দিলিস্ন দাঙ্গা
বিচার পাওয়ার লড়াই আক্রান্তদের
এই দাঙ্গায় বহু মানুষের জীবন শেষ হয়ে গেছে। বছরের পর বছর কেটে যাচ্ছে, কিন্তু নিহতদের পরিবারের ন্যায়বিচারের লড়াই শেষ হচ্ছে না। কীভাবে দাঙ্গা উসকে দেওয়া হয়েছিল এবং কারা তাদের প্ররোচনা দিয়েছিল? দাঙ্গা, তার তদন্তে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ওঠা সওয়াল এবং সেই অভিযোগের বিষয়ে পুলিশ কী পদক্ষেপ নিয়েছে- এমন একাধিক প্রশ্ন রয়েছে। এগুলোর উত্তর এখনও মেলেনি...
প্রকাশ | ০৪ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি ডেস্ক
ভারতের দিলিস্নর উত্তর-পূর্ব অংশে ২০২০ সালে দাঙ্গা হয়েছিল। চার বছর আগে ২৩ ফেব্রম্নয়ারি থেকে ২৬ ফেব্রম্নয়ারি পর্যন্ত চলা ওই দাঙ্গায় মৃতু্য হয়েছিল ৫৩ জনের। চারদিন ধরে চলা দাঙ্গায় জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। অনেকের বাড়িঘর ও দোকানে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। দিলিস্ন পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী নিহতদের ৪০ জন মুসলিম এবং ১৩ জন হিন্দু। ওই দাঙ্গার শিকার এবং তাদের পরিবারের ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই কিন্তু আজও চলছে।
'পুলিশ বলল বয়ান বদলে দাও'
উত্তর-পূর্ব দিলিস্নর কর্দমপুরী এলাকা। দাঙ্গার সময় এই এলাকা থেকে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়ে যায়। ভিডিওতে পুলিশের উর্দি পরা কয়েকজনকে পাঁচটি ছেলেকে লাঠিপেটা করতে দেখা গিয়েছিল। ওই পাঁচজনকে 'জনগণমন অধিনায়াক' এবং 'বন্দে মাতরম' গাইতে বলছিল তারা। ইন্টারনেটে ওই ভিডিও আজও রয়েছে।
দিলিস্ন দাঙ্গার এটি অন্যতম প্রধান মামলা, যেখানে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে ফয়জানও ছিলেন। ২০২০ সালের ২৬ ফেব্রম্নয়ারি তার মৃতু্য হয়। কর্দমপুরীর বাড়িতে ফয়জানের মা কিস্মতুন ছিলেন। বাড়ির পরিস্থিতি দেখিয়ে তিনি জানান, ফয়জানের রোজগারে সংসার চলত। কীভাবে ফয়জানের মৃতু্য হয়েছিল এবং সেই মামলা কতদূর পৌঁছেছে, এ প্রশ্নের উত্তরে কিস্মতুন বলেন, 'চার বছর হয়ে গেল। এখন পর্যন্ত কিছুই হয়নি। ঘটনার আকস্মিকতায় আমার স্বাস্থ্যের অবনতি হয়। একদিন পুলিশ এসে বলল, বয়ান বদলে দাও।' কিস্মতুন জানিয়েছেন, ঘটনার পর পুলিশ ফয়জানকে প্রথমে হাসপাতালে নিয়ে যায় এবং পরে এক রাত তাকে জ্যোতিনগর থানায় রাখা হয়। পরদিন তাকে ছেলেকে নিয়ে যেতে বলে পুলিশ। ফয়জনের মৃতু্য হয় ২৬ ফেব্রম্নয়ারি। কিন্তু আদালতে পুলিশের দেওয়া নথি অনুযায়ী, 'ফয়জানের সঙ্গে কোনো দুর্ব্যবহার করা হয়নি, স্বেচ্ছায় তিনি থানায় ছিলেন।'
চার বছর পেরিয়ে গেলেও এই মামলায় পুলিশি তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। ছেলেকে ন্যায়বিচার না পেতে দেখে ২০২০ সালে দিলিস্ন হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন কিস্মতুন। এখন তিনি একটাই জিনিস চান, দোষীদের শাস্তি হোক।
আইনজীবী বৃন্দা গ্রোভার দিলিস্ন হাইকোর্টে ওই মামলা লড়ছেন। তিনি বলেন, এই মামলায় গ্রেপ্তার তো দূরের কথা, পুলিশ কর্মকর্তাদের শনাক্তও করা হয়নি।
দিলিস্ন পুলিশের মনোভাব কী?
