সিরিয়া ও ইরাকে অবস্থিত ইরানের বিভিন্ন স্থাপনায় ধারাবাহিকভাবে হামলার পরিকল্পনা অনুমোদন দিয়েছে আমেরিকা। তবে কবে থেকে হামলা শুরু করা হবে, তা স্পষ্ট করে জানায়নি দেশটি। তারা বলেছে, বেশ কয়েক দিন ধরে ওই হামলা চালানো হবে। হামলা কখন শুরু করা হবে, তা আবহাওয়া পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে। এর আগে গত রোববার জর্ডান-সিরিয়া সীমান্তের কাছে একটি মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে ড্রোন হামলায় তিন সেনা নিহত হয়। ওই হামলার জন্য ইরান সমর্থিত একটি সশস্ত্র গ্রম্নপকে দায়ী করেছে ওয়াশিংটন। রোববারের ওই ঘটনার পরই ইরানের স্থাপনায় হামলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। তথ্যসূত্র : বিবিসি, সিএনএন
'ইসলামিক রেজিস্ট্যান্স ইন ইরাক' নামে পরিচিতি ওই গোষ্ঠীতে এমন কিছু সশস্ত্র যোদ্ধা রয়েছে, যাদেরকে অস্ত্র, তহবিল ও প্রশিক্ষণ দিয়েছে ইরানের প্রতিরক্ষা বাহিনী রেভু্যলিউশনারি গার্ডস ফোর্স। ধারণা করা হয়, রোববারের হামলার পেছনে এই গোষ্ঠীর হাত ছিল। এরই মধ্যে হামলার জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে ইরান। মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছেন, 'টাওয়ার ২২' নামে পরিচিতি ওই সামরিক ঘাঁটিতে হামলায় যে ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছিল, তা ইরানেই তৈরি করা এবং ইউক্রেনে হামলার চালানোর উদ্দেশে রাশিয়ায় ইরান যে ড্রোন পাঠিয়েছে, তার সঙ্গে এর মিল রয়েছে।
বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন বিলম্বিত সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে বলেন, 'আমরা যেখানে, যখন এবং যেভাবে চাই, সেভাবেই পাল্টা পদক্ষেপ নেব। প্রকৃত দায়ী ব্যক্তিকে জবাবদিহির আওতায় আনাটা নিশ্চিত করতে হবে, এ সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জগুলোর বিষয়ে সবাই জানেন বলে আমি মনে করি।' তিনি বলেন, 'এটি নিশ্চিত করার জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো সূত্র বা নিয়ম নেই। এটি যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায়, সেজন্য অনেকগুলো উপায় আছে। আর আমরা সেটার ওপরই গুরুত্ব দিয়ে আসছি।'
উলেস্নখ্য, ইসরাইল ও হামাসের মধ্যকার সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। ফলে স্থানীয় ও বৈশ্বিক শক্তিগুলোর মধ্যে একটি সংঘর্ষ দিন দিন অনিবার্য হয়ে উঠছে। মধ্যপ্রাচ্যে এখন যে ধরনের লড়াই দেখা যাচ্ছে, তা অনেকটা ছোট ধরনের হামলা ও এর পাল্টা হামলা। ইরান সমর্থিত যোদ্ধা সংগঠনগুলো ও মার্কিন সেনাবাহিনীর মধ্যে এসব লড়াই চলছে। এছাড়া ইসরাইলকে টার্গেট করছে ইরানপন্থি বাহিনীগুলো। তবে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাপ্রবাহ ইঙ্গিত দিচ্ছে, ইরান ও আমেরিকার মধ্যে একটি সরাসরি যুদ্ধও দিন দিন ঘনিয়ে আসছে।
এতদিন পর্যন্ত ইরান ও আমেরিকা সরাসরি একে অপরের মুখোমুখি যুদ্ধ এড়িয়ে গেছে। আমেরিকা ইয়েমেন, সিরিয়া ও ইরাকে ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোকে আক্রমণ করেছে। অপরদিকে ইরান-সম্পর্কিত গোষ্ঠীগুলো ইরাক ও সিরিয়ায় মার্কিন ঘাঁটিগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করেছে। তেহরানও ইরাক, সিরিয়া ও পাকিস্তানে ইরানবিরোধী গোষ্ঠীগুলোকে শায়েস্তা করতে উঠেপড়ে লেগেছে। সম্প্রতি ইরানে পাল্টা হামলা চালিয়েছে পাকিস্তানও। ইরান দীর্ঘদিন ধরেই তার চারদিকে মার্কিন বাহিনীর ঘাঁটি স্থাপনের বিরোধিতা করে আসছে।
ইরান মধ্যপ্রাচ্যকে নিজের 'উঠান' বলে মনে করে। গত কয়েক দশক ধরে ইসলামপন্থি, পশ্চিমা-বিরোধী এবং ইসরাইল-বিরোধী বহু বাহিনী গড়ে তুলেছে ইরান। দেশটি এই পুরো নেটওয়ার্ক তৈরি করতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। তারাই এসব বাহিনীকে প্রশিক্ষণ, তহবিল এবং অস্ত্র দেয়। এই গোষ্ঠীগুলো সাম্প্রতিক সময়ে আরও সক্রিয় হয়ে উঠছে। বিশেষ করে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক জলপথে জাহাজ চলাচল বাধাগ্রস্ত করছে। এতে পশ্চিমা দেশগুলোর বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নিজেদের অর্থনীতি বাঁচাতে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো ইয়েমেনে আক্রমণ করেছে। ইরান গাজার হামাসকেও অর্থায়ন করে। এই বাহিনী গত ৭ অক্টোবর ইসরাইলের অভ্যন্তরে হামলা চালিয়েছিল।
হামাস-ইসরাইল সংঘাতের আগেই মধ্যপ্রাচ্যে ৩০ হাজার মার্কিন সেনা উপস্থিত ছিল। যুদ্ধ শুরুর পর আরও ১ হাজার ২০০ সেনা পৌঁছেছে সেখানে। সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের কাছাকাছি মোতায়েন করা হয়েছে আরও দুই হাজারের বেশি সেনা। ইরাক ও সিরিয়ায়ও আছে মার্কিন সেনারা। এতে ইরানকে ভালোভাবেই চাপে রাখতে পারছে দেশটি। তবে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন অংশে নিজেদের বাহিনীকে শক্তিশালী করছে আমেরিকা ও ইরান উভয়ই।
এর মধ্যে লেবাননে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী আধাসামরিক বাহিনী রয়েছে। সেখানে আছে ইরান-সমর্থিত হিজবুলস্নাহ। গোষ্ঠীটির প্রধান ঘাঁটি ইসরাইল-লেবানন সীমান্তে অবস্থিত। গাজায় লড়াই শুরু হওয়ার পর থেকে ইসরাইলের সঙ্গে গুলি বিনিময়ও করেছে লেবানন। এই বাহিনীর কাছে এক লাখ ৫০ হাজার থেকে দুই লাখ ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। আছে প্রচুর রকেট ও মর্টার। তেল আবিবের 'ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডিজ' অনুসারে, এই শত শত ক্ষেপণাস্ত্র অত্যন্ত নির্ভুল ও অত্যন্ত ধ্বংসাত্মক। হিজবুলস্নাহ নেতা হাসান নাসরালস্নাহ দাবি করেছেন, গোষ্ঠীটির এক লাখের বেশি সক্রিয় সেনা রয়েছে। ইরানই হিজবুলস্নাহর প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ। ফলে আমেরিকার আক্রমণের পর ওই অঞ্চলে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।