বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
ভারতে লোক ও বিধানসভা

এক দেশ এক নির্বাচন নিয়ে টানাপড়েন

ভারতের সংবিধানে লোকসভা, রাজ্যসভা এবং রাজ্যগুলোর বিধানসভার পৃথক মর্যাদা রয়েছে। কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারগুলোর অধিকার এবং দায়িত্বও নির্দিষ্ট করে উলেস্নখ করা আছে। এক সঙ্গে সারাদেশে ভোট হলে, সেই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ওপরই আঘাত আসবে বলে মনে করছে বিরোধী দলগুলো... পুরো প্রস্তাবটাই তো যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিরোধী। একবার না হয় লোকসভা আর রাজ্য বিধানসভাগুলোর ভোট একসঙ্গে হলো। কিন্তু এরপর তো কোনো রাজ্য সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারাতে পারে, তখন কী হবে? পরবর্তী নির্বাচন পাঁচ বছর পর হবে, এই যুক্তিতে বিধানসভা জিইয়ে রেখে দিয়ে কি রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা হবে? আবার যদি কেন্দ্রীয় সরকার কখনো সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়, এ রকম তো একাধিক উদাহরণ আছে গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে, তখন তাহলে কি নির্বাচন করার জন্য অপেক্ষা করে থাকতে হবে? কেন্দ্রে তো আর রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা যাবে না, সেই সুযোগ তো ভারতের সংবিধানে নেই...
যাযাদি ডেস্ক
  ১৭ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর হাতে রিপোর্ট তুলে দেন সাবেক রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ

ভারতের লোকসভা এবং রাজ্য বিধানসভাগুলোর নির্বাচন একই সঙ্গে করার যে প্রস্তাব জমা পড়েছে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর কাছে, এতে বিজেপি লাভবান হবে বলে মনে করছে অন্য রাজনৈতিক দলগুলো এবং বিশ্লেষকদের একাংশ। 'এক দেশ এক নির্বাচন' দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোর ওপর আঘাত হানবে বলেও মনে করছে কংগ্রেস ও তৃণমূল কংগ্রেস। একই সঙ্গে সারাদেশে নির্বাচন করা যায় কিনা, তা খতিয়ে দেখতে সাবেক রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের নেতৃত্বে একটি কমিটি গড়ে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার। সেই কমিটি নতুন ওই ব্যবস্থা ২০২৯ সাল থেকে কার্যকর করার পক্ষে মত দিয়ে প্রায় ১৮ হাজার পাতার একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে রাষ্ট্রপতির কাছে।

সেখানে লোকসভা ও রাজ্য বিধানসভাগুলোর নির্বাচন যেমন এক সঙ্গে করার পক্ষে মত দেওয়া হয়েছে, তেমনই সেই নির্বাচনের ১০০ দিনের মধ্যে পৌরসভা ও পঞ্চায়েতের মতো স্থানীয় নির্বাচনও সেরে ফেলা যেতে পারে বলে মত দেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবে অবশ্য ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচন নয়, ২০২৯ সাল থেকে সারাদেশে এক সঙ্গে ভোট করার কথা ভাবা হয়েছে।

সাবেক রাষ্ট্রপতি কোবিন্দ ছাড়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া কাশ্মীরি নেতা গুলাম নবি আজাদ, অর্থ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান এনকে সিং এবং সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী হরিশ সালভে ওই কমিটির সদস্য ছিলেন।

সারাদেশে এক সঙ্গে ভোট করাতে গেলে যে সংবিধানে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ সংশোধন করাতে হবে, সে কথাও বলেছে কোবিন্দের নেতৃত্বাধীন কমিটি। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা ছাড়াও ওই কমিটি ভারতের চারজন সাবেক প্রধান বিচারপতি, হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি, সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার, বার কাউন্সিল এবং জাতীয় স্তরের বাণিজ্য সংগঠনগুলোর সঙ্গেও কথা বলেছে।

বিজেপির লাভ?