বৃন্দা গ্রোভার বলেন, 'ভারতে পুলিশের মনোভাব এমন যে, তারা সন্দেহের ভিত্তিতে কাউকে গ্রেপ্তার করে এবং আদালতে পেশ করে বলে হেফাজতে (রিমান্ড) নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করাটা ভীষণ প্রয়োজনীয়। কিন্তু এই মামলায় সবকিছু খুব ঢিলেঢালা। প্রত্যেকবার আদালতের সামনে নতুন গল্প তুলে ধরা হয়।' তিনি আরও বলেন, 'সমস্যা হলো, এখানে একটি সাধারণ দরিদ্র অংশের মুসলিম ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে এবং পুলিশকে তার তদন্ত করতে হবে। সেদিন কারা ডিউটিতে ছিলেন, সেসব কাগজপত্র পুলিশের কাছে আছে। আপনি তাদের (পুলিশের) কাছে যাচাই করে দেখতে পারেন। আমরা বিশ্বাস করি, এভাবে তদন্ত চলতে থাকলে আগামী ছয় বছরও এই তদন্ত চলতে থাকবে। এজন্য বিশেষ তদন্তকারী টিম গঠন করা দরকার।' সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী থানায় সিসিটিভি ক্যামেরা থাকা বাধ্যতামূলক। তবে আইনজীবী বৃন্দা গ্রোভার বলেন, পুলিশ জানিয়েছে, ওই সময় থানায় সিসিটিভি কাজ করছিল না।
ফয়জানের বাড়ি থেকে একটু দূরে কাউসার আলির বাড়ি। ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে যাদের মার খেতে দেখা গিয়েছিল তাদের মধ্যে একজনের নাম কাউসার আলি। তিনি জানিয়েছেন, সেদিনের কথা ভাবলে আজও শরীরে কাঁটা দেয়। কাউসার বলেন, 'সেদিনের ঘটনার পর আমি এখনো পুলিশকে ভয় পাই। মনে হয় যেন ওরা আমাকে আবার তুলে নিয়ে যাবে। আমি দোষীদের শাস্তি চাই।'
আসলে ওই ভিডিওতে যারা মারধর করছিলেন ফয়জন, কাউসার আলি-সহ বাকিদের, তারা পুলিশের লোক। উল্টো দিলিস্ন পুলিশ হাইকোর্টে শুনানির সময় জানিয়েছিল, ভিডিওতে যাদের দেখা গেছে তাদের শনাক্ত করার চেষ্টা করছে।
এ মামলায় আদালতে আক্রান্ত পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষ হয়েছে। এখন পুলিশকে তাদের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করতে হবে। এ বিষয়ে তদন্ত কতটা এগিয়েছে, তা জানতে দিলিস্ন পুলিশের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হলে আইপিএস অফিসার রাজেশ দেও, যিনি দিলিস্ন দাঙ্গার তদন্তে গঠিত এসআইটির প্রধান ছিলেন, মামলাটি আদালতে রয়েছে বলে কথা বলতে অস্বীকার করেন। দাঙ্গা নিয়ে দিলিস্ন পুলিশের পরিসংখ্যান কী বলছে, গুরুত্বপূর্ণ।
পুলিশের পরিসংখ্যান
দিলিস্ন পুলিশ সূত্র থেকে যা জানা গেছে, দাঙ্গার সঙ্গে সম্পর্কিত মোট ৭৫৮টি এফআইআর দায়ের করেছে পুলিশ। এ পর্যন্ত মোট ২ হাজার ৬১৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যার মধ্যে ২০৯৪ জন জামিনে রয়েছেন। আদালত এখন পর্যন্ত মাত্র ৪৭ জনকে দোষী সাব্যস্ত করেছে এবং ১৮৩ জনকে খালাস করেছে। একই সঙ্গে ৭৫ জনের বিরুদ্ধে প্রমাণ না পাওয়ায় তাদের মামলা বাতিল করেছে আদালত। নিউজ ওয়েবসাইট 'দ্য প্রিন্ট'-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, দিলিস্ন দাঙ্গায় নিহতদের মৃতু্য সংক্রান্ত ৫৩টি মামলার মধ্যে ১৪টি মামলা এখনো তদন্তাধীন।
সিসিটিভি ভেঙেছিল যে 'পুলিশকর্মীরা'
