রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দুই বছর
সেনাদের মৃতু্যর মুখে ঠেলে দিচ্ছে ইউক্রেন
শহরের পতনের আগে রাশিয়া গোলা-বারুদের ঘাটতি কাজে লাগাতে তাদের কৌশল পরিবর্তন করে। সাঁজোয়া গাড়ির সারি দিয়ে আক্রমণ না করে তারা পদাতিক সেনার ছোট ছোট গ্রম্নপ পাঠিয়ে ইউক্রেন বাহিনীর সঙ্গে আরও কাছ থেকে লড়াইয়ে লিপ্ত হয়। এর ফলে তাদের আটকে রাখতে ইউক্রেন বাহিনীকে পাঁচগুণ বেশি গোলা-বারুদ ব্যবহার করতে হয়েছে...
প্রকাশ | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি ডেস্ক
ইউক্রেনে রুশ প্রেসিডেন্ট ভস্নাদিমির পুতিনের হামলার দুই বছর পূর্ণ হলো আজ (২৪ ফেব্রম্নয়ারি)। দোনেৎস্ক অঞ্চলের আভদিভকা শহরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর গত প্রায় ৯ মাসের মধ্যে প্রথমবারের মতো ইউক্রেন জয়ে আশাবাদী হয়ে উঠছে রাশিয়া। বিপরীতে কিয়েভের মনোবলে ফাটল ধরেছে। আর মনোবলে ফাটলের অন্যতম কারণ রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে গোলা-বারুদের মারাত্মক ঘাটতি দেখা দিয়েছে ইউক্রেনের। গোলা-বারুদের ঘাটতির ফলে ৬২০ মাইল দীর্ঘ রণাঙ্গনে ইউক্রেনের অবস্থান হুমকির মুখে পড়ছে। পুরো রণাঙ্গন এখন রুশ গোলন্দাজ বাহিনীর মারাত্মক আক্রমণের মুখে।
এমন পরিস্থিতিতে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা বু্যহ হুমকির মুখে। গত চার মাস ধরে প্রতিদিন তিনদিক থেকে রাশিয়ার আক্রমণের পর ইউক্রেনীয় বাহিনী পূর্বাঞ্চলে দোনেৎস্ক এলাকার আভদিভকা শহর থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়।
রুশ সীমান্ত থেকে দূরে, ইউক্রেনের বেশ অভ্যন্তরে আভদিভকায় ইউক্রেনীয় বাহিনী ব্যাপক প্রতিরক্ষা গড়ে তুলেছিল। রাশিয়া ২০১৪ সালে যখন প্রথম আক্রমণ চালায়, তখন থেকেই আভদিভকা একটি রণাঙ্গন। আভদিভকার সুরক্ষিত সুড়ঙ্গ আর ট্রেঞ্চ (পরিখা) নেটওয়ার্ক আরও পশ্চিমে ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহ পথগুলোকে নিরাপত্তা দেয়।
আভদিভকা দখলের ফলে রাশিয়ার মনোবল চাঙ্গা হয়েছে এবং এই যুদ্ধে তাদের সেনারা চালকের আসনে আছে বলে ক্রেমলিনের দাবিকে সমর্থন করবে। অন্যদিকে, শহরের পতন ইউক্রেনীয় বাহিনীর জন্য হতাশা নিয়ে আসবে, যারা গত বছরের পাল্টা অভিযানের পর শুধু কিছু এলাকা উদ্ধার করেছে।
আমেরিকার বাইডেন প্রশাসন আভদিভকার পতনের জন্য ইউক্রেনের জন্য ৬০০ কোটি ডলারের সামরিক সাহায্য অনুমোদন করতে কংগ্রেসের ব্যর্থতাকে দায়ী করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জানিয়েছেন, তিনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে টেলিফোনে আলাপের সময় বলেছেন, আমেরিকার সাহায্য অবশেষে চলে আসবে। ইউক্রেন আভদিভকা থেকে সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়ার পর বাইডেন জেলেনস্কির সঙ্গে কথা বলেন। তবে সাংবাদিকরা যখন জিজ্ঞাসা করেন, ইউক্রেন আরও এলাকা হারানোর আগেই কংগ্রেসে সমঝোতা হবে বলে তিনি আত্মবিশ্বাসী কি-না, বাইডেন উত্তর দেন, 'না'।
