও জলদসু্যতার দিকে ঝুঁকে পড়ার শঙ্কার কথা জানিয়েছে আইওসি। এ ছাড়া সংস্থাটি অনুমান করছে, ইসলামপন্থি জঙ্গি সোমালিয়া-ভিত্তিক আল-শাবাব গোষ্ঠীর কারণে সোমালিয়ার জলসীমায় জলদসু্যদের আক্রমণের ঘটনা বেড়েছে। তাদের ধারণা, চুক্তির মাধ্যমে আক্রমণকারীদের সুরক্ষা দেওয়ার বিনিময়ে ওই গোষ্ঠী মুক্তিপণ আদায়ের একটি অংশ পায়। এ ছাড়া লোহিত সাগরে হুতিদের আক্রমণের কারণে নৌবাহিনীর বেশিরভাগ নিরাপত্তা ওই অঞ্চলে চলে যাওয়াও একটি বড় কারণ।

'রয়্যাল ডেনিশ ডিফেন্স কলেজের' সহযোগী অধ্যাপক ট্রোয়েলস বুরচাল হেনিংসেন বলেন, নিরাপত্তা ঘাটতির কারণে সোমালিয়া উপকূলে জাহাজ হামলা ছিনতাইকারীদের জন্য সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। জলদসু্যতা বেড়ে যাওয়ায় ২০০৫ থেকে ২০১২ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাহিনী এই জলসীমায় টহল দেওয়া শুরু করে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ইয়েমেনের বিদ্রোহী গোষ্ঠী হুতিদের আক্রমণের কারণে লোহিত সাগরকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। যেসব কারণে অপ্রতিরোধ্য সোমালি জলদসু্যরা

সাধারণত ছোট স্পিডবোটে করে এসে দড়ি আর মই দিয়ে জাহাজে উঠে জাহাজের নাবিকদের জিম্মি করে ফেলে সোমালি জলদসু্যরা। আর কোনো উপকূলরক্ষী বা পুলিশের শক্তিশালী উপস্থিতি না থাকায় প্রায় বিনাবাধায় সশস্ত্র এই জলদসু্যরা জিম্মি করা জাহাজ সোমালিয়া উপকূলে নোঙর করতে পারে।

২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক গণমাধ্যম 'এনবিসি নিউজ'কে এক সাক্ষাৎকার দেন গিলস মেরিট। সে সময় তিনি ব্রাসেলসভিত্তিক থিংকট্যাঙ্ক 'সিকিউরিটি অ্যান্ড ডিফেন্স এজেন্ডা'র পরিচালক ছিলেন। গিলস বলেন, 'এটা আমার কাছে অবিশ্বাস্য লাগে, আমরা এমন এয়ারক্রাফট চালাতে পারি, যা চলমান যে কোনো কিছু চিহ্নিত করতে পারে। কিন্তু স্পষ্টতই আমরা ছোট নৌকার মধ্যে মেশিনগান হাতে কিছু তরুণকে দেখতে পাই না।'

ন্যাটো ও মার্কিন নৌবাহিনী বলছে, তাদের রেডারে জলদসু্যদের টহল ধরা পড়ে এবং তারা জাহাজের ক্রুদের সতর্কও করে। কিন্তু ভারত সাগর থেকে এডেন উপদ্বীপ অঞ্চলটি বিশাল। ফলে যুদ্ধজাহাজ প্রত্যেক নৌযানকে সুরক্ষা দিতে পারে না, আবার সবসময় ঘটনার পর সেখানে সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিতও হওয়া সম্ভব হয় না। আবার জলদসু্যদের কোনো স্পিডবোট দেখা কিংবা এর অবস্থান শনাক্ত করাই যথেষ্ট নয়।

সামরিক কর্মকর্তাদের মতে, সমুদ্রের আড়াই মিলিয়ন বর্গমাইল এলাকা ছিনতাইপ্রবণ, যা পুরোপুরিভাবে টহল দেওয়া কার্যত অসম্ভব। এ ছাড়া জলদসু্যরা বড় আকারের 'মাদার শিপ' ব্যবহার করে। এটি ব্যবহার করেই তারা সমুদ্রের মাঝখানে ছোট নৌযান থেকে আক্রমণ চালায়। সমস্যা হলো এই বড় জাহাজগুলোও মূলত ছিনতাই করা। ফলে এগুলো দেখতে অন্য যে কোনো মাছ ধরার নৌকার মতো। যার কারণে সমুদ্রে চলাচল করা এমন হাজার হাজার নৌকার মধ্যে থেকে দুর্বৃত্তদের জাহাজ খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব। এ ছাড়া জাহাজের নিয়ন্ত্রণ জলদসু্যদের হাতে চলে গেলে যে কোনো পদক্ষেপ নেওয়াও কঠিন হয়ে যায়। কেননা জিম্মি নাবিকদের প্রাণ তাতে ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। আর এই জলদসু্যরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তাদের সঙ্গে থাকে ভারী অস্ত্র আর গ্রেনেড।

কীভাবে কমেছিল জলদসু্যতা?