অন্য একটি ঘটনায়, উত্তর-পূর্ব দিলিস্নর খুরেজিতে সিএএ প্রতিবাদস্থলের কাছে পুলিশের পোশাক পরা একদল লোককে সিসিটিভি ক্যামেরা ভাঙতে দেখা গেছে। এ ভিডিওটিও বেশ ভাইরাল হয়েছিল। এ ঘটনায় অভিযুক্ত পুলিশ কর্মীদের বিরুদ্ধে কি কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? এই প্রশ্নে দিলিস্ন দাঙ্গায় আক্রান্ত পক্ষের আইনজীবী মেহমুদ প্রাচা বলছেন, 'দিলিস্ন পুলিশের নাম রয়েছে, এমন মামলাতেও তাদের (অভিযুক্ত পুলিশকর্মী) বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।'
রতন লাল-অঙ্কিত শর্মা মামলায় যা ঘটেছিল
তবে সব মামলাতেই যে দিলিস্ন পুলিশি তদন্ত ধীরগতিতে চলছে, তেমনটা নয়। দিলিস্ন দাঙ্গায় কর্তব্যরত অবস্থায় নিহত হেড কনস্টেবল রতন লালের মামলায় দিলিস্ন পুলিশ এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ২৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে, যার মধ্যে ১০ জন জামিনে মুক্তি পেয়েছে। মিডিয়া রিপোর্ট অনুযায়ী, গত বছর রতন লাল মামলায় অভিযুক্ত দুই ব্যক্তিকে মণিপুর ও বেঙ্গালুরু থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এই মামলায় পুলিশ পাঁচটি চার্জশিট দাখিল করেছে। কিন্তু এক্ষেত্রেও বিচার শুরু হয়নি।
একই সঙ্গে ইন্টেলিজেন্স বু্যরোর কর্মী অঙ্কিত শর্মা খুনের ঘটনায় বর্তমানে ১১ জন অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ২০২০ সালের ২৬ ফেব্রম্নয়ারি চাঁদবাগের একটি নর্দমা থেকে অঙ্কিত শর্মার মরদেহ উদ্ধার হয়। চার্জশিট অনুযায়ী তার শরীরে ৫১টি আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। মিডিয়া রিপোর্ট অনুযায়ী এ মামলার এক অভিযুক্তকে ২০২২ সালের অক্টোবরে তেলেঙ্গানা থেকে গ্রেপ্তার করেছিল দিলিস্ন পুলিশ। গত বছরের মার্চে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হয়েছিল এবং এখন আদালতে সাক্ষীদের বয়ান শোনা হচ্ছে।
উমর খালিদ এবং এফআইআর নং ৫৯
দিলিস্ন পুলিশের 'স্পেশাল সেল অ্যান্ড ক্রাইম ব্র্যাঞ্চ' বলছে দিলিস্ন দাঙ্গার পেছনে গভীর ষড়যন্ত্র ছিল। এর সূত্রপাত হয়েছিল ২০১৯ সালে সিএএ এবং এনআরসির বিরুদ্ধে বিক্ষোভের সময়। এই ষড়যন্ত্রের বিষয়টি উলেস্নখ করা হয়েছে এফআইআর নম্বর ৫৯/২০২০-তে, যার তদন্ত করছে ক্রাইম ব্র্যাঞ্চের স্পেশাল সেল।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় সরকার নাগরিকত্ব আইনে একটি সংশোধন পাস করে। বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে আসা ছয়টি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের (হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি, খ্রিষ্টান ও শিখ) মানুষদের নাগরিকত্ব দেওয়ার বিধান রয়েছে ওই সংশোধিত আইনে। এর বিরুদ্ধে ভারতজুড়ে বিক্ষোভ হয়েছে। আদালত বলছে, এখন পর্যন্ত ৫৯ নম্বর এফআইআর-এ ১৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ছয়জন বর্তমানে জামিনে রয়েছেন। এই মামলার বিচার এখনো শুরু হয়নি।
এই দাঙ্গায় বহু মানুষের জীবন শেষ হয়ে গেছে। বছরের পর বছর কেটে যাচ্ছে, কিন্তু নিহতদের পরিবারের ন্যায়বিচারের লড়াই শেষ হচ্ছে না। কীভাবে দাঙ্গা উসকে দেওয়া হয়েছিল এবং কারা তাদের প্ররোচনা দিয়েছিল? দাঙ্গা, তার তদন্তে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ওঠা সওয়াল এবং সেই অভিযোগের বিষয়ে পুলিশ কী পদক্ষেপ নিয়েছে- এমন একাধিক প্রশ্ন রয়েছে। এগুলোর উত্তর এখনো মেলেনি। তথ্যসূত্র : বিবিসি নিউজ