আঞ্চলিক বিভিন্ন দেশ ও সংস্থাকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করার জন্য আমেরিকাকে যখন ধ্বংসাত্মক ও অনর্থক বিমান হামলা চালাতে দেখা যায়, তখন এটি স্পষ্ট হয়ে যায়, দেশটির কাছে এখনো তেলের গুরুত্ব মোটেও কমে যায়নি; বরং মার্কিন সরকার মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে ধ্বংস করতে তার যুদ্ধ ও বাণিজ্যের মেশিন একসঙ্গে চালু রেখেছে।
এই মুহূর্তে মধ্যপ্রাচ্যের একাধিক দেশে আমেরিকাকে বিমান হামলা চালাতে দেখা যাচ্ছে। আমেরিকার সর্বশেষ বিমান হামলার বিষয়ে আগেই ধারণা করা যাচ্ছিল (এবং তা ছিল অনর্থক)। এই হামলার লক্ষ্য ছিল কারা? লক্ষ্য ছিল মধ্যপ্রাচ্যের সেইসব গোষ্ঠী, যাদের তৎপরতায় আমেরিকা নাখোশ! আমেরিকা তাদের এমন শিক্ষা দিতে চায়, যাতে তারা আর মার্কিন লেজে পা না রাখে। ওয়াশিংটনের হিসাবটি এ রকম- 'তোমরা আমাদের তিন সেনাকে হত্যা করেছ? তাহলে আমরা তোমাদের শত শত, এমনকি হাজার হাজার লোককে হত্যা করব। এসব লোক সামরিক নাকি বেসামরিক, সেটি বিবেচ্য বিষয় নয়। হত্যা করে যাব, যেহেতু হত্যা করার সামর্থ্য ও শক্তি আমার আছে!'
বিমান শক্তি থাকার কারণে মার্কিন নেতারা বহুবার এই শক্তি প্রয়োগ করে নিছক মানুষ হত্যা করার বাসনা পূরণ করেছেন। তারা আন্তর্জাতিক আইন, সম্ভাব্য মানবিক পরিস্থিতি কিংবা যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের কথা এক মুহূর্তের জন্যও চিন্তা করতে রাজি নন। তারা সহিংস উপায়ে লক্ষ্যপূরণ করতে চান বলেই বোমাবর্ষণ করে যান।
এই বোমাবর্ষণের আরেকটি উদ্দেশ্য হলো, মার্কিন সমরাস্ত্র নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে চাঙ্গা রাখা। যুদ্ধ না থাকলে এসব প্রতিষ্ঠানের গেটে তালা ঝুলিয়ে দিতে হবে! তবে মার্কিন সমরবিদরা যেখানে ভুল করেন, সেখান থেকে শিক্ষা নেন না। তারা হাজার হাজার কিলোমিটার দূর থেকে মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে বোমাবর্ষণ করেন আমেরিকার শক্তিমত্তা প্রদর্শন করার জন্য। কিন্তু বাস্তবে এতে তাদের দুর্বলতাই প্রকাশ পায়। ওই অঞ্চলে তারা পরাজিত হন, পরাজিত হন এবং কেবল পরাজিতই হন। তারপরও আরও বেশি বিমান হামলা বা আরও বেশি ড্রোন হামলা বন্ধ করার নির্দেশ জারি করতে তারা রাজি নন।
একথা বললে অতু্যক্তি হবে না, আমেরিকার মতো এত বিপুল পরিমাণ বোমা ও যুদ্ধবিমান বিশ্বের আর কোনো দেশে তৈরি হয় না! সেইসঙ্গে যুদ্ধ ও গণহত্যা চালিয়ে 'শান্তি' প্রতিষ্ঠার কৌশলেও অন্য কোনো দেশ আমেরিকার সমান পারদর্শী নয়!
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং এর পরবর্তী যুদ্ধগুলো বিশ্লেষণ করলে আমেরিকার রণনীতিকে একটি বাক্যে লেখা যাবে, আর তাহলো- 'গণহারে মানুষ হত্যা করার জন্য গণহারে অস্ত্র উৎপাদন করা'। গণহত্যা চালানোর কাজে বিশ্বের আর কোনো দেশ আমেরিকার মতো বিপুল অর্থ ও বিমান বাহিনীকে ব্যবহার করেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি ও জাপানে আমেরিকার বোমাবর্ষণের দিকে তাকালেই এ কথাটি স্পষ্ট হয়ে উঠবে। জাপানে আমেরিকার সর্বশেষ দুই বোমাবর্ষণ ছিল হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে। এছাড়া ১৯৫০-এর দশকে দুই কোরিয়ার যুদ্ধে উত্তর কোরিয়াকে ধ্বংস করা কিংবা ১৯৬০ ও ৭০-এর দশকে ভিয়েতনাম, লাওস ও কম্বোডিয়ায় আমেরিকার ভয়াবহ বোমা হামলার কথাও ভুলে গেলে চলবে না। ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে একবার ও ২০০৩ সালে দ্বিতীয়বার ইরাকে মার্কিন হামলা এবং ২০০১ সালে আফগানিস্তানে মার্কিন আগ্রাসনের কথাও ইতিহাস মনে রাখবে চিরকাল।
যখন আমেরিকার এসব অপরাধযজ্ঞ নিয়ে কথা বলা হচ্ছে, তখন আরেকটি কথিত দেশ আমেরিকাকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে হুবহু একই নীতি অনুসরণ করে যাচ্ছে। জায়নবাদী ইসরাইল গাজা উপত্যকাকে পদ্ধতিগতভাবে ধ্বংস করে দিচ্ছে। দখলদার সেনাদের বোমাবর্ষণ থেকে যেসব ফিলিস্তিনি প্রাণে বেঁচে যাচ্ছেন, তারা যাতে আর কোনো দিন এই উপত্যকায় বসবাস করতে না পারেন, সে রকম একটি ব্যবস্থা পাকাপাক্ত করার চেষ্টা করছে ইসরাইল। লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হচ্ছে, গাজা যুদ্ধের শুরুর দিকে ইসরাইলি নেতারা ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর ভয়াবহ বিমান হামলা শুরু করার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির ড্রেসডেন শহরে মিত্র বাহিনীর বোমাবর্ষণের কথা উলেস্নখ করেছিলেন।
ফিলিস্তিনে ইসরাইলের ভয়াবহ আগ্রাসন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকা ও তার ব্রিটিশ মিত্র মিলে জার্মানির বড় শহরগুলোকে একের পর এক বসবাস অযোগ্য করে দিয়েছিল। ওয়াশিংটন ও লন্ডনের যুক্তি ছিল, জার্মানির সব নাগরিক তাদের নাৎসিবাদী সরকারের সমর্থক বলে তাদের সবাইকে হত্যা করা বৈধ। ইসরাইল সরকারও আজ গাজা উপত্যকায় একই নীতি অনুসরণ করছে। তেলআবিব দাবি করছে, গাজা উপত্যকার সব ফিলিস্তিনি হামাসের সদস্য, কাজেই তাদের প্রত্যেককে হত্যা করা 'জায়েজ'। আর এটি হচ্ছে গণহত্যা চালানোর ইসরাইলীয় (ও আমেরিকান) অপকৌশল। আমেরিকা যেমন যে কোনো বর্বরোচিত হামলাকে 'গণতন্ত্র রক্ষা' করার অজুহাত হিসেবে তুলে ধরে, তেমনি ইসরাইল প্রতিটি হামলা চালিয়ে দাবি করে- তার আত্মরক্ষার স্বার্থে এটি প্রয়োজন ছিল। কাজেই আমেরিকা যে বিমান ও জাহাজ ভরে ভরে ইসরাইলকে সমরাস্ত্র দিয়ে যাচ্ছে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ ইসরাইলও ব্যাপকভাবে গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে 'শান্তি' প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
১১ সেপ্টেম্বরের হামলা এবং এর প্রতিক্রিয়ায় আফগানিস্তান ও ইরাকে ব্যাপকভাবে মার্কিন বোমাবর্ষণের পর ২২ বছর পেরিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও এখনো মধ্যপ্রাচ্যে অন্তত ৩০ হাজার সেনা মোতায়েন করে রেখেছে আমেরিকা। কুয়েত ও বাহরাইন থেকে শুরু করে কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত পর্যন্ত দেশগুলোতে এসব মার্কিন সেনা মোতায়েন রয়েছে। সেইসঙ্গে প্রায় সব সময়ই পারস্য উপসাগরে এক বা একাধিক মার্কিন রণতরী নিজের উপস্থিতি বজায় রাখছে। সিরিয়া থেকে উগ্র জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস নির্মূল হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও দেশটির একাংশ দখল করে সেখানে এখন প্রায় ৯০০ মেরিন সেনা মোতায়েন করে রেখেছে ওয়াশিংটন। ঘটনাক্রমে ওই এলাকায় রয়েছে সিরিয়ার সবচেয়ে বড় তেলের খনি। আর ইরাকে মোতায়েন রয়েছে দুই হাজার ৫০০ মার্কিন সেনা। উলেস্নখ্য, ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনে প্রায় ১০ লাখ মানুষ নিহত এবং আরও লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচু্যত হয়।
অন্যদিকে সামরিক সহায়তার আকারে আমেরিকার বিধ্বংসী সব সমরাস্ত্র শুধু ইসরাইলেই যাচ্ছে না, সেইসঙ্গে মিসর ও জর্ডানের শাসকদের কাছেও যাচ্ছে। আমেরিকার সরাসরি অস্ত্র সহায়তা পেয়েই সৌদি আরব প্রায় এক দশক ধরে ইয়েমেনের বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পেরেছে, যদিও সেই যুদ্ধে রিয়াদ জয়ী হতে পারেনি। সৌদি আরবের সেই অভিজ্ঞতা থেকেও শিক্ষা নেয়নি আমেরিকা। এই মুহূর্তে দারিদ্র্য পীড়িত এই আরব দেশটির বিরুদ্ধে একের পর এক বিমান হামলা চালাচ্ছে মার্কিন বাহিনী। অবশ্য আমেরিকার চাপে গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে গোটা অঞ্চলজুড়ে চলছে কথিত 'সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ' যা যথাসম্ভব বেশি সংখ্যায় মানুষ হত্যা ও নির্যাতনের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।
ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের মধ্যযুগের ক্রুসেড যুদ্ধগুলো যেমন পুরোপুরি ধর্মযুদ্ধ ছিল না, তেমনি বর্তমানেও দৃশ্যত, আমেরিকার শত্রম্নতা শুধুমাত্র মুসলমানদের বিরুদ্ধে নয়। এখনকার যুদ্ধগুলোর মূলে রয়েছে মার্কিন শাসকদের লোভ, প্রতিশোধ পরায়ণতা ও অস্ত্র নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সন্তুষ্টি অর্জন করা।
অবশ্য ১১ সেপ্টেম্বরের পরবর্তী বছরগুলোর জন্য যে কথাটি প্রযোজ্য ছিল এবং এখনো অনেকাংশে আছে, তা হলো- মার্কিনিরা এত ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যা চালাচ্ছে নিছক 'আত্মরক্ষা করার' জন্য। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাবিস্নউ বুশ এক সময় বলেছিলেন, আমেরিকা নিছক তার 'অবাধ স্বাধীনতার' জন্য বিশ্বব্যাপী এতটা নিন্দিত ও ঘৃণিত। আমেরিকার সংবিধান কিংবা মানবাধিকার ঘোষণায় 'স্বাধীনতা' সম্পর্কে যা বলা আছে, সেটিই স্বাধীনতা নয়। আমেরিকার স্বাধীনতার অর্থ হলো- বিশ্বের নানা প্রান্তে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করে যখন-তখন যেখানে খুশি সেখানে বোমাবর্ষণ করার নামই স্বাধীনতা। তথ্যসূত্র : পার্স টুডে