তবে একাধিক বিশ্লেষক ও অন্যান্য দলগুলো মনে করছে, এই ব্যবস্থা চালু হলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে বিজেপি। 'সেন্টার ফর স্টাডি অফ সোসাইটি অ্যান্ড পলিটিক্স'র জাতীয় সমন্বয়ক অধ্যাপক সঞ্জয় কুমার বলেন, 'এটা একটা স্বাভাবিক প্রবণতা যে, দুটি ভোট একসঙ্গে হলে একই দলের প্রার্থীকেই বেছে নেয় মানুষ। সে ক্ষেত্রে কেন্দ্রে আর রাজ্যে একই দলের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।'

একই মত সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এস ওয়াই কুরেশিরও। একটি সমীক্ষার কথা উলেস্নখ করে কুরেশি সংবাদ সংস্থা 'বস্নুমবার্গ'কে বলেছেন, সব নির্বাচন একসঙ্গে অনুষ্ঠিত হলে ৭৭ শতাংশ মানুষ একই দলকে ভোট দেবে।

অন্যতম বড় বিরোধী দল তৃণমূল কংগ্রেসের এমপি সুখেন্দু শেখর রায়ের ব্যাখ্যা, "সারা দেশের বিভিন্ন রাজ্য বিধানসভাগুলোর ফল থেকে বিজেপি বুঝে গেছে, তাদের যে 'ডাবল ইঞ্জিন' সরকারের ধারণা, সেটা বাস্তবায়িত করা যাচ্ছে না। তারা একাধিপত্য চায়। চীন আর রাশিয়ার মতো বিজেপির কর্তৃত্ববাদ যুগ যুগ ধরে যাতে থেকে যায়, সেই ব্যবস্থাই করতে চাইছে তারা।"

কারা পক্ষে, বিপক্ষে?

যদিও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং বিজেপি সারাদেশে একসঙ্গে ভোট করানোর পক্ষে সওয়াল করে এসেছে, তবে বিজেপি বলছে, এটা শুধু যে তাদের দলের বক্তব্য তা নয়। ভারতের ৬৭টি রাজনৈতিক দলকে তাদের মতামত দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল রামনাথ কোবিন্দ কমিটি। এর মধ্যে ৪৭টি দল জবাব দিয়েছিল।

একসঙ্গে সারাদেশের ভোট করানোর পক্ষে মত দিয়েছে ৩২টি দল, যার মধ্যে আছে বিজেপি-সহ এনডিএ জোটের প্রায় সব দলগুলোই। অন্যদিকে, কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস-সহ ১৫টি দল এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে। জাতীয় পর্যায়ের স্বীকৃত দলগুলোর মধ্যে ছয়টি দল তাদের মতামত ব্যক্ত করেছিল, যার মধ্যে মাত্র দুটি, বিজেপি ও ন্যাশনাল পিপল্‌স পার্টি সমর্থন করেছে একসঙ্গে সব ভোট করার ভাবনাটি। কংগ্রেস, আম আদমি পার্টি (আপ), সিপিআইএম ও বহুজন সমাজ পার্টি প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে। রাজ্যভিত্তিক দলগুলোর মধ্যে এক দেশ এক ভোটের পক্ষে আর বিপক্ষে সমসংখ্যক দল রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিরোধী?

ভারতের সংবিধানে লোকসভা, রাজ্যসভা এবং রাজ্যগুলোর বিধানসভার পৃথক মর্যাদা রয়েছে। কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারগুলোর অধিকার এবং দায়িত্বও নির্দিষ্ট করে উলেস্নখ করা আছে। একসঙ্গে সারাদেশে ভোট হলে সেই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ওপরই আঘাত আসবে বলে মনে করছে বিরোধী দলগুলো।

কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক জয়রাম রমেশ সংবাদ সংস্থা 'পিটিআই'কে বলেছেন, "প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার। তিনি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে চান, দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতা, ৪০০ আসন পাওয়াই তার লক্ষ্য। এবার ঝুলি থেকে বেড়াল বেরিয়ে পড়েছে। ওরা বাবাসাহেব আম্বেদকরের সংবিধান ধ্বংস করতে চায় একটাই লক্ষ্য নিয়ে, 'ওয়ান নেশন, নো ইলেকশন', অর্থাৎ দেশে কোনো নির্বাচনই হবে না।"