আভদিভকার পতনের কয়েক সপ্তাহ আগে থেকে রণাঙ্গনের সবচেয়ে সক্রিয় অংশে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) গোলন্দাজ ইউনিটের প্রধানসহ এক ডজনের বেশি ইউক্রেনীয় কমান্ডারের সাক্ষাৎকার নিয়েছে। তারা বলছেন, অস্ত্র-সরঞ্জামের ঘাটতিগত শরৎকাল থেকে আরও তীব্র হয়েছে। যুদ্ধের শুরু থেকেই রাশিয়ার বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্রের ঘাটতির মুখে পড়ে ইউক্রেন।
পশ্চিমাদের দেওয়া দূরপালস্নার আর্টিলারির সরবরাহ অনেক কমে গেছে। এর ফলে ইউক্রেনীয় বাহিনীর পক্ষে রুশ বাহিনীর গভীরে, যেখানে তাদের ভারী সরঞ্জাম আর সেনা সমবেত করা হয়, সেখানে আক্রমণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
কয়েক সপ্তাহ ধরে রণাঙ্গনজুড়ে ইউক্রেনীয় সেনারা গোলা-বারুদের মারাত্মক অভাবের অভিযোগ করছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আর্টিলারি ইউনিট তাদের প্রয়োজনের মাত্র ১০ শতাংশ সরবরাহ নিয়ে লড়াই করছে। শেল বাঁচানোর জন্য মরিয়া হয়ে তারা তাদের ইউনিটগুলোকে শুধু সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার নির্দেশ দিচ্ছে।
তবে রণাঙ্গনে কমান্ডাররা বলেন, এই নীতি দিয়ে তাদের শত্রম্নপক্ষকে থামিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়, যাদের অনেক বেশি গোলা-বারুদ সরবরাহ আছে। নতুন সামরিক সাহায্য ছাড়া আভদিভকার পতনের পুনরাবৃত্তি অন্য জায়গায় দেখা যাবে বলে উদ্বেগ এখন বাড়ছে।
অত্যন্ত সুরক্ষিত শহর থেকে ইউক্রেনীয় বাহিনী প্রত্যাহার করা গত বছরের বাখমুতের জন্য লড়াইয়ের পর রাশিয়ার জন্য সবচেয়ে বড় বিজয় নিয়ে এসেছে। এর ফলে ক্রেমলিনের বাহিনী আরও পশ্চিমে অগ্রসর হতে পারবে, কম সুরক্ষিত ইউক্রেনীয় এলাকার আরও গভীরে। সামরিক বস্নগারদের মতে, আরও পূর্বে রেলওয়ে জংশন পক্রভস্ক রাশিয়ার পরবর্তী লক্ষ্য হতে পারে। রাশিয়ার সামরিক কর্মকর্তা এবং বস্নগাররা বলছেন, আভদিভকা দখলের ফলে রুশ-দখলকৃত দোনেৎস্ক শহরের ওপর হুমকি কমিয়ে দিয়েছে।
ইউক্রেনের একটি আর্টিলারি ইউনিটের কমান্ডার খরব্রাই বলেন, 'এই মুহূর্তে গোলাবারুদের ঘাটতি বেশ সিরিয়াস। আমাদের সব সময় প্রতিশ্রম্নতি দেওয়া হয় যে- আরও আসছে, কিন্তু আমরা সেটা আসতে দেখি না। ইউনিটের প্রয়োজনের মাত্র ৫-১০ শতাংশ গোলা-বারুদ অবশিষ্ট আছে।' তিনি বলেন, এ অবস্থা তার বাহিনীর কার্যকরভাবে আক্রমণ করে হারানো এলাকা পুনরুদ্ধার করার ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে। আরও মারাত্মক, পদাতিক সেনাদের জন্য আর্টিলারি সাপোর্ট না থাকায় আরও বেশি সংখ্যক সেনা হতাহত হচ্ছে।