'মেরিটাইম সিকিউরিটি ফার্ম ড্রায়াড গেস্নাবাল'র তথ্যমতে, হর্ন অফ আফ্রিকা উপকূল থেকে ভারত উপকূল পর্যন্ত শিপিং অঞ্চলটি 'উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ' হিসেবে বিবেচিত। এ অঞ্চলে ২৫টি দেশের নৌবাহিনী রয়েছে, কিন্তু এর বিশাল আকারের তুলনায় এই সংখ্যা নিরাপদ নৌচলাচলের জন্য পর্যাপ্ত নয়।

ছোট নৌকা জাতীয় 'স্কিফ', মই আর সামান্য কিছু অস্ত্র দিয়ে সোমালিয়ার জলদসু্যরা বিশাল মালবাহী জাহাজ ছিনতাই করে। একই সঙ্গে জাহাজের ক্রুদের জিম্মি করে আদায় করে মিলিয়ন ডলার মুক্তিপণও।

২০০৫ থেকে ২০১২ পর্যন্ত সময়কালে হর্ন অফ আফ্রিকার দসু্যরা কী পরিমাণ অর্থ আদায় করেছে, তার একটি আনুমানিক হিসাব করেছে বিশ্বব্যাংক। সেই হিসাব অনুযায়ী, জলদসু্যরা ক্রুদের জিম্মি করে সাড়ে তিনশ থেকে সোয়া চারশ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ আদায় করেছে। ২০১৩ সালের বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, জলদসু্যতার কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে বছরে প্রায় ১৮ বিলিয়ন ডলার বা এক হাজার ৮০০ কোটি টাকা খরচ হয়।

'ইউনাইটেড নেশনস সিকিউরিটি কাউন্সিল' (ইউএনএসসি) সোমালি জলদসু্যদের থামাতে সাতটি রেজু্যলেশন পাস করে, যেখানে বিদেশি বিমান ও নৌবাহিনীকে সোমালি জলসীমায় প্রবেশ ও টহলের অনুমতি দেওয়া হয়। একই সঙ্গে 'সমুদ্রে জলদসু্যতা এবং সশস্ত্র ডাকাতি দমনে প্রয়োজনীয় পদ্ধতি' ব্যবহার করে ইউএস-নেতৃত্বাধীন টাস্ক ফোর্স ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌ-অপারেশন আটলান্টাকে অনুমোদন দেওয়া হয়। ২০১১ সালে সর্বোচ্চ ২১২টি হামলার পর সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সোমালিয়া উপকূলে জলদসু্যর আক্রমণ প্রায় বন্ধ ছিল। আর তা করতে নেওয়া হয়েছিল সামষ্টিক পদক্ষেপ।

অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক অলাভজনক গণমাধ্যম নেটওয়ার্ক 'দ্য কনভার্সেশন'-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সে সময় জলদসু্যদের থামানোর চারটি কারণ উলেস্নখ করা হয়েছে। এগুলো হলো- ১. জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি স্থায়ী সদস্যসহ বিশ্বের সবচেয়ে সক্ষম নৌবাহিনীর দ্বারা জলদসু্য-বিরোধী বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা ও সমন্বয়। ২. ব্যয়বহুল আত্ম-সুরক্ষা ব্যবস্থার বাস্তবায়ন। ৩. জলদসু্যদের বিচার ও কারাদন্ড প্রদানে আইনি ব্যবস্থার উন্নয়ন। ৪. আঞ্চলিক সক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে জলদসু্যদের বন্দি করা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, জলদসু্যদের থামাতে এই সাফল্যের বড় একটি অংশই ছিল ভূমিতে। সোমালিয়ায় আল-শাবাব সন্ত্রাসীদের হঠাতে স্থলভাগে আফ্রিকান ইউনিয়নের সামরিক বাহিনীসহ একযোগে মার্কিন বিমান হামলার মতো আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টার কারণেই জলদসু্যতা হ্রাস পায়।

সোমালিয়ায় আফ্রিকান ইউনিয়ন মিশনের অংশ হিসেবে ২০১২ সালে কেনিয়ার সেনারা কিসমায়ো বন্দর দখল করে এবং আল-শাবাব যোদ্ধাদের তাড়া করে। এ সময় যে ঘাঁটি থেকে জলদসু্যরা সব কাজ পরিচালনা করত সেটিও সরিয়ে দেওয়া হয়। একই সঙ্গে, কিছু রক্ষণশীল সোমালি গোষ্ঠীও জলদসু্যদের নেটওয়ার্কের প্রতি ক্ষেপে গিয়েছিল।

ঐতিহ্য বা ধর্মের ওপর নির্ভর না করে বরং অস্ত্র আর ডাকাতির ওপর নির্ভর করে হঠাৎ করেই একটি দলের আধিপত্য অন্যরা মেনে নিতে পারেনি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই দসু্যরা ক্ষমতা হারাতে শুরু করে। তবে ছয় বছর পর নতুন করে বাড়ছে জলদসু্যতার ঘটনা।

জলদসু্যতা এবং সশস্ত্র ডাকাতি নিয়ে 'আইসিসি ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম বু্যরো'র (আইএমবি) বার্ষিক এক প্রতিবেদন অনুসারে ২০২৩ সালে ১২০টি জলদসু্যতা এবং সশস্ত্র ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল ১১৫। তথ্যসূত্র : বিবিসি নিউজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে