ভারতে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনকে 'পাখির চোখ' করে দেশের সব রাজনৈতিক দলই আপাতত জোর দিচ্ছে তাদের আগামী কর্মসূচির ওপর। এরই মধ্যে দেশটির সাধারণ নির্বাচনের ঠিক আগেই আবার এক দফা কৃষক আন্দোলনের জেরে উত্তাল হয়ে উঠেছে ভারত। পাঞ্জাব ও হরিয়ানা রাজ্যের মধ্যে শম্ভু সীমান্ত-সহ রাজধানী দিলিস্নর প্রান্তে টিকরি বা সিঙ্ঘু সীমানা ১৩ ফেব্রম্নয়ারি থেকে বারবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে কৃষকদের ডাকা 'দিলিস্ন চলো' অভিযানের জেরে।
তীব্র প্রতিরোধের মুখেও পিছু হঠতে রাজি হচ্ছেন না ভারতের এই আন্দোলনকারী কৃষকরা। কংক্রিট ও লোহার ব্যারিকেড, জলকামান, ড্রোন ব্যবহার করে ছোড়া কাঁদানে গ্যাসের শেল- কোনো কিছুই যে তাদের প্রতিহত করতে পারবে না, সে বিষয়টা তারা স্পষ্ট করে ঘোষণাও করেছেন। আন্দোলনকারীদের বাধা দিতে গিয়ে বারবার পুলিশের সঙ্গে কৃষকদের সংঘর্ষ বেধেছে। প্রশাসনের কড়া দমন নীতির বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি, সরব হয়েছে বিরোধীরাও।
আসন্ন ভোটের আগে কৃষকদের ডাকা এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশের কৃষকদের দুটি বড় সংগঠন 'সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা' এবং 'কিষাণ মজদুর মোর্চা'। এদের আওতায় পাঞ্জাব, হরিয়ানা আর উত্তরপ্রদেশের সাড়ে তিনশ' ছোট-বড় কৃষক সংগঠন রয়েছে। দেশটির বিভিন্ন কৃষক ও মজদুর সংগঠনও তাদের সমর্থন জানিয়েছে এই আন্দোলনে।
এই আন্দোলনের মূল দাবি হলো- নূ্যনতম সহায়ক মূল্যের আইনি নিশ্চয়তা (এমএসপি), কৃষিঋণ মওকুফ এবং স্বামীনাথন কমিশনের সব সুপারিশ বাস্তবায়ন, পুলিশ মামলা প্রত্যাহার এবং লখিমপুর খেরি সহিংসতার শিকারদের জন্য ন্যায়বিচারের জন্য আইনি গ্যারান্টি ইত্যাদি।
এসব দাবিদাওয়া নিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে আন্দোলনকারী কৃষক সংগঠনের নেতাদের। কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী অর্জুন মুন্ডা বারবার জোর দিয়ে বলেছেন, সরকার শান্তিপূর্ণভাবে আলাপ-আলোচনা চায়। এরই মধ্যে ১৮ ফেব্রম্নয়ারি রাতে চতুর্থ দফা বৈঠক সারেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা। তাদের পক্ষ থেকে কৃষক সংগঠনের নেতাদের কাছে চুক্তি প্রস্তাবও রাখা হয়েছে। তবে কোনো রফা সূত্র পাওয়া যায়নি।
ভারতে একটানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসার জন্য বিজেপি সরকার যখন সচেষ্ট, সেই পরিস্থিতিতে এই আন্দোলন কি তাদের সমস্যায় ফেলছে? রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং অধ্যাপক শুভময় মৈত্র মনে করেন, এ আন্দোলন নরেন্দ্র মোদি সরকারের সমস্যার কারণ হয়ে উঠতে পারে। তার কথায়, 'যেহেতু দিলিস্ন-কেন্দ্রিক আন্দোলন ও দিলিস্নকে ঘিরে রাখা হচ্ছে, বড়-বড় রাস্তা আটকানো হচ্ছে এবং এর প্রভাব পড়ছে দিলিস্নর ওপর, তাই এটা বিজেপির কাছে একটা সমস্যা হয়ে যাচ্ছে। সে কারণে তারা এ আন্দোলনকে গুরুত্ব দিতে বাধ্য হচ্ছে। নইলে বিজেপির কাছে এই আন্দোলন দমন করা খুব শক্ত হতো না।' তিনি বলেন, 'আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগে এই আন্দোলন বিজেপির কাছে একটা বিশাল বড় সমস্যা হবে না, তবে এটা যে কাঁটার মতো গলায় খচখচ করবে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।'
চতুর্থ দফা বৈঠক
আলাপ-আলোচনা করতে তারা যে প্রস্তুত, সে কথা একাধিকবার জানিয়েছে সরকার। আন্দোলন থামাতে প্রতিবাদী সংগঠনগুলোর সঙ্গে ১৮ ফেব্রম্নয়ারি রাতে বৈঠকেও বসেছিলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা। দীর্ঘক্ষণ সেই বৈঠক চলার পর আন্দোলনের ষষ্ঠ দিনের মাথায় 'দিলিস্ন চলো' অভিযান আগামী ২১ ফেব্রম্নয়ারি পর্যন্ত স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারতের কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব। তবে তারা এটাও জানিয়েছে, তাদের দাবিদাওয়া না মানা হলে বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোটের এমপিদের বাড়ির সামনে বিক্ষোভ দেখানো হবে, একই সঙ্গে আরও জোরদার হবে আন্দোলন।
চন্ডিগড়ে এই চতুর্থ দফা বৈঠকে বসেন কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী অর্জুন মুন্ডা, কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই প্রমুখ। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পীযূষ গোয়েল জানিয়েছেন, ওই বৈঠকে কৃষকদের কাছে একটি চুক্তির প্রস্তাব রাখা হয়েছে। বলা হয়েছে- সরকারি সংস্থাগুলো তাদের কাছ থেকে পাঁচ বছরের জন্য নূ্যনতম সমর্থন মূল্যে ডাল, ভুট্টা ও তুলা কিনবে। গোয়েল বলেন, 'ন্যাশনাল কো-অপারেটিভ কনজিউমারস ফেডারেশন এবং ন্যাশনাল অ্যাগ্রিকালচারাল কো-অপারেটিভ মার্কেটিং ফেডারেশন অফ ইনডিয়া'র মতো সমবায় সমিতিগুলো অড়হর, কলাই, মসুর ডাল বা ভুট্টা চাষকারী কৃষকদের সঙ্গে চুক্তি করবে এবং তারপর আগামী পাঁচ বছরের জন্য বিক্রি করবে। এমএসপিতে ফসল কেনা হবে।' তিনি আরও জানিয়েছেন, কটন করপোরেশনের মাধ্যমে পাঁচ বছরের জন্য এমএসপিতে কৃষকদের কাছ থেকে তুলা কেনা হবে। ক্রয়ের পরিমাণের কোনো ঊর্ধ্বসীমা থাকবে না।
অন্যদিকে, এই চার দফা বৈঠকে বারবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের মুখে ১০ বছরে কৃষকদের কল্যাণের কথা ভেবে তৈরি প্রকল্প এবং পদক্ষেপের কথা শোনা গেছে। যা থেকে বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করছেন, ভোটের আগে নিজেদের 'কৃষকদরদি' বলে প্রমাণ করতে চাইছে মোদি সরকার।
আন্দোলনের টাইমিং
আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের আবহে এ আন্দোলনের টাইমিং যে বেশ উলেস্নখযোগ্য, সে কথা জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, 'হ্যাটট্রিক' করে কেন্দ্রে ক্ষমতায় যেতে যখন বদ্ধপরিকর বিজেপি এবং বিরোধী শিবিরও তাদের প্রতিহত করতে মরিয়া, ঠিক সেই সময়টা নিজেদের দাবি-দাওয়া মানিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন কৃষকরা। অর্থনীতিবিদ ড. সুনেত্রা ঘটক বলেন, 'আন্দোলনকারীদের বেশিরভাগই পাঞ্জাবের। তাদের দাবিদাওয়ার মধ্যে নূ্যনতম সহায়ক মূল্য, ঋণ মওকুফসহ একাধিক বিষয় রয়েছে। নির্বাচনের আবহে এ বিষয়টাকে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখতে হবে। ভোটের আগে আমরা দেখে থাকি বিভিন্ন পক্ষকে চাপ সৃষ্টি করে তাদের দাবি-দাওয়া মানানোর জন্য চাপ দিতে। আমার পর্যবেক্ষণ, শুধু নূ্যনতম সহায়ক মূল্য নিশ্চিত করতে আইন নয়, তারা অর্থনৈতিক স্থিরতা চায় এবং আয় বৃদ্ধি ও সুনিশ্চিত করতে চায়। নূ্যনতম সহায়ক মূল্যের আওতায় থাকা ২৩টি শস্যপণ্যের কথাই শুধু যদি ভাবি, তাহলে বাকি অংশের কী হবে? এবং শুধু এমএসপির কথা ভাবলে কৃষকদের সামগ্রিক উন্নতি হবে না, শুধু সে কথা ভাবলে স্বল্পমেয়াদি একটা ব্যবস্থা হবে।'
এদিকে, কৃষিঋণ মওকুফ, ১০০ দিনের কাজের সুরক্ষা, নূ্যনতম মজুরি এবং অন্যান্য দাবি-দাওয়া মেনে নিলে রাজকোষের ওপর চাপ বাড়বে সে কথাও বলেছেন অনেকে। ওপি জিন্দল গেস্নাবাল ইউনিভার্সিটির অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর সুনেত্রা ঘটকের কথায়, 'পেনশন, ঋণ মওকুফ, নূ্যনতম মজুরির মতো স্কিমগুলো সরকারের নির্ধারিত বাজেটের বাইরে। ভোটের আগে আন্দোলন থামানোর জন্য এই দাবিদাওয়াগুলো মেনে নেবে, সে পরিস্থিতিও কিন্তু সরকারের নেই, কারণ এতে সরকারের কোষাগারে চাপ পড়বে।'
অস্বস্তিতে বিজেপি সরকার?
নিজেদের দাবিদাওয়া কেন্দ্র সরকারের কাছে পৌঁছতে কৃষকদের আন্দোলন কিন্তু নতুন নয়। এর আগেও বহুবার বিভিন্ন সময় আন্দোলন করেছে কৃষক সংগঠনগুলো। ২০২০ সালের আগস্ট মাস থেকে ২০২১-এর ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়েছিল কৃষক সংগঠনগুলো। তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে দিলিস্নর প্রান্তে সিঙ্ঘু, গাজীপুর এবং টিকরি সীমানায় এক বছরের বেশি সময় ধরে আন্দোলন করেছিল তারা। প্রবল চাপের মুখে সেই বিতর্কিত কৃষি আইনগুলো প্রত্যাহার করে নেয় সরকার। সে সময় আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, ফসলের নূ্যনতম সহায়ক মূল্য বা এমএসপির আইনি গ্যারান্টির দাবিটি খতিয়ে দেখবে সরকার।
অধ্যাপক শুভময় মৈত্র বলেন, আগেরবার কৃষক আন্দোলনের বিষয়টিকে অনেকদূর টেনে নিয়ে গিয়েছিল বিজেপি। এবং শেষমেশ তারা হার মেনেছিল, যেটা একটা রাষ্ট্রবাদী দলের পক্ষে ভালো নয়। এক্ষেত্রে তাদের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছিল। এ আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, 'একটা উলেস্নখযোগ্য বিষয় হলো, মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা, পাঞ্জাবে যে কৃষক আন্দোলন হচ্ছে, সেটা কিন্তু সম্পন্ন চাষিদের। এরা আন্দোলনের মাধ্যমে নানা সরকারি সাহায্য চাইছেন। এটা তারা আগেও চেয়েছেন, এখনো চাইছেন। বিজেপি একটি পুঁজিবাদী এবং বিলগ্নীকরণের পক্ষে থাকা দল। পুঁজিবাদী তত্ত্বের কারণে তারা এ সুবিধাগুলো দিতে চাইছে না। এখানে লড়াইটা গরিব কৃষক এবং বিজেপি সরকারের মধ্যে নয়। লড়াইটা সম্পন্ন এবং শক্তিশালী কৃষকদের সঙ্গে শাসক বিজেপির।' তথ্যসূত্র : বিবিসি নিউজ