এ রিপোর্টের জন্য এপি যেসব অফিসারের সাক্ষাৎকার নিয়েছে, নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের পুরো নাম প্রকাশ করা হয়নি। একটি হাউইৎজার ইউনিটকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ভ্যালেরি। তিনি জানান, 'যুদ্ধ করার মতো প্রয়োজনীয় অস্ত্র নেই আমাদের হাতে। এই বাহিনী ন্যাটো-ব্যবহৃত ১৫৫ মিলিমিটার শেল ব্যবহার করে। কোনো রুশ আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য তাদের প্রতি ইউনিটের প্রতিদিন ১০০ থেকে ১২০টি শেল দরকার। এখন আমাদের কাছে প্রয়োজনের ১০ শতাংশ রয়েছে মজুদ রয়েছে।'
আভদিভকায় মোতায়েন ইউক্রেনীয় সেনারা বলছে, শহরের পতনের আগে রাশিয়া গোলা-বারুদের ঘাটতি কাজে লাগাতে তাদের কৌশল পরিবর্তন করে। সাঁজোয়া গাড়ির সারি দিয়ে আক্রমণ না করে তারা পদাতিক সেনার ছোট ছোট গ্রম্নপ পাঠিয়ে ইউক্রেন বাহিনীর সঙ্গে আরও কাছ থেকে লড়াইয়ে লিপ্ত হয়। এর ফলে তাদের আটকে রাখতে ইউক্রেন বাহিনীকে পাঁচগুণ বেশি গোলা-বারুদ ব্যবহার করতে হয়েছে।
ইউক্রেনের ১১০ ব্রিগেডের একজন সেনা চাকলুন বলেন, 'শত্রম্নবাহিনী আমাদের সক্ষমতা বুঝতে পারে এবং সেটা দিয়ে তারা সফল হতে পেরেছে।'
রণাঙ্গনের অন্যান্য সেক্টরে এই গোলাবারুদের ঘাটতি কী প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। ইউক্রেনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে কুপিয়ান্সক লাইন বেশ দুর্বল। গত কয়েক মাস ধরে রাশিয়া এই এলাকা লক্ষ্য করে তাদের আক্রমণ জোরদার করছে। তারা চেষ্টা করছে, এই গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহ কেন্দ্র আবার দখল করতে, যেটা তারা ২০২২ সালের শরৎকালে হারিয়েছিল। তথ্যসূত্র : ভয়েস অব আমেরিকা
কুপিয়ান্সক-এ ৪৪ ব্রিগেডের কমান্ডার ইউরি বলছেন, তার গোয়েন্দা বিমান ইউনিটগুলো অনেক দূরপালস্নার লক্ষ্যবস্তু চিহ্নিত করে, যাদের মধ্যে রয়েছে রাশিয়ার মর্টার আর গ্রেনেড নিক্ষেপের কামান। কিন্তু যথেষ্ট গোলা-বারুদ তাদের নেই, তাই তারা সেই লক্ষ্যগুলোতে আঘাত হানতে পারছে না। সেটা না করে, তার শত্রম্ন কীভাবে সেনা সমাবেশ করছে, সেটা দূর থেকে দেখা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
অলেক্সান্দের বলেন, এই মুহূর্তে তার যথেষ্ট পরিমাণ গোলাবারুদ আছে। তিনি কুপিয়ান্সক-এ ৩২ ব্রিগেডের একটি ব্যাটালিওনের কমান্ডার। তিনি বলেন, 'কিন্তু সব নির্ভর করছে রাশিয়ার দিক থেকে তীব্রতার ওপর। তারা যদি মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, তাহলে এই লাইন ধরে রাখা সম্ভব হবে না।' তথ্যসূত্র : ভয়েস অব আমেরিকা, এএফপি