তৃণমূল কংগ্রেসের এমপি সুখেন্দু শেখর রায় বলেন, "পুরো প্রস্তাবটাই তো যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিরোধী। একবার না হয় লোকসভা আর রাজ্য বিধানসভাগুলোর ভোট একসঙ্গে হলো। কিন্তু এরপর তো কোনো রাজ্য সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারাতে পারে, তখন কী হবে? পরবর্তী নির্বাচন পাঁচ বছর পর হবে, এই যুক্তিতে বিধানসভা জিইয়ে রেখে দিয়ে কি রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা হবে? আবার যদি কেন্দ্রীয় সরকার কখনো সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়, এ রকম তো একাধিক উদাহরণ আছে গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে, তখন তাহলে কি নির্বাচন করার জন্য অপেক্ষা করে থাকতে হবে? কেন্দ্রে তো আর রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা যাবে না, সেই সুযোগ তো ভারতের সংবিধানে নেই।"

বিজেপি অবশ্য বলছে, বিরোধী দলগুলো তাদের মতামত দিতেই পারে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সেটাই স্বাভাবিক, কিন্তু এ ক্ষেত্রে তাদের রাজনৈতিক আক্রমণ করা হচ্ছে। বিজেপির এমপি শমীক ভট্টাচার্য বলেন, 'বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রে সুষ্ঠু নির্বাচন হোক, আরও বেশি মানুষ ভোটে অংশ নিন, সেই উদ্দেশ্যেই এই ভাবনা এসেছে। কিন্তু যেভাবে রাজনৈতিক আক্রমণ করা হচ্ছে বিষয়টা নিয়ে, সেটা অনুচিত। গণতন্ত্রে বিরোধী স্বর তো থাকবেই, তবে এই ইসু্যতে শুধুই বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করা হচ্ছে।"

তার কথায়, 'একসঙ্গে লোকসভা আর রাজ্য বিধানসভার নির্বাচনের তো অনেক উদাহরণ আছে। যেমন এবারই লোকসভার ভোটের সঙ্গেই ওড়িশাসহ একাধিক রাজ্যে বিধানসভার ভোটও হবে। আবার ১৯৫২ সালের প্রথম লোকসভা নির্বাচনের সময় থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত রাজ্যগুলোতেও একসঙ্গেই ভোট হতো।'

ভোটের খরচ কমবে?

শমীক ভট্টাচার্য আরও বলেন, 'শুধু যে আমরা একসঙ্গে ভোট করানোর কথা বলছি, তা নয়। দেশের বহু বিজ্ঞ মানুষ এই কথা বলে এসেছেন। আমাদের মতো একটি দেশে, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো আছে, বহু বৈপরীত্য আছে দেশে, সেখানে যদি বারবার নির্বাচন হয়, সেটা অর্থনীতির ওপর একটা বাড়তি চাপ তৈরি করে। আবার প্রশাসনের ওপরও প্রবল চাপ তৈরি হয়।'

ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতির রামনাথ কোবিন্দের নেতৃত্বাধীন কমিটিও একসঙ্গে ভোট করার স্বপক্ষে নির্বাচনী খরচ কমানো এবং সরকারি কর্মচারীদের ভোটের কাজে বার বার ব্যবহার করা, আদর্শ আচরণবিধি চালু হওয়ার ফলে বার বার উন্নয়নমূলক কাজ বাধাপ্রাপ্ত হওয়া এবং প্রশাসনিক কাজ ব্যাহত হওয়ার যুক্তি দিয়েছে।

তবে 'সেন্টার ফর স্টাডি অফ সোসাইটি অ্যান্ড পলিটিক্স'র সমন্বয়ক অধ্যাপক সঞ্জয় কুমার বলেন, খরচ কমানোর যে যুক্তি দেওয়া হচ্ছে, সেটা খুব একটা গ্রহণযোগ্য নয়। গত লোকসভা নির্বাচনে খরচ হয়েছিল প্রায় ৯৩ হাজার কোটি রুপি। চলতি বছরের ভোটে খরচ হবে প্রায় এক লাখ কোটি রুপি। ভোটারপিছু খরচ কিন্তু খুব একটা বাড়ে বা কমেনি। গত নির্বাচনের হিসাবে একজন ভোটারপিছু গড়ে প্রতিমাসে খরচ হয়েছিল ৩০০ রুপি করে আর চলতি বছরের ভোটে সেই খরচ দাঁড়াবে মাসে সাড়ে তিনশো টাকা মতো। খুব কি খরচ বেড়েছে পাঁচ বছরে? গত বছরের চেয়ে ভোটারও তো বেড়েছে অনেক।' তথ্যসূত্র : বিবিসি নিউজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে