ইয়েমেনে হুতিদের লক্ষ্য করে অনবরত বিমান হামলা চালানোর পরও তাদের আক্রমণের তীব্রতা কমাতে ব্যর্থ হয়েছে আমেরিকা ও যুক্তরাজ্য। বিবিসি ভেরিফাইয়ের অনুসন্ধানে এমন তথ্যই উঠে এসেছে। গত তিন সপ্তাহে অঞ্চলটিতে যাতায়াত করা জাহাজ লক্ষ্য করে ৯টি হামলা চালানো হয়েছে, যেখানে আগের তিন সপ্তাহে হামলা হয়েছিল ছয়টি। সর্বশেষ শনিবার ইয়েমেনে হুতিদের ওপর তৃতীয় দফায় যৌথ হামলা চালিয়েছে যুক্তরাজ্য ও আমেরিকা। এই হামলায় সমর্থন দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া, বাহরাইন, কানাডা, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস ও নিউজিল্যান্ড।
এক যৌথ বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, ইয়েমেনের ১৩টি লোকেশনের ৩৬টি টার্গেটে এই হামলা চালানো হয়। অস্ত্র মজুদ কেন্দ্র, ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা এবং লঞ্চার, বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং রেডার লক্ষ্য করে এসব হামলা চালানো হয়েছে। মার্কিন নেতৃত্বে ১১ জানুয়ারি হামলা শুরুর পর থেকে, লোহিত সাগরের গুরুত্বপূর্ণ এই বাণিজ্য রুটটি ব্যবহার করে পণ্য পরিবহণ ২৯ শতাংশ কমে গেছে।
কৌশল পরিবর্তন
শুরুর দিকে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পৃক্ত জাহাজ লক্ষ্য করেই কেবল হামলা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছিল হুতিরা। কিন্তু জানুয়ারি থেকে তাদের হামলার শিকার বেশির ভাগ জাহাজই ছিল আমেরিকা ও যুক্তরাজ্যের মালিকানাধীন বা তাদের পরিচালনাধীন।
নভেম্বরে আক্রমণ শুরুর পর থেকে অন্তত ২৮টি জাহাজে হামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে সাতটি জাহাজ ইসরাইলি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট বা ইসরাইলের দিকে যাচ্ছিল বলে শনাক্ত করেছে বিবিসি ভেরিফাই। মালিকানার এই সংযোগ খুঁজতে যেখানে যেখানে সম্ভব জাহাজ ট্র্যাকিং উপাত্ত এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর অফিসিয়াল রেকর্ড ব্যবহার করেছে বিবিসি ভেরিফাই। তবে কোম্পানির মালিকানার একাধিক স্তর ভেদ করে জাহাজের সঙ্গে কারও সংশ্লিষ্টতা শনাক্ত করার এই প্রক্রিয়া সহজ নয়।
বিমান হামলা শুরুর পর থেকে আক্রমণ করা ৯টি জাহাজের মধ্যে পাঁচটির আমেরিকান বা ব্রিটিশ সম্পৃক্ততা ছিল। এগুলোর কোনো ইসরাইলি সংযোগ শনাক্ত করা যায়নি। লক্ষ্যবস্তুর সঙ্গে সঙ্গে হুতিদের আক্রমণের কৌশলও পাল্টেছে। নভেম্বর ও ডিসেম্বরে তাদের আক্রমণের মূল লক্ষ্য ছিল বাব আল-মান্দাব প্রণালির কাছাকাছি লোহিত সাগরের দক্ষিণ প্রান্ত, যেখানে জাহাজগুলোকে বাধ্য হয়েই হুতি-নিয়ন্ত্রিত ইয়েমেনি উপকূলের খুব কাছ দিয়ে যেতে হতো।
গত কয়েক সপ্তাহে তারা মূলত এডেন উপসাগরের দক্ষিণে আঘাত করছে। হুতিরা আক্রমণের ধরনও পরিবর্তন করেছে। শুরুতে তারা বিস্ফোরক ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন দুটোই ব্যবহার করলেও, সাম্প্রতিক হামলাগুলোতে মূলত ইয়েমেন থেকে উৎক্ষেপণ করা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করছে।
লোহিত সাগর পণ্য পরিবহণের গুরুত্বপূর্ণ রুট, একইসঙ্গে এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে পণ্য পরিবহণের সবচেয়ে কার্যকর পথ। তবে জাহাজ ট্র্যাকিং ফার্ম লয়েড'স লিস্ট ইন্টেলিজেন্সের মতে, হুতি হামলা শুরুর পর থেকে এই রুট ব্যবহার করে চলাচলকারী বাণিজ্যিক জাহাজের সংখ্যা ৫০ শতাংশ কমে গেছে। মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক অংশীদারিত্ব এবং এই অঞ্চলে বাণিজ্যিক পণ্য পরিবহণ সুরক্ষিত রাখতে যুক্তরাজ্যের নৌবাহিনী সক্রিয় থাকা সত্ত্বেও এমনটা ঘটছে। আর পণ্য পরিবহণ কমে যাওয়ার এই প্রবণতা মৌসুমি বলে মনে হচ্ছে না। কারণ গত বছরের একই সময়ে পণ্য পরিবহণ কমেনি।
জাহাজ চলাচল কমল কেন?
গত ১৯ নভেম্বর গ্যালাক্সি লিডারকে হাইজ্যাক করার বিষয়ে শিপিং কোম্পানিগুলোর কোনো প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল না। কিন্তু জাহাজ ট্র্যাকিং ডেটা অনুযায়ী, ১৫ ডিসেম্বর থেকে জাহাজ অপারেটররা আফ্রিকার দিকে তাদের কার্গো রুট পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিলে দৃশ্যপট বদলে যায়।
বিকল্প পথ ব্যবহার করলে বেশি জ্বালানি খরচ, সেইসঙ্গে ক্রুদের বেশি মজুরি এবং বিমা খরচ দিতে হচ্ছে। তা সত্ত্বেও কয়েক সপ্তাহ ধরে লোহিত সাগর ব্যবহার করে জাহাজ চলাচল কমে গেছে। যেমন, সাংহাই থেকে রটারডাম পর্যন্ত একটি স্বাভাবিক আকারের ৪০ ফুট কন্টেইনার পরিবহণের খরচ নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ছিল প্রায় ১ হাজার ২০০ ডলার, যা জানুয়ারির শেষে বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার ডলারে। পণ্য পরিবহণের শুল্ক বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জ্বালানি থেকে খাবার পর্যন্ত সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের দামের ওপর অনিবার্যভাবেই চাপ পড়বে।
মূল্য পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা 'আর্গাস মিডিয়া'র তথ্য অনুসারে, সুয়েজ খালের পরিবর্তে আফ্রিকা হয়ে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপে যেতে হলে যাত্রার সময় তিন সপ্তাহ পর্যন্ত বেড়ে যায় আর খরচ বাড়ে দুই মিলিয়ন ডলারের বেশি। মেরিটাইম এআই কোম্পানি 'উইন্ডওয়ার্ড'র উপাত্তের ভিত্তিতে তৈরি করা এই মানচিত্রে দেখা যাচ্ছে, গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে আফ্রিকার দিকে জাহাজ চলাচল উলেস্নখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। খালের পরিচালনা পর্ষদ বলছে, সুয়েজ খালের মধ্য দিয়ে কম জাহাজ চলাচলের কারণে জানুয়ারিতে এর রাজস্ব ২০২৩ সালের একই মাসের তুলনায় ৪৪ শতাংশ কমেছে। অঞ্চলটিতে জাহাজ চলাচল নিয়ে এই সংকট চলমান থাকবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। ফলে চলতি বছর রাজস্ব ৪০ শতাংশ কমে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে, যার পরিমাণ ছয় বিলিয়ন ডলার হতে পারে।
লয়েড'স লিস্ট ইন্টেলিজেন্স বলছে, কনটেইনার জাহাজের মতো কিছু ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য, যেখানে কি না 'মায়েরস্কের' মতো অল্প সংখ্যক কোম্পানি বৈশ্বিকভাবে জাহাজের বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার ফলে ইউরোপীয় দেশগুলো এশিয়া থেকে তেল ও গ্যাস নিতে বাধ্য হওয়ায় গত দুই বছরে সুয়েজ খাল ব্যবহার করে তেলের ট্যাংকার চলাচলের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। হুতি বিদ্রোহীদের হামলা শুরু হওয়ার পর থেকে সেই সংখ্যাও কমেছে, যদিও তা কন্টেইনার শিপিংয়ের মতো নাটকীয়ভাবে নয়।
ঝুঁকি প্রশমন
ঝুঁকি নিয়েই লোহিত সাগরের পথ দিয়ে যাতায়াত করা জাহাজ অপারেটররা আক্রমণের সম্ভাবনা কমাতে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। ছিনতাইয়ের প্রচেষ্টা প্রতিহত করতে কিছু কোম্পানি অর্থ খরচ করে তাদের জাহাজে সশস্ত্র নিরাপত্তা বাহিনী রাখছে। অন্যরা তাদের অন-বোর্ড এআইএস ট্র্যাকিং বন্ধ রেখেছে। সব বাণিজ্যিক জাহাজ তাদের অবস্থান এবং ঘোষিত রুট নিরীক্ষণের অনুমতি দেওয়ার জন্য এই ট্র্যাকিং ব্যবস্থা ব্যবহার করে। ট্র্যাকার বন্ধ রাখলে হুতিদের পক্ষে তাদের শনাক্ত করা কঠিন হবে।
কেউ কেউ তাদের অবস্থান শনাক্তকারী সরঞ্জামে 'ইসরাইলের সঙ্গে কোনো যোগসূত্র নেই' ঘোষণা দিয়ে রেখেছে, আবার কেউ 'জাহাজে সশস্ত্র রক্ষীরা আছে' বা 'সব ক্রু চীনা'- এমন কথা লিখে রেখেছে। জাহাজ মালিকদের বিশ্বাস, এতে করে হুতিরা আক্রমণ করা থেকে নিরস্ত থাকবে।
কিছু চীনা কোম্পানি হুতিদের থেকে পাওয়া নিরাপত্তা আশ্বাসকে কাজে লাগিয়েছে। লয়েড'স লিস্ট ইন্টেলিজেন্স বলছে যে, নভেম্বরের শেষ থেকে লোহিত সাগরের মধ্য দিয়ে যাওয়া জাহাজের মধ্যে চীন-সংশ্লিষ্ট জাহাজের অনুপাত ১৩ থেকে ২৮ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। তথ্যসূত্র : বিবিসি নিউজ